শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:২৯ pm
টাকা-পয়সাই কি শ্রেষ্ঠ সঞ্চয়? মোটেই না। সঞ্চয়ের আরও মহোত্তম রূপ আছে । সেটা সময়। পরিবারকে সময় দিলে, সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে গেলে সেটার লাভ বহুগুন হয়ে ফেরত আসবে। অর্থের বিনিয়োগে মুনাফা পরিমাপ করা যায় কিন্তু প্রিয়জন-স্বজনের জন্য সময় বিনিয়োগ করলে সেখান থেকে প্রাপ্ত প্রশান্তির প্রবৃদ্ধি সুখের মাত্রাকে অসীম করে বাড়িযে দেয়। আমাদের অর্থ-বিত্ত, শ্রম-ব্যস্ততা সবকিছু একটুখানি সুখের জন্য। যেখানে পরিবার উপেক্ষিত হলে, সন্তান অবহেলিত হলে, প্রিয়জন অনাদর পেলে কোনকিছুই আর সেটার ক্ষতিকে পূরণ করতে পারবে না।
যে সঙ্গী সঙ্গহীন থাকে, যার কথা মনের ভেতরে গুমরে কাদেঁ, যার ব্যথায় সান্ত্বনা দিতে প্রিয়জন পাশে থাকে না সেই জীবনের দুঃখ আছে। যে সন্তান বাবা-মাকে কাছে পায়নি, আদরের ঘাটতি থেকেছে, আবদ্ধ থেকে একা কেঁদেছে সেই সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের মূল্য আছে? তাদের পৃথিবীটাই তো সংকীর্ণ হয়ে যায়। যদি এমন হয় যে, অনেক টাকা কিন্তু পরিবারের কেউ কাছে নাই তবে সে জীবন নরক। ভোগ শরীরের চাহিদা ফুরায় কিন্তু মনের প্রশান্তির জন্য একটি শান্তির নিকুঞ্জ রচনা করতে হয়। যা পরিবারকে সময় দেয়া ছাড়া কোনভাবেই অর্জন করা সম্ভব নয়। যারা এর বিকল্প পথে হেঁটেছে তারা হোঁচট খেয়েছে।
কাজেই পূঁজি যদি কিছু জমাতেই হয় তবে সেটা প্রিয়জনদের জন্য সময় বরাদ্ধ করার মাধ্যমেই করতে হবে। সময়কে চুরি করে ব্যাংকে অর্থ জমালে সে অর্থ জীবনের জন্য অনর্থ আনবে। চাঁদ রাতে জ্যোছনা দেখা, বৃষ্টি এলে গল্পে থাকা, সাগর বুকে চিহ্ন রাখা, পাহাড় পৃষ্টে পাড়ি দেয়া-এসব আগামী দিনের জন্য সঞ্চয়। যেদিন অনেক কথা জমা থাকবে কিন্তু বলার লোক থাকবে না সেদিন পরিবার পাশে থাকবে। সন্তান দরদ বুঝবে।
সেজন্যই পরিবারকেন্দ্রিক হতে হবে। রাজ্য জয় করতে গিয়ে যদি পরিবার হারিয়ে যায়, সমাজ উদ্ধার করতে গিয়ে যদি সন্তান বিপথে যায় তবে কোন অর্থ, কোন বৈভব কাজে আসবে না। অল্প কিছু অর্থের পরিবারের সবাইকে একসাথে পেতে, সহযোগিতা, সহমর্মীতায় পাশাপাশি থাকতে আজকে থেকে, এখন থেকে সময় সঞ্চয় করুন। যে সময় এককভাবে পরিবারের হবে, সন্তানদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবে তখন থেকেই জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে। সে জীবন এমন জীবন যে জীবনের জন্য তপস্যা করতে হয়! যে আপন ধরতে ধ্যানে বসতে হয়। সেই সবকিছুকে সময় দিয়েই একত্র করা সময়। ভালোবেসে একসাথে দীর্ঘপথ কাটানো যায়।
