বৃহস্পতিবর, ২১ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:০৮ pm
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তাকে তন্দ্রা স্পর্শ করতে পারে না। আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তার কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে বা পিছনে যা কিছু রয়েছে, তিনি তার সবই জানেন। তাঁর জ্ঞান-সীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না-তবে যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর আসন (সার্বভৌম ক্ষমতা) সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনি সর্বোচ্চ ও সর্বাপেক্ষা মহান। (সুরা বাকারা, আয়াত ২৫৪)।
তিনি আরও বলেছেন, পুণ্যময় তিনি, যার হাতে রাজত্ব বা সর্বময় ক্ষমতা। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান, যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমতাময়। তিনি সপ্তম আকাশকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিতে কোনো খুঁত দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফিরাও, কোনো ভ্রান্তি দেখতে পাও কি? অতপর তুমি বার বার তাকিয়ে দেখ, তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকেই ফিরে আসবে। (সুরা মুলক, আয়াত ১-৪)।
পবিত্র কোরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। আর তাঁর কোনো সমকক্ষও নেই। (সুরা ইখলাস, ১-৪)
আল্লাহ; তিনি অমর, অজয়, অক্ষয়। তিনি রিজিক দেন। সমগ্ৰ বিশ্ব জাহানের ওপর তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি ‘আস-সামাদ’। অর্থাৎ তিনিই একমাত্র সত্তা যিনি অমুখাপেক্ষিতার গুণাবলীর সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত। আবার যেহেতু তিনি ‘আস-সামাদ’ তাই তার একাকি ও স্বজনবিহীন হওয়া অপরিহার্য। কারণ এ ধরনের সত্তা একজনই হতে পারেন, যিনি কারো কাছে নিজের অভাব পূরণের জন্য হাত পাতেন না, বরং সবাই নিজেদের অভাব পূরণের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী হয়।
মহান আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে মানুষের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো তাঁর স্রষ্টার পরিচয় জানা। আর আল্লাহর পরিচয় লাভের ওপর নির্ভর করছে ব্যক্তির ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্য। এই সাফল্যের কথাই ব্যক্ত হয়েছে মহানবী (সা.)-এর হাদিসে। তিনি বলেন, ‘যে এমন অবস্থায় মারা গেল যে সে জানে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬)।
পৃথিবীতে আল্লাহর পরিচয় লাভের নানা উপায় ও উপলক্ষ আছে। যেমন—কোরআন ও সুন্নাহ পাঠ, আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছেন এমন ব্যক্তিদের সান্নিধ্য ইত্যাদি। এর মধ্যে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। কেননা এই পদ্ধতি যেকোনো মানুষের পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব।
যারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এটা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র, আপনি আমাদেরকে অগ্নিশাস্তি থেকে রক্ষা করুন। (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৯১)।
বান্দার সাথে তার রবের সম্পর্কই হলো বান্দার সফলতার মাপকাঠি। আর নিজ প্রতিপালক আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও ভালোবাসার ভিত্তি হলো আল্লাহকে চিনতে পারা। তাই মানবজাতির সবচেয়ে বড় কল্যাণকামিতা হলো মানুষকে তার মালিক আল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। সেই সফল ব্যক্তি যে মানুষকে আল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং নিজে তাঁর গোলামী ও দাসত্ব করে।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘জেনে রেখো! আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। ক্ষমা প্রার্থনা করো তোমার এবং মুমিন নর-নারীদের ত্রুটির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস্থান সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত ১৯)।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যা লেখেন, ‘আল্লাহর একত্ববাদের জ্ঞান লাভ করা একটি স্বতন্ত্র ও সত্তাগত আদিষ্ট বিষয়। যদিও এটা মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে এক আল্লাহর ইবাদত করাও অপরিহার্য। উভয় বিষয়ে বান্দা আদিষ্ট।
