শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৯:৫৪ pm
ডেস্ক রির্পোট : বরেন্দ্র অঞ্চল হওয়ায় রাজশাহী একটি ক্ষরাপ্রবণ এলাকা। শুষ্ক মৌসুমে এই অঞ্চলের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন কম হয়। তবে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে দিন দিন ‘ড্রাগন’ ফলের চাষ বাড়ছে। ‘ড্রাগন’ চাষ অধিক লাভজনক এবং এটি CAM Plant জাতীয় ফসল হওয়ায় (ক্ষরা ও দুর্যোগ মোবাবেলায় সক্ষম) বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিরা এই ফল চাষের দিকে বেশি ঝুঁকছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে- ড্রাগন হলো CAM Plant জাতীয় ফসল। আর ক্যাম্প প্লান্টের বৈশিষ্ট্য হলো- এই জাতীয় ফসল মরুভূমির মধ্যেও বেঁচে থাকে। পানির তেমন প্রয়োজন হয় না। ড্রাগন ফল প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করারও যোগ্যতা রাখে। তাই বরেন্দ্র অঞ্চলের শুষ্ক জমিতে দিন দিন ড্রাগন ফল চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে- রাজশাহীতে গত বছর (২০১৯-২০২০ অর্থবছর) ৭ দশমিক ৫৬ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফল চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে রাজশাহী নগরীর মতিহার থানা এলাকায় ০.৫ হেক্টর, পবা উপজেলায় ০.৫০ হেক্টর, জেলার তানোর উপজেলায় ০.৮০ হেক্টর, মোহনপুর উপজেলায় ০.১৩ হেক্টর, দুর্গাপুর উপজেলায় ০.১৩ হেক্টর, পুঠিয়া উপজেলায় ৩ হেক্টর, গোদাগাড়ী উপজেলায় ২ হেক্টর এবং চারঘাট উপজেলায় ০.৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ হয়েছে।
আর চলতি অর্থবছরে (২০২০-২০২১) রাজশাহীর এই বরেন্দ্র অঞ্চলে ২৭.০৮ হেক্টর (নগরীর বোয়ালিয়া থানা এলাকায় ০.১৫ হেক্টর, পবা উপজেলায় ০.৫০ হেক্টর, জেলার তানোর উপজেলায় ০.৮০ হেক্টর, মোহনপুর উপজেলায় ০.১৩ হেক্টর, দুর্গাপুর উপজেলায় ০.৫০ হেক্টর, পুঠিয়া উপজেলায় ৪ হেক্টর, গোদাগাড়ী উপজেলায় ২০ হেক্টর এবং চারঘাট উপজেলায় ১ হেক্টর) জমিতে ড্রাগনের চাষ হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, ‘২০১৯-২০২০ অর্থবছরের চেয়ে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রাজশাহী অঞ্চলে ১৯.৫২ হেক্টর বেশি জমিতে ড্রাগনের চাষ হয়েছে। আগামীতে রাজশাহী অঞ্চলে আরও বেশি জায়গায় এই ড্রাগন চাষ হবে বলে আশাবাদী। তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯-২০২০ বছরে রাজশাহীতে ৭.৫৬ হেক্টর জমিতে ৯০.২১ মেট্রিকটন ও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২৭.০৮ হেক্টর জমিতে ৩২২.৬৫ মেট্রিকটন ড্রাগন ফলের চাষ হয়েছে।’
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ড্রাগন চাষি মো. শফিউল ইসলাম মুক্তা বলেন, ‘গত বছর সাড়ে ৫ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করে ২৭ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেছিলাম। তবে ফল ধরতে দেড় বছর সময় লাগে। এবছর সাড়ে ৫ বিঘাসহ গোদাগাড়ী উপজেলার দুইটি ইউনিয়নে (গোগ্রাম ও মাটিকাটা ইউনিয়ন) মোট ৫২ বিঘা জমিতে ৩টি ড্রাগন ফলের বাগান করেছি। ইতোমধ্যেই বাগান থেকে ড্রাগন ফল নামানো শুরু হয়েছে। অর্থাৎ ড্রাগন ফলের উৎপাদন সময় হলো জুন থেকে শুরু করে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত।’ উৎপাদন খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে এই ড্রাগন চাষি বলেন, এক বিঘা জমিতে ২২০টি পিলার ও হ্যাঙ্গার লাগে। এছাড়া ড্রাগন উৎপাদনে টায়ারের প্রয়োজন হয়। সবমিলিয়ে চারা ক্রয় থেকে ড্রাগনের ফলন (১৮ মাসে) বিঘা প্রতি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকার মত খরচ হয়।’ ড্রাগনের দাম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো অর্থাৎ বড়টা গত বছর সাড়ে ৪০০ টাকা, মাঝাড়ি ধরনেরটা ৩০০ টাকা এবং নিম্নমানেরটা সর্বনিম্ন ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। তবে এবছর করোনার কারণে সবচেয়ে ভালো ড্রাগন বিক্রি করতে হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি দরে।’
