শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:২৫ pm
নিজস্ব প্রতিবেদক : মহল্লার বাসিন্দারা হঠাৎ করে স্যালাইন আর ওষুধ কিনতে ছুটছেন। মহল্লার দোকানগুলোতে হঠাৎ চিড়ার চাহিদাও বেড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে মহল্লাবাসী এসব কিনছেন। শুক্রবার সকাল থেকে দুটি মহল্লার কোন দোকানে আর স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছিল না। মহল্লা দুটির প্রায় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
রাজশাহী মহানগরীর ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ফিরোজাবাদ ও মিলপাড়া মহল্লার বাড়িতে বাড়িতে এখন ডায়রিয়া রোগী। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। পাতলা পায়খানার পাশাপাশি তাঁরা বমিও করছেন। এতে সবাই কাহিল হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ বিছানা থেকেও উঠতে পারছেন না। তবে প্রায় সবাই বাড়িতে ওষুধ আর স্যালাইন খেয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দু’একজনকে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়েছে। আক্রান্তরা বলছেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে মহল্লায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
শুক্রবার সকালে মিলপাড়া মহল্লার কিসমত আলীর দোকানে স্যালাইন নিতে আসেন স্থানীয় এক বাড়ির ভাড়াটিয়া রোখসানা খাতুন (২০)। তিনি বলেন, ডায়রিয়া শুরু হওয়ায় রাতে ১০টি স্যালাইনের প্যাকেট নিয়ে গিয়ে খেয়েছেন। সকালে আবার নিতে এসেছেন। রোখসানা বলেন, রাত থেকে তাঁর পাতলা পায়খানা বন্ধ হচ্ছে না। বাড়িতে বিছানায় শুয়ে ছিলেন মহল্লার বাসিন্দা জনিকা বেগম (২৮)। তিনি জানান, মহল্লার শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাত থেকে তাঁরও ডায়রিয়া।
জনিকার পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া আল-ফারুক। তাঁর স্ত্রী রেশমি খাতুন ও তাঁর দুইন সন্তান ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। রেশমির পাশের বাড়ি মকবুল হোসেনের। মকবুলের স্ত্রী মরিয়ম বেগম ছাড়া সবাই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। রুবি বলেন, ‘আমরা সামলে নিতে পারছি। কিন্তু ছোট মেয়েটা পারছে না। ওষুধ, স্যালাইনে কাজ হচ্ছে না বলে ফার্মেসিতে নিয়ে গিয়ে ইনজেকশন করালাম। মেয়েটা আমার একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছে।’
মকবুলের বাড়ির সামনের বাড়ি টিনা বেগম দাঁড়িয়ে ছিলেন। ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর ১০ বছরের মেয়ে নেহা খাতুনকে দেখালেন। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নেহা বিছানায় শুয়ে ছিল। রুবির বোন রুনা কোলের দেড় বছরের শিশু আলভি খাতুনকে দেখিয়ে বললেন, এই মেয়েটিও আক্রান্ত।
মিলপাড়ার আরাফাত হোসেনের (১৭) অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মহল্লার বাসিন্দা স্বপনের (৪০) বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, তিনি বারান্দার মেঝেতে শুয়ে আছেন। পাশে তাঁর চার বছরের ছেলে শাহনেওয়াজ বসে। স্বপনের স্ত্রী জুলেখা বেগম (৩০) জানালেন, তাঁরা তিনজনই আক্রান্ত। ছেলেটা প্যান্ট খোলার সময় দিচ্ছে না। তাই তাঁকে একটা পুরাতন কাপড় জড়িয়ে রাখা হয়েছে। একটু পর পর সে পাতলা পায়খানা করছে।
স্বপন জানান, তিনি নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে চাকরি করেন। সকালে ডিউটিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। একটু পর পর পাতলা পায়খানা হয়েছে। তাই বাড়ি চলে এসেছেন। পরিবারের তিনজন আক্রান্ত হওয়ায় তাঁদের দেখাশোনার কেউ নেই। তাই শ^াশুড়িকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মহল্লার মকবুল হোসেনের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর পূত্রবধূ তাহমিনা খাতুন বলেন, ‘ডায়রিয়ায় অবস্থা খুবই কাহিল। আব্বা উঠতে পারছেন না।’