আল্লাহর পরিচয় লাভের অর্থ হলো তাঁর নাম, গুণাবলি, কাজ ও বিধান সম্পর্কে জানা। ইবাদতের অর্থ হলো নির্দেশ ও নির্দেশনা মোতাবেক ইবাদত করা। ’ (মিফতাহু দারুস সাআদাহ : ১/১৭৮)।
যেহেতু বান্দার মুক্তি ও সাফল্য আল্লাহর পরিচয় লাভের ওপর নির্ভর করে, তাই সব নবী ও রাসুল (আ.) মানুষকে আল্লাহর পরিচয় দান করেছেন এবং তাদের পরিচয় লাভের পথে আহ্বান করেছেন। বিশেষত মহানবী (সা.) এই আহ্বান জানিয়েছেন। আল্লামা আবুল হাসান আশআরি (রহ.) বলেন, ‘আলেমরা এ বিষয়ে একমত যে নবী (সা.) সমগ্র সৃষ্টি জগতে আল্লাহর পরিচয় লাভের আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক।’ (সুরা আনফাল, আয়াত ৪০)।
আল্লাহ একটি আরবি শব্দ। এ শব্দটি এমন এক সত্তার জন্যে নির্ধারিত, যিনি অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের অধিকারী, যিনি যাবতীয় পবিত্রতা, পরিপূর্ণতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার গুণাবলীতে ভূষিত এবং সকল প্রকার অসম্পূর্ণতা, অপবিত্রতা ও যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। তিনিই হলেন আল্লাহ। সর্বময় ক্ষমতার মালিক ও শক্তির একক আধার। আল্লাহকে জানবার অসংখ্য পন্থা তার সৃষ্টিজগতে উপস্থিত রয়েছে। বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টির মাঝেই মূলত আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বের নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে। তবে পবিত্র কোরআন আল্লাহর পরিচয় জানার সর্বোত্তম মাধ্যম।
আল্লাহ শব্দটি সৃষ্টিকর্তার আসল নাম। বাকি সব নাম গুণবাচক। আল্লাহ শব্দটি একমাত্র মুসলমানরাই ব্যবহার করে থাকেন। এই আল্লাহ শব্দটির মধ্যে অনেক তথ্য, অনেক হেকমত ও কারিশমা লুকায়িত আছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ শব্দটি ২৬৮৪ বারের বেশি স্থানে এসেছে। আল্লাহর পরিচয় সংক্রান্ত একমাত্র পবিত্র কোরআনের সুরা হচ্ছে সুরা ইখলাছ।
অনুবাদঃ (হে রাসুল আপনি) বলুন তিনিই আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। আর তার সমতুল্য কেউ নেই।
আল্লাহর সমকক্ষ মর্যাদায় মর্যাদাবান আর কেউ নেই। এক্ষেত্রে তিনি একক, অনন্য। তার সমকক্ষ ও সমতুল্য কেউ নেই এবং থাকতে পারে না। তিনি তার সত্তা, গুণাবলি ও কার্যাবলির ব্যাপারে এক কথায় সর্বদিক থেকে একক, অনন্য ও অদ্বিতীয়। তাই তিনি শিরক থেকে যেমন পবিত্র, তেমনি মুক্ত ও পবিত্র সৃষ্টির সাথে যাবতীয় সাদৃশ্যতা থেকে। বিশ্বজগতের তিনিই একমাত্র স্রষ্টা, তিনিই একমাত্র অবশ্যম্ভাবী সত্তা (ওয়াজিবুল ওজুদ)। যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর সাথে সাদৃশ্য থেকে তিনি পবিত্র। মোটকথা, গোটা সৃষ্টিজগতের কেউ কোনো দিক থেকে তাঁর মতো নয়। তাঁর সাথে কারোই যেমন কোনো প্রকার তুলনা হয় না, তদ্রুপ কোনো কিছুর সাথে তাঁরও সামান্যতম তুলনা বা সাদৃশ্য নেই। আল্লাহ তাআল আহাদ তথা একক ও অনন্য হওয়ার প্রকৃত অর্থ এটাই। তাঁর সম্পর্কে এরূপ আকিদা বিশ্বাস পোষণ করাকেই ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় তাওহীদ। আর এটাই ইসলামের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি। আল্লাহ কোনো বস্তু নন এবং তাঁর গুণরাজি শুধু তাঁরই জন্য। তাঁর কোনো গুণই অপর কারো মধ্যে কল্পনা করা যায় না।
রাসুলকে (সা.) হজরত আবু যর (রা.) জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি তাঁর রব্বকে দেখেছেন কিনা। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) জবাবে বলেছেন, আমি কীভাবে তাঁকে দেখতে পারি? আমি তো একটি নূর দেখেছি মাত্র। (মুসলিম ও বুখারী)।
আল্লাহ কোথায় আছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজেই বলছেন- পরম করুণাময় আরশের উপর সমাসীন আছেন। (সুরা তাহা, আয়াত ৫)
অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, আর তিনিই আল্লাহ যিনি আসমানে আছেন। (সুরা আনআম, আয়াত ৩)
আয়াত থেকে জানা যায়, আল্লাহ আসমানে আছেন। তার আরশ আসমানে। কোরআনে এ-ও বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালার ‘কুরসি’, যেখানে তিনি সমাসীন আছেন, তা আসমান ও জমিনব্যাপী বিস্তৃত। আল্লাহতায়ালা যে আসমানে আছেন, এর সমর্থনে আরো একটি আয়াত পাওয়া যায়, সুরা নাহলে আল্লাহতায়লা ইরশাদ করেন, তারা তাদের উপরের প্রতিপালককে ভয় করে। (সুরা নাহল, আয়াত ৫০)
আল্লাহতায়ালা যে আসমানে আছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাসুলের (সা.) অনেক বাণী ও সাহাবীদের উক্তি থেকেও। রাসুলকে (সা.) আল্লাহ সপ্তম আকাশের উপরে উঠিয়ে নিয়েছিলেন মেরাজের উদ্দেশ্যে। সেখানেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছিল। (বুখারী ও মুসলিম)
এক হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন, যারা জমিনে আছে তাদের প্রতি দয়া করো, তবে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। [তিরমিযি]
আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তোমরা তার প্রতি লক্ষ্য করো।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত ১০১)।
মহান আল্লাহ সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ব্যতিক্রমী এক সত্তা। পৃথিবীর কোন কিছুর সঙ্গে তাকে তুলনা করা বোকামি। চরম মুর্খতা। কেননা তিনি সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। কেউ তাকে সৃষ্টি করেননি।
আল্লাহর কুদরতি হাত আছে। সেটা আমাদের হাতের মত নয়। অন্য কোনো মাখলুকের মত নয়। আল্লাহর কুদরতি পা আছে। সেটা আমাদের পায়ের মত নয়। অন্য কোন মাখলুকর মত নয়। আল্লাহর কুদরতি চোখ আছে। সেটা আমাদের চোখের মত নয়। অন্য কোন মাখলুকের মত নয়। আল্লাহর কুদরতি সবকিছু আছে। তবে সেটা কোন সৃষ্টির মত নয়। আল্লাহতাআলা ঠিক তার মত। এটা আমাদের মস্তিষ্কে ধারণ ক্ষমতার বাইরে।
মহান আল্লাহর প্রধান সত্তা সূচক গুণ হলো হায়াত, ইলম, ইচ্ছা, কুদরত, শ্রবণ, দৃষ্টি, কালাম, তাকভীন।
হায়াত আল্লাহর একটি বড় সিফাত। শব্দটির অর্থ হচ্ছে চিরন্তন, চিরঞ্জীব। তিনি সর্বত্র আছেন। থাকবেন। তিনি কখনো বিলীন হবেন না। তিনি সবাইকে জীবন দান করেন।
ইলম আল্লাহর একটি বড় গুণ। শব্দটির অর্থ হচ্ছে জ্ঞান । আল্লাহতাআলা সর্বজ্ঞানী। সর্ব বিষয়ে তার জ্ঞান সমভাবে পরিব্যপ্ত। তার কাছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোনো পার্থক্য নেই। পৃথিবীর সমস্ত কিছু তার জ্ঞানের বাইরে নয়। আল্লাহতাআলা কোন কিছুর ইচ্ছা প্রকাশ করলে শুধু বলেন কুন। অর্থাৎ হয়ে যাও। সঙ্গে সঙ্গে তাই হয়ে যায়।
কুদরত আল্লাহর পাওয়ারফুল একটি গুণ। এই পৃথিবীতে যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে এবং আগামীতে হবে সব আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরতে। মানুষ যদি কোন বস্তুর মধ্যে কোন পাওয়ার দেখে তাহলে সেটা তার নিজস্ব নয়। সেটা আল্লাহর কুদরতে হচ্ছে।
আল্লাহর আর একটি গুণ হলো তিনি সর্বশ্রোতা। মানুষ আস্তে এবং জোরে প্রকাশ্য এবং গোপনে যে কথাবার্তা বলে তিনি সবকিছু শোনেন। এমনকি আকাশের উপর, সমুদ্রের নিচে যদি কেউ কোন কিছু বলে বা কোন প্রাণী কোন আওয়াজ করে তিনি তবুও শুনতে পান।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সৃষ্টির সবকিছু দেখেন। কোন কিছুই তার দৃষ্টির আড়ালে নয়। এমনকি যদি অন্ধকারের মধ্যে কোন পিপীলিকা হেঁটে যায় তিনি তার পায়ের ছাপ দেখতে পান এবং শব্দ শুনতে পান।
কালাম মানে হচ্ছে কথা। এই বিশ্বজগত সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য তিনি যে বিধিনিষেধ দিয়েছেন। হুকুম আহকাম নির্ধারণ করেছেন এসব কিছু কালামের মধ্যে আছে। আর কালাম হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল কারীম।
