শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:০৫ pm
বিবাহ, আকিকা, খাৎনা-যে কোন নিমন্ত্রণেই উপহার নিয়ে যাওয়ার কুৎসিত প্রচলন হয়েছে! সদর দরজাতেই একদল চেয়ার-টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে বসে থাকে কে, কি আনলো/দিলো সেটা তালিকাভূক্ত করতে! কেউ উপহার হাতে, কেউ নগদ টাকা সাথে চলে আসে! যেনো হোটেলে খাওয়ার আগে বা পরে বিল দেয়ার মত অবস্থা! অনেকেই আবার উপহার দিতে না পারার লজ্জায় আমন্ত্রণ এড়ায়!
আপাতত শ্রাদ্ধ-চল্লিশায় উপহারের রীতি চালু না থাকলেও চারদিকে যে হাল শুরু হয়েছে তাতে কবে জানি শ্রাদ্ধ খেতেও কচকচে নোট দেয়ার রীতির চল হয়! বড়লোকের, খ্যাতিমানদের, ক্ষমতাবানদের খাবারের আয়োজনে যে খরচ তার সমপরিমাণ বা তার অধিক উপহার থেকেই আসে! কাজেই জন্মবার্ষিক, বিবাহ বার্ষিক, মোলাকাত বার্ষিক-সবটাই ঘটা করে উদযাপন করা হয়! গরীব আত্মীয়-স্বজনের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়! লৌকিকতার লাজে শত ইচ্ছা থাকলেও কারা আসরে আসে না। সামাজিক বৈষম্য ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকে!
উপহারের বিনিময়ে খাদ্য(উবিখা) সমাজে স্বার্থবাদের ভয়ংকর বীজ বপন করছে! অনুষ্ঠানে কী কী উপহার-উপঢৌকন মিলল, কে দিল আর কে দিল না সেটা নিয়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনা হয়! পরবর্তীতে কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করা যাবে না সে সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়! কাকে বারবার বলতে হবে তার নাম মস্তিষ্কে গেঁথে রাখা হয়! মাগনা খাওয়ানোর মত বোকামি আর করা হয় না! দাওয়াত মানেই খামে ভর্তি কচকচে নোট! ৫০০/১০০০ টাকার নোট! হোটেলের একবেলা খাবারের দামের মত নোট!হোটেলে খাবারের পরে বিল দেয়া গেলেও যে কোন অনুষ্ঠানে খাবারের আগেই দিতে হয়! বারবার নাম জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হওয়া হয়, এতো হালকা খাম আপনার তো! আরও বেশি আশা ছিল!
হাদিয়া সুন্নত বলে অনেক কিছুই চালিয়ে দেয়া হয়! কিন্তু সমাজে প্রচলিত যে নিয়মে হাদিয়া আদায় করা হয় তা দুঃখজনক! দেখে যেনো মনে হয়, স্বেচ্ছায় বাধ্যতামূলকভাবে দেয়া হয়! আয়োজকরা আশায় থাকে, কিছু তো পাওয়া যাবেই! আমন্ত্রিতরা আশঙ্কায় থাকে, যা দিচ্ছি তাতে সম্মান রক্ষা পাবে তো!আন্তরিক মহব্বত থেকে এখন আর কিছুই হয় না! ফ্রিতে ইয়াতিমখানা ছাড়া আর কোথাও কিছু মেলে না! ভাই ভাইয়ের কোন আয়োজনে লজ্জার শঙ্কায় পড়ে, বোন ভাইয়ের কোন আয়োজনে ইতস্ততা করে-কম দেয়া হলো কি-না! কী ভয়ংকর বীভৎস-অসুন্দর সমাজে বাস করছি! কী জঘন্য সংস্কৃতির মাঝে দিন অতিবাহিত করছি!
কোন অনুষ্ঠানে যদি বলেও দেয়া হয়-উপহারহীন মোলাকাত করবেন! তাতেও দ্বিবিধ সমস্যা! আমন্ত্রিতদের একাংশ মনে করে তাদের তাচ্ছিল্য করা হয়েছে! আবার যারা আমন্ত্রণ জানায় তারাও ভাবে সামাজিকতার বাইরে গিয়ে ভুল করছে! যারা আসে তাদের কেউ কেউ নিষেধ উপেক্ষা করে উপহার নিয়ে আসে আবার যাদের জন্য নিয়ে আসে তারাও ফেরৎ দিতে পারে না! বসকে খুশি করতে, কলিগের সাথে সৌহার্দ্য রাখতে, নেতার দৃষ্টি পেতে উপহার বাছাইয়ে কত ধরণের সৃষ্টিশীলতা দেখাতে হয়! কেউ কেউ তো আবার উপহার হিসেবে ঘুষও দেয়! একবার দিয়ে বারবার স্বার্থ আদায় করার সুযোগ খোঁজে!
অনুষ্ঠান-উদযাপনে উপহারের রীতি সামাজিক ব্যাধিতে পরিনত হচ্ছে। এ ব্যাধি সংক্রামক হিসেবে আপনের থেকে আপনকে দূরে নিচ্ছে! লজ্জায় অসামর্থ্যদের ঋণী করছে। আয়োজকদের লোভী বানাচ্ছে! নাম কামানোর জন্য কেউ কেউ নানাধরণের আজব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং নিমন্ত্রণ দিয়ে দিয়ে কাছের মানুষজনকে বিব্রত করে! কাউকে খাওয়ানোর হলে স্বার্থহীনভাবে খাওয়ানো দরকার। নয়তো খাওয়ানো বন্ধ করা দরকার! তবুও উপহারের লোভে কারো ক্ষোভের কারন হওয়া ঠিক নয়! নগদ টাকা, সাধ্যাতিরিক্ত উপহার-এসব বর্জিত অনুষ্ঠান আয়োজন হওয়া উচিত। তবেই সম্পর্কগুলো বাঁচবে! মানুষ মানুষকে মনে রাখবে! মানুষ মানুষের মনের কাছাকাছি আসবে! কলাম লেখক, [email protected]