মহল্লার বাসিন্দা রওশনারা বেগম জানালেন, তাঁর মেয়ে রিচা মনিও আক্রান্ত। রাত থেকে ছয়টি স্যালাইন খাইয়েছেন। প্রতিবেশিরা জানালেন, ‘এই মহল্লার দুলু বেগমের বাড়িতেও তিনজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। দুলু বেগমের বাড়ি গেলে বলেন, ‘এসব লিখে কি হবেব? দু’পাঁচ হাজার টাকা কি পাওয়া যাবে? না পেলে লেখার দরকার নাই। নাম লিখে তখন আবার কী হয় না হয়!’ এ সময় মহল্লার আরও দু’একজন এসে তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামও কেটে দেয়ার অনুরোধ করেন।
ফিরোজাবাদ মহল্লায় ঢুকতেই জুলফিকার রহমানের মুদি দোকান। জুলফিকার বলেন, ‘কয়জনের নাম লিখবেন? গোটা পাড়ার লোক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। দোকানে স্যালাইন যা ছিল সব শেষ। সকাল থেকে দু কেজি চিড়াও বিক্রি করলাম।’ জুলফিকারের দোকানে স্যালাইন কিনতে এসে এই প্রতিবেদককে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন মনোয়ারা বেগম (৫৫)। দেখালেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর জামাতা এমএকে ফেরদৌস শুয়ে আছেন। ফেরদৌসের স্ত্রী কনা আক্তার তখন নিজের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসকে (৯) নিয়ে শৌচাগারে গেছেন। বেরিয়ে এসে বললেন, ‘আমরা তিনজনই আক্রান্ত। দু’পাঁচ মিনিট পর পর পাতলা পায়খানা। কেউ দাঁড়াতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছোট মেয়েটা তো বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যাওয়ার মত সময় পাচ্ছে না। সে জন্য বিছানার নিচে প্লাস্টিকের গামলা রেখেছি।’ মনোয়ার বেগম বলেন, ‘কারও হাত শুকাচ্ছে না। একবার বাথরুমে থেকে আরেকবার যেতে হচ্ছে।’
মনোয়ারা বেগমের সামনের বাড়ি লিটন হোসেনের। তাঁর স্ত্রী নারগিস বেগম জানালেন, তাঁর স্বামী আর দুই শিশু সন্তান ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। একটু পর পর তাঁরা বাথরুমে যাচ্ছেন। মহল্লার দোকানে স্যালাইন ফুরিয়ে যাওয়ায় একটু দূরে ফার্মেসি থেকে এনেছেন। তিনজনের জন্য দুটি ডাব কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটা ডাবের দামই চাওয়া হয়েছে ৮০ টাকা। এত দামে ডাব কিনতে পারেননি। এই মহল্লার সীমা বেগম জানালেন, তাঁর পরিবারের দুইজন আক্রান্ত। রোজি বেগম বললেন, তাঁরও বাড়িতে একজন ডায়রিয়ার রোগী। এ রকম মহল্লার সব বাড়িতে বাড়িতে ডায়রিয়ার রোগী। ডায়রিয়ার জীবাণু থেকে এখন আরও ব্যাপকহারে অন্যদের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়ে কিনা সেই আশঙ্কায় রয়েছেন দুটি মহল্লার মানুষ।
মহল্লা দুটির পাশেই শাহমখদুম থানা মোড়। মোড়ের রাজীব ফার্মেসীর মালিক রাজিব হোসেন বলেন, রাত থেকে স্যালাইনের প্রচুর চাহিদা। ওষুধও বিক্রি হচ্ছে। সকালেও কয়েকজন নিয়ে গেলেন। যাঁদের অবস্থা বেশি খারাপ তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কী কারণে লোকজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন তা তিনি জানেন না বলেও জানান ফার্মেসী মালিক।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এএফএম আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। মহল্লায় একজন চিকিৎসক পাঠানো হয়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্যালাইনও পাঠানো হয়েছে। আক্রান্তদের বিনামূল্যে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ‘ফুড পয়জনিং হতে পারে। এখন তো গরম, খাবার কখন রান্না হয়েছে সেটি দেখার বিষয়।’ সিভিল সার্জন বলেন, আক্রান্তরা এখন খাওয়ার স্যালাইন খাবে। বেশি অসুস্থ বোধ করলে অবশ্যই হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হবে। আজকের তানোর