তাকভীন মানে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা। আসমান জমিন, গ্রহ নক্ষত্র, আরশ-কুরছি, লৌহ-কলম, পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষলতা, সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি। এসব সৃষ্টি করতে তিনি কারও কোনো পরামর্শ বা সাহায্য নেননি। এইসব তিনি ধ্বংস করে আবার সৃষ্টি করতে সক্ষম । উল্লেখিত গুণগুলো ছাড়াও যত রকম সিফাত হতে পারে সবগুলো একমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্য প্রযোজ্য হবে।
আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি জগতে দান করেছেন অসংখ্য নিদর্শন। মানুষ চিন্তা, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার মহান স্রষ্টার পরিচয় লাভ করবে। আল্লাহ বলেন, ‘পৃথিবীতে রয়েছে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী। (সুরা জারিয়াত, আয়াত ২০)।
বিশাল সৃষ্টিজগতে আল্লাহর নিদর্শনের অনুসন্ধান কিভাবে শুরু হবে তাও বলে দিয়েছেন রাব্বুল আলামিন। বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে না?’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ২১)। ইমাম তাবারি (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘মানুষের দেহে আল্লাহর অনেক নিদর্শন রয়েছে। চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, হৃৎপিণ্ডসহ মানুষের প্রতিটি অঙ্গই আল্লাহর বিস্ময়কর নিদর্শন। এ ছাড়া মানুষের সৃষ্টি ও জন্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও আল্লাহর পরিচয় লাভ করা সম্ভব। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁর নিদর্শন হলো তিনি তোমাদের মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তারপর তোমরা মানুষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছ। ’ (সুরা রুম, আয়াত ২০)
এরপর মানুষ তার চারপাশের প্রাণী, পরিবেশ ও প্রকৃতিতে আল্লাহর নিদর্শন অনুসন্ধান করবে। প্রাণী ও প্রকৃতির সৃষ্টি-নিপুণতা ও শৃঙ্খলা আল্লাহর অস্তিত্ব ও অসীম ক্ষমতারই সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি উটের প্রতি লক্ষ করে না তা কিভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে? এবং আসমানের দিকে, কিভাবে তা ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে? পাহাড়ের দিকে, কিভাবে তা স্থাপন করা হয়েছে? আর ভূ-তলে দিকে, কিভাবে বিস্তৃত করা হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়াহ, আয়াত : ১৭-২০)।
নিদর্শন দেখে যারা তার স্রষ্টার পরিচয় বুঝতে পারে না, তাদের জন্য আল্লাহ নিজের পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন, ‘আল্লাহ আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দিয়ে ভূমিকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। যে সম্প্রদায় কথা শোনে এতে তাদের জন্য রয়েছে নিদর্শন। ’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৬৫)।
পুরো জগত থাকবে মহান আল্লাহর হাতের মুষ্টিতে। অথচ অবিশ্বাসীরা আল্লাহকে মর্যাদা দেয়নি। আল্লাহ বলেন, আর তারা আল্লাহকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি। অথচ কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবীই থাকবে তাঁর মুষ্টিতে এবং আকাশসমূহ তাঁর ডান হাতে ভাঁজ করা থাকবে। তিনি পবিত্র, তারা যাদেরকে শরীক করে তিনি তাদের ঊর্ধ্বে। (সুরা যুমার, আয়াত ৬৭)।
জমিন আল্লাহতাআলার হাতের মুঠিতে থাকা এবং আসমান ডান হাতে পেচানো থাকার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সঠিক মর্যাদা, বড়ত্ব ও সম্মান সম্পর্কে মানুষকে কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়েছে।
কেয়ামতের দিন সব মানুষ (যারা আজ আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্বের অনুমান করতেও অক্ষম) নিজ চোখে দেখতে পাবে জমিন ও আসমান আল্লাহর হাতে একটা নগণ্যতম বল ও ছোট একটি রুমালের মত। হাদিসে এসেছে, একবার নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে উঠে খুতবা দিচ্ছিলেন। খুতবা দানের সময় তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন এবং বললেন- ‘আল্লাহ তাআলা আসমান ও জমিনকে (অর্থাৎ গ্রহসমূহকে) তাঁর মুষ্ঠির মধ্যে নিয়ে এমনভাবে ঘুরাবেন যেমন শিশুরা বল ঘুরিয়ে থাকে এবং বলবেন- আমি একমাত্র আল্লাহ। আমি বাদশাহ। আমি সর্বশক্তিমান। আমি বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের মালিক। কোথায় পৃথিবীর বাদশাহ? কোথায় শক্তিমানরা? কোথায় অহংকারীরা? এভাবে বলতে বলতে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে কাঁপতে থাকলেন যে, তিনি মিম্বারসহ পড়ে না যান আমাদের সে ভয় হতে লাগলো।’ (মুসলিম)।
অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতাআলা জমিনকে মুষ্ঠিবদ্ধ করবেন। আর আসমানসমূহকে ডানহাতে গুটিয়ে রাখবেন তারপর বলবেন; আমিই বাদশাহ! কোথায় দুনিয়ার বাদশাহরা?’ (বুখারি)।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কেয়ামতের দিন সব জমিন থাকবে তাঁর হাতের মুঠিতে এবং আসমানসমূহ থাকবে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে।’ সেদিন ঈমানদারগণ কোথায় থাকবে? তিনি বললেন- হে আয়েশা! সিরাতের (পুলসিরাতের) উপরে থাকবে।’ (তিরমিজি)।
সর্বশেষ আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিবসে বান্দাদের মধ্যে ন্যায় বিচারভিত্তিক ফয়সালা করবেন। যাতে আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য এবং গুণাবলী সন্নিবেশিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, আর আপনি ফেরেশতাদেরকে দেখতে পাবেন যে, তারা আরশের চারপাশে ঘিরে তাদের রবের সপ্ৰশংস পবিৎৰতা ও মহিমা ঘোষণা করছে। আর তাদের মধ্যে বিচার করা হবে ন্যায়ের সাথে এবং বলা হবে, সকল প্ৰশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর প্রাপ্য।(সুরা যুমার , আয়াত ৭৫)
আল্লাহর রহমত পেতে দেরি করা মোটেই ঠিক হবে না। কারণ দেরি করে ফেললে ক্ষমা না ও হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন, আর তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তোমাদের উপর আযাব আসার পূর্বেই তার কাছে আত্মসমর্পণ কর। তার (আযাব আসার) পরে তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না। (সুরা যুমার, আয়াত ৫৪) আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তোমরা তার প্রতি লক্ষ্য করো। ’ (সুরা ইউনুস, আয়াত ১০১)।
কোরআনে কারিমের আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মনে রেখো, যারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে। যারা ঈমান এনেছে এবং ভয় করে, তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনও হেরফের হয় না। এটাই হলো- মহাসফলতা। (সুরা ইউনুস, আয়াত ৬২-৬৪)।
আল্লাহতাআলা নবিজীকে উদ্দেশ্য করে তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দেন এবং কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার আহ্বান জানান এভাবে, বরং আপনি আল্লাহরই ইবাদাত করুন এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হোন। (সুরা যুমার, আয়াত ৬৬)।
বান্দার মুক্তি ও সাফল্য আল্লাহর পরিচয় লাভের ওপর নির্ভর করে, তাই সব নবী ও রাসুল (আ.) মানুষকে আল্লাহর পরিচয় দান করেছেন এবং তাদের পরিচয় লাভের পথে আহ্বান করেছেন।
আর যারা আল্লাহ ও তাঁর পরিচয় লাভের ব্যাপারে বিমুখ থাকে, তাদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, বলো, আমি কি তোমাদের সংবাদ দেব কর্মে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্তদের? তারা হলো সেসব মানুষ, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পণ্ড হয়, যদিও তারা মনে করে যে তারা সৎকাজই করছে। (সুরা কাহাফ, আয়াত ১০৩-১০৪)।
পবিত্র কোরআনে কমপক্ষে তিন শ আয়াতে আল্লাহর পরিচয় লাভ ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর পরিচয় লাভের উপায়ই ইহকাল ও পরকালে সাফল্য। এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত ১৯)। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা যেন উপরোক্ত আলোচনা গুলোর প্রতি গুরুত্ব সহকারে বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন আমিন।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট। রা/অ