বৃহস্পতিবর, ২১ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:১১ pm
একজন মাটির মানুষ যিনি বঙ্গবন্ধু হিসেবে বাঙালি জাতির বুকে জন্ম নিয়েছিলেন, সেই খাঁটি মানুষটি তার জন্মের শতবর্ষ পরেও স্বমহিমায় এ জাতির তরুণ প্রজন্মের মাঝে এক আদর্শ হয়ে বেঁচে আছেন। আমরা তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করি। কিন্তু বিভিন্ন সময় আমাদের দিকে একটা অন্ধকার ইতিহাস ছুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা তরুণরা একটা দীর্ঘ সময় সেই ছুঁড়ে দেওয়া অন্ধকারে ডুবে ছিলাম।
কিন্তু দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকের মত স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর সঠিক ইতিহাস আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মাঝে চিকচিক করে জ্বলে উঠেছে। যেমনটি আহমদ ছফা বলেছিলেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবুর রহমান একটি যমজ শব্দ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। এই সত্য যারা অস্বীকার করবে, তাদের সঙ্গে কোনরকম বিতর্ক, বাদ প্রতিবাদ করতেও আমরা রাজি হবো না। যদি কিংবা কিন্তু দিয়ে ইতিহাস হয় না। সত্যিকার ইতিহাস হলো যা ঘটেছে তার সঠিক বিবরণ।
ঘটনা পবিত্র কিংবা তার ব্যাখা নানারকম হতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান নাম এমন অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে পরেছে, যত পন্ডিত হোন না কেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণর নিপুণতা এবং যুক্তির মারপ্যাঁচ দেখিয়ে কোনো ব্যক্তি একটা থেকে আর একটাকে পৃথক করতে পারবেন না। আবুল ফজল চট্টগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ‘শেখ মুজিব: তাকে যেমন দেখেছি’ নামে একটা বই প্রকাশ করেছিলেন। আবুল ফজল লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের তিনি শুধু নির্মাতা নন, প্রধান নায়কও। ঘটনাপ্রবাহ এবং নিয়তি তাকে বার বার এ নায়কের আসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলা যায়, যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। শত চেষ্টা করেও তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ইতিহাস দেয় না তেমন কিছু করতে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ নিজে করেনা ছেদন। শেখ মুজিবুর রহমান তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশে শুধু নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও। কারণ ইতিহাস অখন্ড। সুনামে-দুর্নামে, অসাধারণ সাফল্য ও শোচনীয় ব্যর্থতার জন্য ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।’ আজ আমরা জানি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একটি অভিন্ন ইতিহাস।
ইচ্ছে করলেই কখনো কেউ আলাদা করতে পারবে না। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু এক অবিস্মরণীয় নাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর আজীবন লড়াই-সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট আর কারাভোগের ফলেই আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন দেশ। তিনি ছোট বড় সকলের কাছে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব, চিরস্মরণীয় এবং বরণীয়। ১৯৫০ সালে ফরিদপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব একটা পত্র লিখলেন সোহরাওয়ার্দী বরাবর, ‘আমাকে ফরিদপুর জেল থেকে গোপালগঞ্জ হাজিরা দিতে হয়। যেতে সময় লাগে ৬০ ঘন্টা। আর গোপালগঞ্জ থেকে টুঙ্গিপাড়া যেতে হয় হেঁটে ৫ ঘন্টা, আর নৌকায় আরো বেশি সময় লাগে।’
টুঙ্গিপাড়া তখন অজপাড়া গাঁ। রাস্তাঘাট নেই, শুধু জলের মতো ছড়ানো খালের মাঝে একটা নদী, নাম মধুমতি। কাটাগাঙ দিয়ে স্টিমার চলতো। স্টিমার করেই খুলনা এবং সেখান থেকে কলকাতা। স্টিমারেই তিনি যেতেন ঢাকা। ১৯২০ সালে এই গ্রামেই ঢেউটিনের চৌচালা ঘরে ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।মুনতাসীর মামুন ‘বাঙালির মন ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ শিরোনামে লিখেছেন,”বিবিসি বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত ২০ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা প্রকাশ করেছে।
গত বিশ দিনের কাউন্টডাউনে প্রথমে মানুষজন তেমন আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু সপ্তাহখানেক যেতে না যেতে খবরের কাগজের পাঠক ও বিবিসি শ্রোতারা আগ্রহী হয়ে উঠে। দশ নম্বর পেরুতেই এরপর কার নাম আসবে সে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। নববর্ষের একদিন আগে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই নাম্বারে আছেন। তখন আর কারো মনে সন্দেহ থাকেনি যে, বাঙ্গালির প্রিয় উৎসব, পহেলা বৈশাখে, নববর্ষের দিন প্রচারিত হবে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’ বা রাজনীতির কবি, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। এবং তাই হলো বুধবার।’
বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাঙালির শ্রেষ্ঠতম নেতা। বাঙ্গালির সম্মিলিত চেতনা সঞ্চারে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। গণতান্ত্রিক, মূল্যচেতনা, শোষণমুক্তির আকাক্সক্ষা এবং অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এই ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যই বঙ্গবন্ধুর মূল কথা।এই মূলমন্ত্রকে তিনি সঞ্চারিত করেছেন বাঙালির চেতনায়। এভাবেই, ইতিহাসের অনিবার্য দাবিতে, তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন বাঙালি ও এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা ও সাহসের পাশাপাশি একটা হৃদয়ও ছিল। তিনি ভালোবাসতে জানতেন। বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন। তিনি বলতেন,’ সাত কোটি মানুষের ভালোবাসার কাঙাল আমি, আমি সব হারাতে পারি, বাঙালির ভালোবাসা হারাতে পারিনা।’ সাধারণ বাঙালির সব বৈশিষ্ট্যই তিনি ধারণ করেছিলেন কিন্তু অসাধারণ ছিল মানুষ ও দেশের প্রতি ভালোবাসা। তিনি বলতেন,’ আমার শক্তি এই যে, আমি মানুষকে ভালোবাসি। আসার দুর্বলতা এই যে, আমি তাদের খুব ভালোবাসি।’
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচায়, আমার দেখা নয়া চীন বইগুলো থেকে আমরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিশেষভাবে জানতে পারি। “বন্ধুবান্ধবরা বলে,’তোমার জীবনি লেখো। সহকর্মীরা বলে, রাজনৈতিক ঘটনাগুলো লিখে রাখো, কাজে লাগবে। আমার সহধর্মিণী একদির জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছো, লেখ তোমার জীবন কাহিনি। – বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬-১৯৬৯ সালে কারাবন্দী অবস্থায় নিজের জীবনের ঘটনা চারটি খাতায় লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সেই লেখাগুলি নিয়েই প্রকাশিত হয় ‘অসমাপ্ত আত্বজীবনী’। কারাগারের রোজনামচা বঙ্গবন্ধুর আরেকটি দূরদর্শী লেখা। বঙ্গবন্ধু লিখেন,’বাংলাদেশ শুধু কিছু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করলো। আমরা সাধারণত মীর জাফর আলি খাঁর কথাই বলে থাকি। কিন্তু এর পূর্বেও ১৫৭৬ সালে বাংলার স্বাধীন রাজা ছিল দাউদ কারানী। দাউদ কারানীর উজির শ্রীহরি বিক্রম-আদিত্য এবং সেনাপতি কাদলু লোহানী বেঈমানি করে। সূত্র : এফএনএস