রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর রেল গেট এলাকায়। প্রতি বছর ঈদুল আজহাতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পশুর চামড়া এই হাটে নিয়ে আসেন জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে। এ সময় বেলপুকুরে চেয়ারম্যানের গুদাম থেকে টাওয়ারের মোড় এলাকাজুড়ে বসে চামড়া কেনাবেচার হাট।
রোববার (২৫ জুলাই) দুপুরের দিকে সরেজমিনে হাটে গিয়ে দেখা যায় চামড়া ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা। কর্মীদের হাতে ধারালো ছোট একটি চাকু, পাশে একটি ইট। তা দিয়ে চামড়ায় লেগে থাকা চর্বি ও নষ্ট চামড়াগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। অন্যদিকে আরেকজন সেই চামড়াটি নিয়ে তাতে লবণ লাগাচ্ছেন।
সেখানে কথা হয় মো. সারোয়ারের সঙ্গে। চামড়া ব্যবসায় রয়েছেন দীর্ঘ ৪০ বছর। তিনি বলেন, ‘গত বছরের মতো এবারও চামড়ার দাম কম পাওয়া গেছে। এবার খাসির চামড়া ৬০ থেকে ৮০ টাকা এবং ভেড়ার চামড়া কিনেছি ৬০ থেকে ৯০ টাকায়। আবার ৩০ ফিট সাইজের গরুর চামড়া কিনেছি ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায়, মাঝারি সাইজ অর্থাৎ ২০ থেকে ২৫ ফিটের চামড়া কিনেছি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় এবং ২০ ফিটের নিচের সাইজের ছোট চামড়া কিনেছি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। মহিষের চামড়া আকারে বেশ বড় হওয়ায় সেগুলো ১৫০০-১৬০০ টাকা দরে কিনতে হয়।
খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটি গরুর চামড়াতে প্রায় ২০০ টাকা লবণ দিতে হয়। খাসির চামড়াতে লবণ খরচ পড়ে ৫০-৮০ টাকা। এছাড়া দৈনিক লেবার খরচ দিতে হয় ৫০০-৭০০ টাকা। এমনকি লেবারের খাবারও দিতে হয়। সবমিলিয়ে খরচ বাদে ৮০ থেকে ১০০ টাকা লাভে চামড়া বিক্রির লক্ষ্য থাকে আমাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে চামড়ার ব্যবসা খুব খারাপ যাচ্ছে। এ কারণে অনেকটা আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছি। আমিসহ ইকবাল ও কাওসার নামের আরও দুই অংশীদার রয়েছে। আমরা তিনজন গত তিন বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকা লস করেছি। আবার চামড়া বিক্রি করলেও পাইকাররা সহজে টাকা দেয় না।’
কথা হয় হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। পেশায় তিনি কসাই ও নিয়মিত চামড়া ব্যবসায়ী। প্রায় ৫০ বছর ধরে করছেন চামড়ার ব্যবসা। তবে তিনি শুধুমাত্র খাসির চামড়া কেনাবেচা করেন।তিনি বলেন, ‘গত বছর লস করেছি এক লাখ টাকা। এবারও খাসির চামড়া কিনেছি ২ হাজার পিস এবং বকরির চামড়া কিনেছি ১০০০ পিসের মতো। এবার সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে শুনেছি। কিন্তু ঢাকা ও নাটোরের আড়তদাররা চামড়ার দাম এখনও জানায়নি। তাই জানা নেই চামড়া কি দামে বিক্রি করতে পারব। আশা করছি এবার চামড়ার দাম পাব। তবে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ ও কম মূল্যের চামড়া বাজার হওয়ায় বেশ শঙ্কাতেও আছি।’
শঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, বিধিনিষেধের কারণে চামড়া গন্তব্যে পৌঁছে দিতে বা বিক্রির জন্য নিয়ে যেতে পারছি না। ট্রাক্টর বা নসিমনে পুলিশ চামড়া নিয়ে যেতে দিচ্ছে না। রাজশাহী জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির কার্ড দেখানোর পরও তারা বাধা দিচ্ছে। অন্যদিকে নসিমন ও ট্রাক্টরচালকরাও জেল-জরিমানার ভয়ে যেতে চাচ্ছে না। এতে চামড়া নিয়ে বেশ শঙ্কাতেই কাটছে দিন।’
হাবিবুর রহমানসহ অধিকাংশ চামড়া ব্যবসায়ী জানান, একটি ট্রাকে ভাড়া নেয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। অন্যদিকে ট্রাক্টর কিংবা নসিমনে ভাড়া দিতে হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে ট্রাক ভাড়া করলে লাভের পুরো টাকাই ট্রাকের ভাড়ায় চলে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে চামড়া কেনার আড়ত ৬০টি। এর মধ্যে সিংহভাগ ব্যবসার নিয়ন্ত্রক ১০ ব্যবসায়ী। আছেন দুই ট্যানারি মালিক।
সার্বিক অবস্থা নিয়ে রাজশাহী জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি আসাদুজ্জামান মাসুদ বলেন, ‘ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে। জেলার ব্যবসায়ীদের ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। ঈদের আগে কিছু টাকা পেলে বেশি করে চামড়া কিনে ব্যবসা করার সুযোগ থাকত। প্রতিবছর কোরবানির দিন থেকে শুরু হয় চামড়া কেনাবেচা। পাড়া-মহল্লায় গিয়ে চামড়া কেনেন ব্যবসায়ীরা। এর পরে পাইকারি ও ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করা হয় চামড়াগুলো। এমন কর্মযজ্ঞ চলে দুই-তিন সপ্তাহ ধরে।’
তিনি বলেন, ‘বিধিনিষেধ শুরু হলে ভালোভাবে এসব কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঈদের পরদিন থেকেই বিধিনিষেধ, এ নিয়ে বেশ চিন্তায় আছি। দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসার স্বার্থে হলেও বিধিনিষেধে আমাদের চলাফেরার অবাধ সুযোগ দেওয়া খুবই প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শরিফুল হক বলেন, ‘পরিবহনযোগ্য কাঁচামালের মধ্যে চামড়া শিল্পও পড়ে। সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে রাস্তাঘাটে চলাফেরায় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ মনিটরিং টিম কাজ করছে। তারপরও আমরা এ বিষয়ে সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব, যাতে চামড়া ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন।’ আজকের তানোর