ধন-দৌলত কি উত্তম সম্পদ ? অবশ্যই না। সম্পদের আরও সুন্দরতম রূপ আছে। সে বন্ধু । যার বন্ধু নাই । তার জীবনে কিচ্ছু নাই। চারপাশে মিছিল, কুর্নিশ-সালাম দেখে দম্ভ হওয়া ঠিক নয়। মধু ফুরিয়ে গেলে শরতের মৌমাছি হারিয়ে যাবে। যতদিন ক্ষমতা ততদিন ভৃত্য-পরিষদের অভাব থাকবে না। বানোয়াট প্রশংসা করে স্বার্থ হাসিল করা সভাসদের জাঁকজমক কমবে না। কিন্তু বিপদে পড়লে আর কেউ পাশে থাকবে না, একবারও খোঁজও নেবে না; বন্ধু ছাড়া। সুন্দর জীবনের জন্য কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধু থাকা জরুরী। যারা ছায়া হয়ে পাশে থাকবে, সব বিপদ-আপদে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে।
যারা বড় হয়েছে, আলো ছড়িয়েছে তাদের সবাই বন্ধুত্বের প্রসারিত হাত, উম্মুক্ত বুক পেয়েছিল। মানবজীবন এতো ছোট নয় যে একা একা পাড়ি জমানো যাবে। সুন্দরভাবে কাটানোর জন্য, হাসি-খুশি থাকার জন্য, পরিচ্ছন্ন উপভোগের জন্য বন্ধু লাগবেই। তবে বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর চেয়ে একলা থমকে থাকা কম বেদনার । কে হতে পারে বন্ধু? যে আপনাকে বোঝে। পথের কুকুরও কখনো কখনো মানুষের চেয়ে ভালো বন্ধু হয়। স্ত্রী/স্বামী যাদের বন্ধু হয় তাদের আর দুঃখ-বেদনা স্পর্শ করতে পারে না। তবে খেলার সাথী, সহপাঠী যেভাবে অকৃপণ বন্ধু হতে পারে সহকর্মী ততোটা পারে না! অকৃত্রিম বন্ধুত্ব সৈই কৈশর-শৈশবেই গড়ে ওঠে । যা আমৃত্যু থাকে। ঝড়-ঝাঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস-খরায় সঙ্গ দিয়ে যায়। কাঁধে ভরসার হাত রাখে।
ব্যাংকের চেয়ে লোনের সুন্দরতম খাত আপনার বন্ধু, বইয়ের চেয়েও আপনাকে বেশি জ্ঞান দানের বাতিঘর আপনার বন্ধু ! আপনার মন খারাপে বেদনাসংগীতের চেয়ে উত্তম সঙ্গ যিনি দিতে পারেন-তিনি বন্ধু। বন্ধুত্বের বিস্তৃতি আকাশে ছেয়েও বিশাল, বন্ধুত্বের মহিমা দক্ষিণা হাওয়ার চেয়েও শীতল। বিশ্বস্ত বন্ধু পেতে হলে আপনাকেও ভালো বন্ধু হতে হবে। দুঃখকে উপভোগ করতে, সুখকে উদযাপন করতে বন্ধুদের মত নিঁখাদ মানুষ দ্বিতীয় কেউ নাই। বন্ধুত্বের সম্পর্ককে যারা যত্ন করতে জানে তাদের জীবনকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করতে পারে না।
সঞ্চয় এবং সম্পদের প্রশ্নের উত্তমটিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। ছোট্ট জীবনকে মহৎজীবনের অংশে পরিণত করতে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের ভরসার ছাড়া বিকল্প কিচ্ছু নাই। কারো স্বার্থ ভরিয়ে সুন্দর সম্পর্ক রচনা করা যায় না। কাজেই পরিবার, পরিবার, পরিবার এবং বন্ধু-জীবনে এগুলো অগ্রাধিকারে অগ্রভাগে থাকুক! কলাম লেখক, রাজু আহমেদ, [email protected]