সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:১৫ am
লাবণ্য, প্রভা, ফারিয়া, রানী ক্লিউপেট্রা বেশ রাজকীয় ভাব নিয়ে চলাফেরা করছে। তবে রাজার মেজাজমর্জি বেশি সুবিধার না। ফাল্গুন মাসে জন্ম নেওয়া ফাল্গুনী পানিতে ডুব দিয়ে মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল, আওয়াজ শুনে মাথা উঁচু করে একটু দেখে পাত্তা না দিয়ে আবার ডুব দিয়ে খাওয়া শুরু করল। রাজা বাহাদুর আর সুন্দরী দুই পা তুলে সালাম দেওয়া শিখেছে। ফুটবল খেলাটাও বেশ ভালোই রপ্ত করেছে। বাস্কেটবল খেলাটা শিখতেও বেশি দিন লাগবে না।
গত মঙ্গলবার এদের সঙ্গে দেখা হলো বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায়। লাবণ্য, প্রভা, ফারিয়া, ক্লিউপেট্রা আর রাজা হলো জিরাফের নাম। ফাল্গুনী জলহস্তীর বাচ্চা। আর রাজা বাহাদুর আর সুন্দরী হলো হাতি। সেদিন সাদা আর নীল ময়ূরের পেখম মেলার কোনো তাড়াই ছিল না। অথবা তারাও বুঝতে পেরেছিল লকডাউনে তাদের দেখতে তো আর কেউ আসবে না। তাই বয়েই গেছে পেখম মেলতে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে জনজীবন থমকে গেছে। দেশে চলছে কঠোর লকডাউন। তবে চিড়িয়াখানার কর্মীদের কোনো ছুটি নেই। প্রভা, ফারিয়া, রাজা বাহাদুরদের পছন্দমাফিক খাবার দিতে হচ্ছে নিয়মমতো। অন্যান্য যত্নআত্তি তো আছেই। আর অন্যদিকে লকডাউনে চিড়িয়াখানার সদস্য অর্থাৎ বাহাদুরেরাও আছে বহাল তবিয়তে। তাদের আনন্দের সীমা নেই। তাদের বিরক্ত করার কেউ নেই। দর্শনার্থীদের তো ঢোকাই বন্ধ।
চিড়িয়াখানায় মানুষের কোলাহল নেই। তবে বড় বড় কড়ইগাছ, আমগাছসহ বিভিন্ন গাছে পাখিদের কলতানে মুখর পুরো চিড়িয়াখানা। চোখের সামনে দিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে কাঠবিড়ালি। সবুজে ছেয়ে আছে চিড়িয়াখানা।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ায় প্রথম দফায় গত বছরের ২০ মার্চ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ ছিল। নভেম্বর থেকে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় চিড়িয়াখানা। তবে চলতি বছরের গত ২ এপ্রিল থেকে আবার দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভেতরের উন্নয়নকাজসহ চলছে অন্যান্য রুটিনমাফিক কাজ।
দুটি লেকসহ ১৮৬ একরের বেশি জায়গাজুড়ে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় করোনার আগে প্রতিদিন গড়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের মতো। ঈদ বা বড় উৎসবে সংখ্যা আরও বাড়ে। বছরে ৪০ লাখের বেশি দর্শনার্থীর চাপ সামলাতে হতো। চিড়িয়াখানার প্রায় ১৩৫ প্রজাতির প্রায় ৩ হাজার পশুপাখিকেও এ চাপ নিতে হতো। দর্শনার্থীদের অনেকেই খাঁচার বাইরে থেকে ঢিল ছুড়ে বা মুখে শব্দ করে বিরক্ত করে পশুপাখিদের আরামে ব্যাঘাত ঘটান। পশুপাখিদের এখন আর বিরক্ত করার কেউ নেই। চিড়িয়াখানার কেয়ারটেকার বা দেখভালকারীদের সঙ্গে পশুপাখিদের সখ্য আগে থেকেই ছিল, এখন আরও বেড়েছে।
