শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:০১ am
অদ্ভুত এক দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আসেনি অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব। তৈরি হয়নি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। শ্রমিক পায়না ন্যয্য শ্রমমূল্য, নদীভাঙ্গন কবলিত মানুষ পায়না মাথা গোঁজার ঠাঁই। অন্য পায়না নিন্মবিত্ত-ভাসমান মানুষেরা। স্বাস্থ্যসম্মত জীবন নির্বাহ করতে পারে না দারিদ্রসীমার নিচে থাকা প্রায় ৫ কোটি মানুষ। শিক্ষা-খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানসহ মৌলিক প্রায় সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষরা রাজপথে নামার-আন্দোলন করার শেষ সামর্থটুকুও হারিয়েছে এই করোনা পরিস্থিতিতে। যদিও বর্তমান সরকারের বক্তব্য হলো- ‘কেউ তো আর না খেয়ে মারা যায় না।’ না খেয়ে মারা যায় না। একথা যেমন সত্য, তেমন সত্য- ‘চাকুরি-ব্যবসা হারিয়ে বাড়ি ভাড়া, সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। সেই সাথে তাদের অপুষ্টি, ডায়াবেটিকসহ দূরারোগ্য ব্যধিতে মৃত্যুর খবরও সরকার রাখে না। সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হচ্ছে- দেশ ভালো চলছে। প্রধানমন্ত্রীও সেই জানানো তথ্যগুলোর আলোকেই গণভবন থেকে করোনার পরিস্থিতির লাইভ তথ্য দিচ্ছেন। ‘সবাই ভালো আছে, দেশ ভালো চলছে’ বলছেন। কিন্তু কতটা ভালো আছে দেশের মানুষ, তা দেখতে পাচ্ছি আমরা যারা রাজনীতির নামে আখের গোছানো নয়; জনগনের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করছি, তারা।
করোনা মহামারির ভয়াবহতা ঠেকাতে ব্যর্থতার দ্বায় এড়াতে আবারো সপ্তাহ খানেক কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেয়ার পর কিভাবে ঢাকায় দিন কাটাবে? এর উত্তর না পেয়ে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে সাধারণ মানুষ। যে যেভাবে পারছে, ছুটছে বাড়ির পথে। আমরা দেখেছি, গত ঈদুল ফিতরে সরকারের বিধিনিষেধ জারি থাকা সত্ত্বেও ঈদ করতে রাজধানী ছেড়েছিল মানুষ। এখন আবার সামনে ঈদুল আজহা। এরই মধ্যে সরকারের লকডাউনের ঘোষণা আসায় ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। অবশ্য ২২ জুন রাজধানীর আশপাশের চার জেলাসহ দেশের সাতটি জেলায় লকডাউন জারি করে সরকার। ওইদিন থেকে বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লার পরিবহন। কিন্তু সরকারের বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করেই বাড়ির উদ্দেশে ছুটছে মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর গাবতলীতে বাড়িফেরা মানুষের ভিড় বাড়তে দেখা গেছে। সরকারের দেওয়া নির্দেশনা অমান্য করে সাধারণ মানুষ যে যেভাবে পারছে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হচ্ছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের মতো গণপরিবহন না চলায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া এসব মানুষের অধিকাংশই শ্রমজীবী। দেশের মানুষ যখন সরকারের কোন সহায়তা তো দূরের কথা, সামাণ্য বাড়ি ভাড়া সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ নিতে পারেনি; তখন আবার গতানুগতিকভাবে এসি রুমে বসে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলছেন, ‘এই লকডাউন এক সপ্তাহের জন্য দেওয়া হবে। পরে প্রয়োজনে তা আরও বাড়ানো হবে। এই লকডাউন বাস্তবায়নের জন্য সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হবে।’ আর আমলাদের সেই চাটুকারি কথা শুনছি; বলা হচ্ছে- ‘এ সময় জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে যানবাহন শুধু চলাচল করতে পারবে। জরুরি কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে কেউ বের হতে পারবেন না। বিস্তারিত আদেশ আজ শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা হবে।’