এই ড্রাগন চাষির তথ্যের বরাত দিয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রাজশাহীতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২৭.০৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত মোট ৩২২.৬৫ মেট্রিকটন ড্রাগনের আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি ৯৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০৩ টাকা। আর এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০২০ বছরে রাজশাহীতে ৭.৫৬ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত মোট ৯০.২১ মেট্রিকটন ড্রাগনের মূল্য প্রায় ৩ কোটি ৬ লাখ ১২ হাজার ১৮৩ টাকা।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ ইউনিয়নের মাইপাড়া এলাকার চাষি আলহাজ্জ্ব আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী, এবার আমি ১০ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ড্রাগন চাষের পদ্ধতি জানার জন্যই আজ (২৭ জুন) কৃষি সম্প্রসারণ অফিসে এসেছি। ক্ষরাপ্রবণ এলাকাতে এই ড্রাগনের ভালো ফলন হয় বলে জানতে পেরেই এবার আপাতত ১০ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করছি।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কে জে এম আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘ড্রাগন বৃক্ষ একটি ক্যাক্টাস প্রজাতির গাছ। পাশাপাশি এটি CAM Plant জাতীয় ফসল হওয়ায় (ক্ষরা ও দুর্যোগ মোবাবেলায় সক্ষম) এটি বরেন্দ্র অঞ্চলের রসহীন মাটিতেও চাষের উপযোগী। কারণ- ড্রাগন গাছের পাতা নেই তাই এটি পানি কম ব্যবহার করে এবং ক্ষরা সহ্য করতে পারে। তবে সেচ ব্যবস্থাপনায় থাকলে এটির ফলন আরও বেশি হবে। এই ড্রাগন মে মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ফল দেয়। যার কারণে শিলাবৃষ্টিতে একবার একটু ক্ষতিও হলেও পরের ফলনে কিন্তু পুষিয়ে নেয়া যায়। তাই এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খরাসহিষ্ণু একটি ফসল। এজন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিদের ড্রাগন ফলের চাষ করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী অঞ্চলে ড্রাগন চাষ দিন দিন বাড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ড্রাগন চাষের শুরুতেই খরচ একটু বেশি। কেননা ড্রাগন চাষের শুরুতেই পিলার, হ্যাঙ্গার এবং টায়ারের ব্যবস্থা থাকতে হয়। এ বিঘা জমিতে আনুমানিক ২০০টি করে পিলার হ্যাঙ্গার লাগে। একটি পিলারের দাম ৪০০-৫০০ টাকা, হ্যাঙ্গারের দাম ২০০ টাকা এবং ১টি টায়ারের দাম আনুমানিক ১০০টাকা। সেই হিসেবে এক বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষের জন্য আনুমানিক প্রায় ১ লাখ ৬০ টাকা খরচ করতে হয়। তবে একবার ড্রাগন চাষ করলে সেই চারা কমপক্ষে ২০ বছর ফল দিবে। সেই তুলনায় শুরুতে এই খরচটা খুব বেশি নয়।’
উল্লেখ্য, নাটোরের সিংড়া উপজেলার তৎকালীন কৃষি কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হক ২০১২ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিদের ড্রাগন চাষে উদ্বুদ্ধ করতে নাটোর থেকে ৬০০ চারাগাছ সংগ্রহ করে পবার মতিয়া বিলে ২ লাখ টাকা খরচ করে তিনি ড্রাগনের বাগান তৈরির কাজ শুরু করেন। ২১ কাঠা জমিতে মেক্সিকান ফল ‘ড্রাগন’ চাষ করে তিনি সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষিরা আস্তে আস্তে এই ড্রাগন ফল চাষের দিকে ঝুঁকতে থাকে। আজকের তানোর