চিড়িয়াখানার রাজা–বাহাদুরেরা কেমন আছে, তা দেখতে মঙ্গলবার সকালে চিড়িয়াখানায় ঢুকতেই বানরের খাঁচায় দেখা গেল প্রতিযোগিতা চলছে। একটু পরপর পানিতে লাফ দেওয়ার ঝুপঝাঁপ শব্দ। দুষ্টু বালকেরা অভিভাবকের চোখ ফাঁকি দিয়ে যেমন উঁচু থেকে পানিতে ঝাঁপ দেয়, তেমনই একেকটা বানর লাফিয়ে খাঁচার ওপরে উঠছে, আবার দুপ করে পানিতে লাফিয়ে পড়ছে। তাড়াহুড়ো করে আবার যাওয়ার সময় অন্যদের সঙ্গে মারামারিও লাগছে। চিড়িয়াখানার কর্মীরা বলেন, ওরা আনন্দে আছে। আর গরম লাগছে বলে পানিতে ভিজিয়ে নিচ্ছে শরীর। আর টগর মানে বেঙ্গল টাইগার (পুরুষ) জিহ্বা দিয়ে চেটে পানি খেয়ে মাটিতে সটান হয়ে শুয়ে ঘুম দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকারও শব্দ পাওয়া গেল।
সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় চিড়িয়াখানার সদস্যদের খাওয়ানোর তোড়জোড়। কেউ মাছ খায়, কেউ আবার মাংস। কারও লাগে আপেল, কমলা, আঙুর। কারও বা লাগে পাউরুটি। কলমিশাক থেকে শুরু করে কলাগাছ আবার কারও পছন্দের খাবার। মঙ্গলবার সকাল থেকেই দেখা গেল হরেক রকম খাবার এসে পৌঁছাচ্ছে চিড়িয়াখানায়। সেগুলোর ওজন ও গুণগত মান ঠিক আছে কি না, কর্মীরা তা তদারক করছেন। তারপর পশুপাখিদের খাঁচায় চলে যাচ্ছে সে খাবার। কারও কারও বেলায় আবার দিনে কয়েক দফায় খাবারের এ আয়োজন করতে হয়। মঙ্গলবার শুধু গরুর মাংসই ছিল ১৬৩ কেজি ৭০০ গ্রাম।
১৫ বছর ধরে বকের খাঁচায় খাবার দেন আওয়াল। জানালেন, পুঁটি আর চেওয়া নামক একটি মাছ বকেরা বেশি পছন্দ করে। প্রতিদিন ৬০ কেজির বেশি ছোট মাছই লাগে বকের খাঁচায়। শিংসহ অন্যান্য মাছ তো আছেই। মাছ ওজন দেওয়ার সময় আওয়ালের হাতে শিং মাছের কাঁটা ফুটে গেল। তবে আওয়ালের তেমন ভাবান্তর নেই। বকের খাঁচায় ঢুকে তিনি যখন মাছগুলো পানিতে ঢালছিলেন, তখন বকেরা আস্তে আস্তে এসে জড়ো হলো। টুপ করে মাছ গিলে মনের আনন্দে উড়তে লাগল। চিড়িয়াখানার কর্মীরা জানালেন, খাঁচায় খাবার দেওয়ার পর সে খাবার খাবে কি না বা কখন খাবে, তা তাদের মর্জি। তবে ঠিক সময়ে তা দিতেই হবে। বাইরে লকডাউন বা যা–ই থাকুক না কেন।
চিড়িয়াখানার প্রাণী পুষ্টি কর্মকর্তা এম এ জলিল বলেন, পশুপাখিদের খাবার নিয়ে কোনো আপস করা হয় না। মাসের শুরুতেই খাবারের তালিকা ঠিক করা হয়। ফল ও মাছে ফরমালিন আছে কি না, তা পরীক্ষার পরই খাবার খাঁচায় পাঠানো হয়।
চিড়িয়াখানার পাখি শাখার প্রধান ডা. মো. ওয়ালিউর রহমান বলেন, চিড়িয়াখানার দর্শনার্থী বা মানুষই পশুপাখির বড় শত্রু। দর্শনার্থীদের জন্য পশুপাখিদের দৈনন্দিন রুটিনে ব্যাঘাত ঘটে। কেউ ঘুমিয়ে থাকলে দর্শনার্থীদের অনেকে তাদের ঘুমাতে দেন না। এখন চিড়িয়াখানা দর্শনার্থীমুক্ত। তাই তারা বেশ আনন্দে আছে।
পরিচালক থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের কর্মীরাও একবাক্যে পশুপাখিরা বেশ ভালো আছে বলে জানালেন। জানালেন, তাদের মধ্যে চঞ্চলতা বেড়েছে। অনেকে আবার একটু বেশি আরামে থেকে অতিরিক্ত মোটাও হয়ে যাচ্ছে। তা নিয়েও কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হচ্ছে। পশুপাখিদের প্রজনন ক্ষমতা বেড়েছে বলে নতুন নতুন সদস্যের আনাগোনাও বাড়ছে। করোনাকালেই ঘোড়ার বাচ্চা এলভিসের জন্ম হয়েছে। ফাল্গুনীর জন্ম হয়েছে। জেব্রার বাচ্চা হয়েছে। ডিম ফুটিয়ে নতুন বাচ্চা হচ্ছে অনেকের।