অবশ্য এর আগে দেশজুড়ে আলোচনা ছিল যে কোনো সময় আসতে পারে ‘শাটডাউন’। আর আলোচনা থেকেই শুরু হয় মানুষের ঢাকা ছাড়ার প্রবণতা। ফলে সকাল থেকেই ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথগুলোয় উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। রাজধানীর সঙ্গে সব ধরনের আন্তঃজেলার গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ থাকায় মানুষ ছুটছেন মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসে করে। অনেকে পায়ে হেঁটে প্রবেশমুখের ব্যারিকেড পার হচ্ছেন। আমিন বাজার ব্রিজ, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর-দাউদকান্দি, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া, মানিকগঞ্জের আরিচায় মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে। এদের বেশির ভাগই ঢাকা ছাড়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়েছেন। তারা সবাই পুলিশের ব্যারিকেডের সম্মুখীন হচ্ছেন। চেকপোস্ট যেখানে তার কিছুটা আগে ও পরে যাত্রীর জন্য চলে প্রাইভেট কার-সিএনজি চালকদের হাঁকডাক। অর্থনৈতিকভাবে ভেঙ্গে পড়া কোটি কোটি মানুষের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা; তখন সরকার যেকোনো দিন ‘শাটডাউন’ ঘোষণা করতে পারে; এই আশঙ্কায় চলাচলে বিধিনিষেধ থাকার পরও মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌপথ এলাকায় ভিড় জমানো ব্যতিত আর কোন উপায় নেই মানুষের। এরই মধ্যে মধ্যবিত্ত-নিন্মবিত্তদেরকে আরো একটু অর্থনৈতিক চাপে রাখার লক্ষ্যে মাঠে নেমেছে পুলিশ-প্রশাসন। বরাবরের মত লোক দেখানোর জন্য শিমুলিয়া ঘাটের প্রবেশমুখে রয়েছে চেকপোস্ট। পুলিশের পক্ষ থেকে যাত্রীদের ঘাটে আসা আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে; আবার টুপাইসের বিনিময়ে ছেড়েও দেয়া হচ্ছে বলে গণমাধ্যমেই সরাসরি দেখানো হচ্ছে।
এই যখন নিজের দেশের অবস্থা; তখন নিজের দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের পাশাপাশি সারাবিশে^র অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের ভূমিকা দেখতে চোখ রাখি গণমাধ্যমে। জানতে পারি যে, জাতির পিতার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শক্তিশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সহ শতাধিক মন্ত্রী-এমপি করোনার ভয়ে ঘর থেকে না বেরুলেও সাপ আর জোঁকে পরিপূর্ণ একের পর এক জঙ্গল ও মাইলের পর মাইল পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে ভুটানের বিভিন্ন প্রান্তে নাগরিকদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন ভুটানের রাজা। তাদের কোভিড মোকাবিলায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করছেন। আবার প্রত্যেকটি এলাকা থেকে ফিরে নিয়ম মেনে রাজধানী থিম্পুর একটি হোটেলে কোয়ারেন্টিনেও থাকছেন ৪১ বছর বয়েসি এই জনবান্ধব রাজা। দুর্গম এলাকাগুলোয় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া কর্মীদের ধন্যবাদ দিতে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতেও ভুটানের রাজা ৫ দিন পাহাড়ি পথে হেঁটেছেন, অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছলদেরকে নিজের তহবিল থেকে দিচ্ছেন আর্থিক সহায়তা।
মাথায় বেসবল ক্যাপ, পরনে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ঐতিহ্যবাহী পোশাক, সঙ্গে পিঠে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে রাজা ছুটে চলছেন মাইলের পর মাইল। সব প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করে ভয়কে দুমড়ে-মুচড়ে তিনি শুধু ভাবছেন নিজ দেশের নাগরিকদের কথা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে ৭ লাখের মতো জনসংখ্যার দেশটিকে রক্ষায় কর্তৃপক্ষ যেসব নির্দেশনা দিয়েছে তার বাস্তবায়ন ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণে গত ১৪ মাস ধরে ভুটানের রাজা এভাবেই পায়ে হেঁটে, গাড়িতে কিংবা কোথাও কোথাও ঘোড়ায় চেপে দেশের এমাথা-ওমাথা চষে বেড়াচ্ছেন। সত্য কথা এটাই যে, জাতি-গোষ্ঠি-ধর্ম-দেশ হিসেব করে নয়; করোনা মহামারি পৃথিবীর চলমান অনেক নিয়মই বদলে দিয়েছে। সংকটের পাশাপাশি সম্ভাবনার দিগন্তও উন্মোচিত করেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রজাবান্ধব