মঙ্গবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:৪০ am
নিজস্ব প্রতিবেদক :
উচ্চ আদালত রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার ৯৫২টি পুকুর-দীঘি সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে কিছুটা অংশ ভরাট হয়ে যাওয়া ‘সুখান দীঘি’ নামের একটি দীঘিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন আদালত। আদালতের আদেশ অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখন ভূমিদস্যুরা আবার দীঘিটি গিলতে শুরু করেছেন।’
নগরীর সপুরা এলাকায় ১০ বিঘা আয়তনের এই দীঘিটি কয়েকদিন ধরে ভরাট করা হচ্ছে। প্রথমে রাতে বালু ফেলা শুরু হলেও এখন প্রকাশ্যেই দীঘিটি ভরাট করা হচ্ছে। ভূমিদস্যুদের হাত থেকে দীঘিটি রক্ষায় এর মালিকেরা মঙ্গলবার আদালত থেকে আবার নিষেধাজ্ঞা জারি করে এনেছেন। ভরাটের প্রতিবাদে বুধবার দুপুরে তারা দীঘিপাড়ে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেছেন।
শহরে একের পর এক পুকুর-দীঘি ভরাট হয়ে যাচ্ছে দেখে সিটি করপোরেশন ২২টি পুকুর-দীঘিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যক্তিমালিকানায় থাকলেও পুকুর-দীঘিগুলোকে অধিগ্রহণ করার পরিকল্পনা নগর সংস্থা। এ জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই তালিকায় আছে সুখানদীঘি। এরমধ্যেই ভূমিদস্যুরা সুখানদীঘি ভরাট করতে শুরু করেছে। গতবছর একদফায় দীঘির কিছুটা অংশ ভরাট করা হয়।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বিষয়টি নজরে আসে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবির) নামের একটি সংগঠনের। সংগঠনটি এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে। গত বছরের আগস্টে এই রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি হয়। সেদিন উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ রাজশাহী শহরের ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষণের পাশাপাশি সুখানদীঘিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র, রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসককে এই নির্দেশ দেন আদালত।
তবে সুখানদীঘি রক্ষার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং স্থানীয় একটি ভূমিদস্যু চক্র দীঘিটি ভরাট শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দীঘি পাড়ের একটি অংশ ভরাট করে কয়েকটি দোকানঘর তৈরি করা হচ্ছে। দীঘির পানিতে টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে বালু ফেলা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে এলাকাবাসী ও দীঘির মালিকেরা বুধবার দীঘিপাড়েই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
সেখানে জিল্লুর রহমান (৬০) নামের এক ব্যক্তি জানান, এটি ব্যক্তিমালিকানার দীঘি। এখন তিনিসহ এর ওয়ারিশ অন্তত ১৫০ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের জন্য দীঘিটি মাছচাষ করতে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব আলী, ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সোবহান লিটন, মোস্তাক আহমেদ ও শাহিন হোসেনসহ ১০ জন ব্যক্তি দীঘিটি দেড় লাখ টাকায় ইজারা নেন। এরপর তারা আর দীঘির দখল ছাড়েননি। দুই কোটি টাকা না দিলে তারা দীঘি ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দেন। এরা প্রভাবশালী বলে তারা কিছু করতেও পারেননি। এখন তাঁরাই দীঘিটি ভরাট করছেন। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল রানা।
মোবাইলে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সোহরাব আলী কথা না বলেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর তিনি মোবাইল ফোনটিও বন্ধ করে দেন। চেয়ারম্যান সোহেল রানা বলেন, ‘ওই দীঘির সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি ভরাটের সঙ্গেও যুক্ত নই। প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন পুকুর ভরাট চলবে না। আমি কি ভরাট করতে পারি? তবে সোহরাব আলী আমার ঘনিষ্ঠ। এ জন্য হয়তো আমার নাম আসছে।’
আইনে পুকুর-দীঘি ভরাট নিষিদ্ধ থাকলেও সুখানদীঘি ভরাট করার বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর বোয়ালিয়া ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীন মিয়া বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সরেজমিনে লোক পাঠিয়ে দেখে এ বিষয়ে আমি পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’
শহরের ৯৫২টি পুকুর-দীঘি সংরক্ষণের এবং সুখানদীঘি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশের বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের সচিব মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘আদেশের কোন কাগজপত্র আমি দেখিনি। কাগজপত্র পেলে ব্যবস্থা নিতাম।’
রাসিকেরই তালিকায় সুখানদীঘি সংরক্ষণের জন্য চিহ্নিত করা হলেও এটি এখন ভরাটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা প্রকৌশল শাখা বলতে পারবে। আমি জানি না।’ রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, ‘দিন দিন তো সব পুকুর-দীঘিই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য ২২টি পুকুর-দীঘি সংরক্ষণের জন্য তালিকা করে একটি প্রকল্প আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এরমধ্যে সুখানদীঘিও আছে। প্রকল্পটি সবুজ পাতায় আছে, কিন্তু পাস হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটা পাস হয়ে গেলে আমরা দীঘিটা অধিগ্রহণ করে নিতাম। সরকার তো জনস্বার্থে অনেক প্রকল্প নেয়। জনস্বার্থের জন্য এটাও নিতে পারে। তাহলে আমরা শুধু সুখানদীঘিই নয়, ব্যক্তিমালিকানার অন্য পুকুর-দীঘি অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণ করতে পারতাম। তা না হলে মালিকেরা ভরাট করেই যাচ্ছেন। খুব একটা কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।’ রা/অ