৩৮ বছর ধরে জলহস্তীদের সঙ্গে জীবন কাটিয়ে দেওয়া নূরে আলমের মুখে তৃপ্তির হাসি। লকডাউনে ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে হেঁটে আসতে হয় নূরে আলমকে। তিনি এ কষ্টকে কষ্ট মনে করেন না। বললেন, জলহস্তীরা কথা বলতে পারে না, কিন্তু তিনি ঠিকই তাদের ভাষা বুঝতে পারেন। তারা ভালো না খারাপ আছে, তিনি ছাড়া অন্যরা তা বুঝতে পারবেন না। তাঁর জলহস্তী পরিবারের সদস্যরা (১৩টি) এখন বেশ ভালো আছে বলে গর্ব নিয়েই বললেন তিনি। গল্পে গল্পে জানালেন, বেশ আগে টিটো আর ডায়নার ঘরে বাচ্চা হলো। এই বাচ্চার নানা-দাদা-চাচা সবই তো তিনি। তাই বাচ্চা দেখতে গেলেন। কিন্তু সেদিন ডায়না খেপে গেল। টিটো ডায়নার পাশেই শুয়ে ছিল। টিটোই সেদিন খেপে যাওয়া ডায়নার সামনে দাঁড়িয়ে নূরে আলমের জীবন বাঁচিয়েছিল।
জলহস্তীরা নূরে আলমের কথা মানে, তারও প্রমাণ পাওয়া গেল। পানিতে ডুব দিয়ে থাকা জলহস্তীদের দেখানোর জন্য পানি থেকে ওপরে আসার জন্য ডাক দিলেন নূরে আলম। অনেকটা অনিচ্ছা নিয়েই গুটিগুটি পায়ে একেকটা ঠিকই ওপরে উঠে এল। তাই দেখে নূরে আলমের মুখে সে কী হাসি। একেক জলহস্তী যখন হাঁ করে নূরে আলমের হাতে থাকা ঘাস খাচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল এরা চাইলেই আস্ত নূরে আলমকেই গিলে খেতে পারবে।
নূরে আলম বলেন, ‘সাব সাহারান আফ্রিকার জলহস্তীদের এখন বাড়িতে পালা গরু–ছাগলের মতোই মনে হয়। তবে সতর্ক তো থাকতেই হয়। মতিগতির তো ঠিক নাই।’
চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. মো. আবদুল লতীফ চিড়িয়াখানায় যোগ দিয়েছেন গত সেপ্টেম্বর মাসে। জানালেন, এরই মধ্যে পশুপাখিদের সঙ্গে বেশ ভাব জমেছে। নিয়ম করে বাহাদুর আর সুন্দরীর সঙ্গে ফুটবল খেলেন। বললেন, ফুটবল খেলাটা ভালোই রপ্ত করেছে ওরা। এখন ওদের দিয়ে বাস্কেটবল খেলানো যায় কি না, তার প্রস্তুতি চলছে। একসময় করোনাভাইরাস পৃথিবী থেকে বিতাড়িত হলে দর্শনার্থীরা আবার ছুটে আসবেন চিড়িয়াখানায়। তখন দর্শনার্থীরা সুন্দরীদের খেলা দেখে মুগ্ধ হবেন। একইভাবে ঘোড়াদের পিঠে চড়ে বাচ্চারা যাতে আনন্দ পায়, তারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দর্শনার্থীদের মধ্যে কেউ পশুপাখিদের খাবার দিতে চাইলে তারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বৃহৎ (তৃণভোজী) প্রাণী শাখার প্রধান ডা. মো. ওসমান গণি বলেন, বাইরের মানুষের ধারণা, যেহেতু লকডাউন, তাই চিড়িয়াখানার কর্মীদেরও বোধ হয় ছুটি। কিন্তু তার তো কোনো উপায় নেই। পশুপাখিদের বাঁচিয়ে রাখতে কর্মীদের দায়িত্ব পালন করতেই হয়। তবে করোনাভাইরাস থেকে কর্মীদের নিজেদের নিরাপদ রাখতে কর্তৃপক্ষ নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে।
পরিচালক ডা. মো. আবদুল লতীফ বেশ খানিকটা আক্ষেপ নিয়েই বলেন, দুর্যোগসহ যা–ই ঘটুক, জাতীয় প্রতিষ্ঠান চিড়িয়াখানার কর্মীদের ছুটি কাটানোর উপায় নেই। অথচ সরকারের জরুরি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় চিড়িয়াখানার নাম নেই, যা থাকা খুব জরুরি। আর নূরে আলমেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তাঁদের জন্য এখন পর্যন্ত ঝুঁকি ভাতা চালু করা যায়নি। এটি চালু হলে নূরে আলমেরা আর একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারবেন, আর তাতে পশুপাখিরাও আরও ভালো থাকবে।
চিড়িয়াখানা থেকে বিদায় নেওয়ার আগে সুন্দরী আর বাহাদুর বল খেলা দেখাল। বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে সালামও দিল। সূত্র : প্রথমআলো।