রাজার সংখ্যা খুব বেশি না থাকলেও কোনো কোনো রাজা আজও ইতিহাস হয়ে আছেন সুকর্মের জন্য। তেমনি এক রাজা এবার প্রজাদের কথা ভেবে সব ভয়কে তুচ্ছ করে মাঠে নেমেছেন করোনা থেকে দেশবাসীকে মুক্ত রাখতে সতর্কতামূলক প্রচারণা নিয়ে। বলছি, ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিল ওয়াংচুকের কথা। রাজার এ পরিশ্রম বৃথা যায়নি। জনগণ রাজার এই ছুটে যাওয়াকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। সরকারের নির্দেশনার প্রতি তাদের আস্থা আরও বেড়েছে। এখন পর্যন্ত চীন আর ভারতের মাঝে থাকা হিমালয়ের দেশটিতে করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজনের। অন্যদিকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বলছেন, ‘জনগণকে মহামারি নিয়ে সতর্ক করতে রাজা যখন মাইলের পর মাইল সফর করছেন, দরজায় কড়া নাড়ছেন, তখন মানুষও তার কথা গুরুত্বসহকারে নিচ্ছে। জনগণের জন্য নির্দেশনা জারি করার তুলনায় তার উপস্থিতি বেশ শক্তিশালী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে তারা একা নয়, রাজার উপস্থিতি তাদের আশ্বস্ত করছে।’
আমাদের বেলায় ঘটেছে তাঁর ঠিক উল্টো। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ পালনে নিবেদিত থাকার সুযোগে গড়ে তোলা হয়েছিলো ফ্রি এয়ারপোর্ট। বিদেশ থেকে হাজার হাজার আক্রান্ত রোগি এসেছে ১৮ মার্চ পর্যন্ত। পিতার জন্ম শতবর্ষ পালনের দ্বিতীয়দিনে রাষ্ট্রের মনে পড়েছিলো লকডাউন দিতে হবে, সেই লকডাউনে আর যেকারণে আমাদের কোন উপকারই হয়নি। কেননা, যা ক্ষতি হওয়ার, বিদেশী এবং প্রবাসীদের আসার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলো। এরপর আর সেই বাঁধ দিয়ে রাখতে না পারার ব্যর্থতার সাথে যুক্ত হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্বীকৃতি সাহেদ-সাবরিনা কেলেঙ্কারিতে। তারপর আবার টিকা ব্যর্থতা। সব মিলিয়ে এত এত ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে বাজেট নিয়ে দৌড়ঝাপ। মধ্যিখানে আমরা এটা স্পষ্টত বুঝলাম যে, করোনাভাইরাসের অতি বিস্তারের প্রেক্ষাপটে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণেও ব্যর্থ। আর সেই ব্যর্থতা ঢাকতে একবার লকডাউন, একবার কঠোর লকডাউন আবার আনেকবার ঢিলেঢালা লকডাউন নাটকে মত্ত রয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটি দপ্তর। রোজিনা ইসলাম হয়তো এই সব সত্যগুলো উদঘাটনের চেষ্টা করেছিলেন বলেই একগাদা মামলা আর মুচলেকা নিয়ে তাকেও চুপ করিয়ে দিয়েছে। তবে প্রয়োজন ছিলো পরিকল্পিত লকডাউন, ব্যাপক পরীক্ষা, রোগী সনাক্তকরণ, আইসোলেশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং এবং কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা। আন্তরিকতার সাথে এই পদক্ষেপগুলো নিলেই বেঁচে যেতো বাংলাদেশ, বেঁচে যেতো শত শত প্রাণ। গণপরিবহন বন্ধ না রেখে সেনাবাহিনীর টহলের মধ্য দিয়ে কড়াকড়ি ও স্বাস্থ্যবিধি মানানোটাও হতো বুদ্ধিমানের কাজ। যা করতে ব্যর্থ হয়ে আজ জাতির কাঁধের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে লকডাউনের বোঝা। যে বোঝা তারা বইতে পারবে না। কেননা, মুষ্টিমেয় মানুষ শত শত কোটি টাকার মালিক হলেও এদেশে স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমশ সহায়-সম্বল হারিয়ে দারিদ্র সীমার নিচে এসেছে প্রায় ৮ কোটি মানুষ। তাদেরকে খাবার দেয়ার কথা বলা হলেও না দিয়ে করা হয়েছে প্রতারণা বারবার। এই প্রতারণার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে যে যার মত ব্যবসা-চাকুরী করুক, ব্যবস্থা করুন। কেবল স্বাস্থ্যবিধি যেন মেনে চলে এজন্য নতুন সেনাপ্রধানের নেতৃত্বাধীন সেনা সদস্যদেরকে কঠোর অবস্থানে নামার সিদ্ধান্ত দিন। যেহেতু ত্রাণ দিতে পারছেন না, খাদ্য দিতে পারছেন না। সাধারণ মানুষকে কাজ করার, ব্যবসা করার সুযোগ দিন। স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য কেবল সেনা বাহিনী মোতায়েন করুন…
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি।