সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৫:৫৬ am
নিজস্ব প্রতিবেদক, তানোর :
পেশায় তিনি একজন হাট-ইজারাদার ও গরু ব্যবসায়ী। ব্যবসা তার প্রধান কর্ম। বর্তমানে মুন্ডুমালা হাট ছাড়াও বেশ কয়েকটি হাটের ইজারাদার তিনি। সেই কর্মের সাথে এবার তিনি যোগ করেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইজারা নেয়া। এতে কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করছেন তিনি।
বাব-দাদার হাট-ইজারা পেশার হাল ছেড়ে ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী রাজশাহীর তানোর পৌরসভা নির্বাচনে মেয়রপদে আ.লীগের মনোনয়নে তার শুরু হয় প্রচার-প্রচারণা। ওই নির্বাচনের আগে রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী আবুল বাসার সুজনের দ্বারা প্রভাবিত হন। ফলে ভাগ্য খুলে যায় সুজনের।
পরে মুজিব শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ তানোর পৌরসদরের গোল্লাপাড়া বাজার মাঠে পৌর আ.লীগের এক বর্ধিত সভার আয়োজন করা হয়। উক্ত সভায় তানোর পৌর আ.লীগের সভাপতি বর্তমান মেয়র ইমরুল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন এমপি ফারুক চৌধুরী। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমপি সুজনকে তার নিকট আত্নীয়ের পরিচয় দিয়ে তিনি সিংহের বাচ্চা আর সুজনকে বাঘের বাচ্চার পরিচয়ে তানোর পৌরসভা নির্বাচনে মেয়রপদে তাকে প্রার্থী ঘোষণা দেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এতো আশাবাদী হয়েও গেলো ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী পৌর নির্বাচনে আ.লীগ দল থেকে মনোনয়ন পাননি সুজন। এরপর থেকে এমপি ক্ষুব্ধ হয়ে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীকে দূরে রাখেন। ফলে সুজনের নিয়ন্ত্রণ কব্জায় আ.লীগের সম্মেলন ছাড়াও বিভিন্ন সভা সমাবেশে একক অধিপত্য ও নেতৃত্বে কোনঠাসা হয়ে পড়ে ত্যাগী তৃণমূল আ.লীগ। তিনি এখন তানোর আ.লীগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দু’বছর ধরে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে কোটি কোটি টাকা বণিজ্যের মূলহোতা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, শৈশব থেকেই রাজশাহী মহানগরীর সপুরাতে বসবাস সুজনের। তার পিতার নাম আব্দুস সামাদ হাজী। তারা দুই ভাই এক বোন। বাব-দাদার স্থায়ী বাড়ি নওগাঁ জেলার নিয়াতমপুর উপজেলার লতিফপুর সাহাপুর গ্রামে। সেখান থেকে ১৯৫২ সাল হতে রাজশাহী নগরীর সপুরাতে বসবাস। তবে, পৌর নির্বাচনে মেয়রপদে প্রার্থী হতে দু’বছর আগে তানোর পৌর এলাকার চাপড়া মহল্লায় কয়েক কোটি টাকা খরচে ফ্লাট বাড়ি ও গরুর খামার তৈরি করেছেন তিনি। এছাড়াও তানোর সদরের গোল্লাপাড়া বাজার, কাশিম বাজার ও কালিগঞ্জ হাট বাজার স্থলে মেইন রোড পজিশনে বেশ কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জায়গা জমি ক্রয় করে কোটিপতি বনে গেছেন সুজন। কিন্তু এতো দিনেও তানোর আ.লীগ অথবা সহযোগী সংগঠনের কোন পদ-পদবী পাননি তিনি।
সুজনের ঘনিষ্ঠরা জানায়, তিনি ব্যবসার প্রসার ঘটাতে যখন যে দল ক্ষমতায় তখন সে দলের হয়ে সুবিধা ভোগ করেন। এতে কখনো জামায়াত। আবার কখনো বিএনপি। বর্তমানে আ.লীগের দলে ভিড়ে সুবিধা ভোগ করছেন।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্যমতে, উপজেলায় ৫৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ৩টি করে পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এসব পদ যথাক্রমে নিরাপত্তা প্রহরী, পরিছন্নকর্মী ও আয়াপদ ছাড়া প্রধান শিক্ষক পদ রয়েছে। আর দাখিল ও আলিম মাদ্রাসা মিলে রয়েছে ২০টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি মাদ্রাসায় দুইপদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এগুলো হলো নিরাপত্তা কর্মী ও আয়াপদ। আবার কোন কোন প্রতিষ্ঠানে বাড়তি সহ-সুপার ও কমপিউটার অপরেটর পদেও জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে, কলেজ পর্যায়ে এসব পদে দ্বিগুন জনবল নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবে ২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তানোর পৌরসভা উচ্চ বিদ্যালয় ও সরনজাই বালিকা বিদ্যালয়ে পরিছন্নতা কর্মী আর আয়া পদে নিয়োগ দিয়ে প্রত্যেক প্রার্থীর নিকট হতে ১২ লাখ করে টাকা নিয়ে নিয়োগ দেয়া হয় বলে প্রার্থীদের আত্নীয়-স্বজন সূত্রে জানা গেছে। তবে, এসব পদে কোন না কোন ভাবে নিয়োগ বাণিজ্য হচ্ছে কিন্তু ধরা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সিদ্দিকুর রহমান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, সংশ্লিষ্ট বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় অধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই ব্যক্তি দুটির অধিক প্রতিষ্ঠানে সভাপতি করা যাবে না। কিন্তু এসব নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা না করে এমপির ডিও লেটারে একই ব্যক্তিকে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি করা হয়েছে। এমন প্রমান পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি। এরমধ্যে রয়েছে তানোর পৌর এলাকায় অবস্থিত চাপড়া উচ্চ বিদ্যালয়, তানোর পৌরসভা উচ্চ বিদ্যালয় ও গোকুল মথুরা দাখিল মাদ্রাসায় বেশ কয়েক বছর ধরে সভাপতি রয়েছেন আবুল বাসার সুজন। এছাড়াও তালন্দ ললিত মোহন ডিগ্রী কলেজের বিদ্যুৎসায়ী সদস্য তিনি। এতো প্রতিষ্ঠানের হোতা হয়ে বর্তমানে সুজন এমপির আর্শিবাদে সব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে প্রতিনিধিত্ব করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সাল হতে এসব প্রতিষ্ঠানে চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। সর্বশেষ চলতি ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী কালিগঞ্জহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে নিরাপত্তা প্রহরী, পরিছন্নকর্মী ও আয়াপদ ছাড়াও প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি রামিল হাসান সুইট এসব পদে নিয়োগ দিয়ে প্রধান শিক্ষক পদে ১৫ লাখ টাকা। আর চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন বলে ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সদস্য জানিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি সুইট এভাবে কালো টাকার ভরে অন্ধ হয়ে তানোর পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড জামায়তের আমীর বা সভাপতি মিজানুর রহমানকে সহকারী প্রধান শিক্ষক হতে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন। এই সুইটের বাড়ি তানোর পৌর সদরের বুরুজ মহল্লায়। বর্তমানে তিনি রাজশাহী নগরীতে বসবাস করেন। সম্প্রতি গেলো জুলাই মাসে তানোর উপজেলা সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান তিনি। তবে, এব্যাপারে রামিল হাসান সুইটের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে মোবাইল সংযোগ বিছিন্ন করে দেন।
সম্প্রতি সময়ে এভাবে এমপির প্রতিনিধিত্ব করে তানোর উপজেলার ৮৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৬০ শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে প্রায় ৪০ কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন সুজন ও সুইট বলে তানোর পৌরসভা দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি ও তানোর পৌর যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইকবাল মোল্লা এপ্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।
তিনি আরও বলেন, তার মাদ্রাসায় দুটি পদে নিয়োগে একেক প্রার্থীর কাছ থেকে ১৪ লাখ করে টাকা নেয়া হয়। এভাবে দুটি পদে এমপির প্রতিনিধি সুজন ২৮ লাখ নিয়েও মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়নে কোন টাকা দেননি। একারণে নিয়োগে স্বাক্ষর করেন তিনি। গেলো ২০২১ সাল হতে চলতি ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ৮৬টি পদে নিয়োগ দিয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আবুল বাসার সুজন ও সুইট বলে ইকবালসহ একাধিক নেতা নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, বর্তমানে সুজন নিয়োগ বাণিজ্যের পাশিপাশি পুরো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের জেলা বা কেন্দ্র কমিটির অনুমতি ছাড়া তানোর উপজেলার আ.লীগ ও সকল সহযোগী সংগঠনের কমিটি করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। সম্প্রতি তানোর উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ ছাড়াও সেচ্ছাসেবক এবং মহিলা লীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনের ত্রি-বাষিক সম্মেলন শেষ হয়েছে। এসব সম্মেলনের একক আধিপত্য সুজনের। তার দেয়া তালিকায় ঠাঁই পাচ্ছে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ। এসব পদের নেতারা এক সময়ে বিএনপি-জামায়াত কর্মী সমর্থক ছিল। এতে করে অনেক অযোগ্য নেতারা পদ পেলেও প্রবীণ ও ত্যাগী নেতারা বাদ পড়ছে কমিটি থেকে। এতে তৃণমুলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বশেষ ২৩ জুলাই মুন্ডুমালা পৌরসভা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এক সম্মেলন থেকেই আ.লীগ যুবলীগ, কৃষক ও মহিল লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই সম্মেলনের সবগুলো সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক পদের তালিকা প্রকাশ্যে মঞ্চে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক আবুল কালাম আজাদ প্রদীপ সরকারের হাতে তুলে দেন সুজন। সেই তালিকা ধরেই প্রদীপ সরকার সকল সংগঠনের কমিটির ঘোষণা করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, তানোরে আ.লীগের রাজনীতি নষ্ট করে ফেলেছেন সুজন। তার একক আধিপত্যের কাছে সবাই অসহায়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আবুল বাসার সুজন বলেন, তানোরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে টাকা নেয়ার কোন প্রমান নেই। তবে, প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন বিবেচনায় প্রার্থীরা ডোনেশন সরুপ টাকা দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে নিউজ করে কি হবে বলে এড়িয়ে গেছেন তিনি। এব্যাপারে এমপি ফারুক চৌধুরীর মোবাইলে ফোন দেয়া হলেও রিসিভ হয়নি। রা/অ