সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৯:২৭ pm
এম এম মামুন :
দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় মাঠঘাট দাপিয়ে বেড়ানো ৭০ জন এমপি, মন্ত্রী কোনভাবেই নৌকার কান্ডারি হতে পারছেন না। আগামি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব ভিআইপি ব্যক্তি যে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন না তা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে। কারণ দলীয় হাইকম্যান্ড বিতর্কিত, জনবিচ্ছিন্ন এমপিদের বাদ দেওয়া এবং ক্লিন ইমেজ ও এলাকায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে নৌকার প্রার্থী করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ লক্ষ্যে দলের জাতীয় কাউন্সিলের আগে দুই দফা এবং কাউন্সিলের পরেও এক দফা মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট এখন দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনার টেবিলে জমা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই দীর্ঘ হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিতর্কিত মন্ত্রী-এমপির তালিকা। মন্ত্রী-এমপিদের ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টগুলোও এখন গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেসব রিপোর্টে অন্তত ১০ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের অপর ৬০ জন এমপির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের চিত্রই ফুটে উঠেছে।
গণভবন ও আওয়ামী লীগের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, এবার তাদের নিশ্চিত কপাল পুড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্যাতন, মামলা-হামলা করে হয়রানি, দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে ‘এমপি লীগ’-‘ভাই লীগ’ বলয় সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। তারা এলাকাবিমুখ, জনবিচ্ছিন্ন নেতায় পরিনত হয়েছে। নিয়োগ, টেণ্ডার বাণিজ্য, জলমহাল-বালুমহাল দখল, চাঁদাবাজি, লুটপাটের মাধ্যমে একেকজন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিনত হয়েছেন।
অনেকেই এমপি নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে ‘সন্ত্রাসী ও মাস্তান’ দিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। কারও কারও বউ, শ্যালক, ভাই, আত্মীয়স্বজন ‘ছায়া এমপি’ হয়ে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার নামে ভাগ বাটোয়ারায় ব্যস্ত থাকছে।
রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী। ’৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের শেষদিকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি। তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো দেখে বিস্মিত হয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। রাজশাহীর প্রতিষ্ঠিত এই ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে হয়েছেন এমপি, প্রতিমন্ত্রী, এমনকি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। অথচ তিনি তার নির্বাচনি এলাকা তানোর ও গোদাগাড়ীতে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন করছেন। এছাড়াও তিনি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করছেন তার আস্থাভাজন বসন্তের কোকিল নামে পরিচিত হাট ইজারাদার আবুল বাসার সুজনের দ্বারা।
এরচেয়েও জনবিচ্ছিন্ন, দলবিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা সাম্রাজ্য বানিয়ে বসেছেন হবিগঞ্জ ১ আসনের সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ। সাবেক মন্ত্রী মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজির সন্তান হিসেবে অনেকটা পৈতৃক সূত্রেই দলীয় মনোনয়ন নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বৈতরণী পার হন তিনি। কিন্তু এরপর থেকেই এলাকা বিমূখ হয়ে ঢাকাতেই ঘাঁটি গেঢ়ে বসেন। রাজনীতির ময়দানে কোনরকম ইমেজ না থাকা এই সংসদ সদস্য দলীয় কর্মকান্ডে অংশ নিতেও বিরক্তবোধ করেন। এলাকার নেতা কর্মিরা তার দেখা পায় না বললেই চলে। জনবিচ্ছিন্ন ও এলাকাবিমুখ হলেও এমপি মিলাদ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আখের গোছানোর লুটপাটে বেশ সিদ্ধহস্ত। এরইমধ্যে তিনি কুশিয়ারা নদীর তীর সংরক্ষণসহ বাঁধ নির্মান প্রকল্পের শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র জিম্মি করে তারই সহোদরদের দ্বারা বেশুমার বাণিজ্য চালিয়ে রীতিমত আঙ্গুল ফুলে টাকার কুমিরে পরিনত হয়েছেন মিলাদ। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই অর্থবিত্তে জেলার অন্যতম ধনাঢ্যে পরিনত হয়েছেন তিনি। গাজী মিলাদ এমপি সবচেয়ে সবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন সিলেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে। সেখানে নিজের বোন জামাইকে ভিসি নিযুক্ত করার পর পরই পরিবারের অন্তত ১৬ জনকে আসীন করেছেন সেখানে। টেন্ডার থেকে শুরু করে সব বাণিজ্যও হাতিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যেই দলীয় পর্যবেক্ষণ টিমের তিন দফা গোপন অনুসন্ধানেই গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদের বিরুদ্ধে অন্তহীন অভিযোগের সিংহভাগই প্রমানিত হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এছাড়াও আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ১৪ জন সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তাদের মধ্যে রয়েছেন হাজী সেলিম, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সামশুল হক চৌধুরী, ওমর ফারুক চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা প্রমুখ। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত, দুদকের অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এসব এমপির কাউকেই আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। দলীয় মনোনয়ন পেতে তাদের দুদক থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে হবে।
আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দলীয় অনেক এমপির মধ্যে দেখা দিয়েছে গা-ছাড়া ভাব। সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হলেও তারা এলাকায় যান না, খোঁজখবর নেন না নির্বাচনি এলাকার জনগণের। খোঁজখবর নেন না স্থানীয় নেতাকর্মীদেরও। তারা বেশিরভাগ সময় কাটান রাজধানী ঢাকায়। আবার কেউ বছরের দীর্ঘ সময় বিদেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ান। অথবা থাকেন নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখ দেখা বা শোনার সময় নেই তাদের।
একাধিক সূত্র জানা গেছে, আওয়ামী লীগের যেসব এমপি স্থানীয় নেতাকর্মী বা সাধারণ মানুষের খোঁজখবর কম নেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মোতাহার হোসেন (লালমনিরহাট-১), এইচএন আশিকুর রহমান (রংপুর-৫), উম্মে কুলসুম স্মৃতি (গাইবান্ধা-৩), আয়েন উদ্দিন (রাজশাহী-৩), আব্দুল কুদ্দুস (নাটোর-৪), নেছার আহমদ (মৌলভীবাজার-৩), গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ (হবিগঞ্জ-১), আনোয়ারুল আজীম (ঝিনাইদহ-৪), নাসির উদ্দিন (যশোর-২), কাজী নাবিল আহমেদ (যশোর-৩), পঞ্চানন বিশ্বাস (খুলনা-১), মীর মোস্তাক আহমেদ রবি (সাতক্ষীরা-২), আফম রুহুল হক (সাতক্ষীরা-৩), ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু (বরগুনা-১), তানভীর হাসান ছোট মনির (টাঙ্গাইল-২), আতোয়ার রহমান খান (টাঙ্গাইল-৩), ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল (ময়মনসিংহ-১০), মানু মজুমদার (নেত্রকোনা-১), নাইমুর রহমান দুর্জয় (মানিকগঞ্জ-১), কাজী কেরামত আলী (রাজবাড়ী-১), ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন (কুমিল্লা-আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী (চট্টগ্রাম-১৫), আশেক উল্লাহ রফিক (কক্সবাজার-২)সহ আরও কয়েকজন এমপি রয়েছেন যারা এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ কম রাখেন।
জাতীয় সংসদে কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ও দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে বলে দলটির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা মনে করেন। এসব ঘিরে সৃষ্ট আলোচনা সমালোচনায় গ্রহণযোগ্যতায় নাম উঠে এসেছে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক রওশন আলী মাস্টারের নাম। তাকে সামনে নিয়েই নৌকা প্রতীকের অগ্রযাত্রার স্বপ্ন দেখছেন তৃণমূল আওয়ামীলীগ। ফলে রাজী মোহাম্মদ ফখরুল আউট হচ্ছেন তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
কথায় কথায় মানুষের গায়ে হাত তোলাকে অভ্যাসে পরিণত করেছেন তিনি। তাঁর মারধর ও হামলা থেকে সাধারণ মানুষ, সরকারি কর্মচারী ও দলীয় লোকজনও রেহাই পাননি। এমন ঘটনাও ঘটেছে, তাঁর সালিস না মেনে আদালতে মামলা করায় এক কাঠ ব্যবসায়ীকে আদালতের বারান্দা থেকে তুলে এনে মারধর করেছেন। অন্যের জমি দখলের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তিনবারের এই সাংসদের বিরুদ্ধে। তিনি বরগুনা-২ (পাথরঘাটা, বামনা ও বেতাগী) আসনের সাংসদ শওকত হাচানুর রহমান। ২০১৩ সালে এই আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ গোলাম সবুর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে উপনির্বাচনে নৌকা প্রতীকে শওকত হাচানুর নির্বাচিত হন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের সাংসদ হন তিনি। তবে সাংসদ হাচানুর তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর ভাষ্য, স্থানীয়ভাবে তাঁর দুটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আছে, যাঁরা দলীয় মনোনয়ন চান। তাঁরাই ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষুদ্র বিষয়কে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছেন, যাতে তিনি দলীয় মনোনয়ন না পান। জমি দখলের কোনো ঘটনা তাঁর জানা নেই বলেও দাবি করেন তিনি। সাংসদ হাচানুরের সালিস না মেনে পাওনাদারের বিরুদ্ধে মামলা করেন কাঠ ব্যবসায়ী জালাল হাওলাদার। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ২১ জুন পাথরঘাটার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে তাঁকে তুলে সাংসদের কলেজ রোডের বাসভবনের কাছে নিয়ে মারধর করেন সাংসদ ও তাঁর লোকজন। এছাড়াও গত কয়েক বছরে নানারকম বিতর্কমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে হাচানুর রিমন দলীয় নেতৃবৃন্দকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন।
জামালপুর-৪ আসনের ডা. মুরাদ হাসানসহ প্রায় অর্ধশত এমপির নেতিবাচক কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দলের ভেতরে-বাইরে। এদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে জমা হচ্ছে অভিযোগের স্তূপ। বেশির ভাগ এমপির বিরুদ্ধে দলে ‘মাইম্যান’ তৈরি, নিজ এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার, অসদাচরণ, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, দলীয় পদ-পদবি নিয়ে বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এবার ‘গডফাদার’ ও ‘জনবিচ্ছিন্ন’ সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেসব এমপির বিরুদ্ধে এলাকায় খুন, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, ঋণ খেলাপি, টেন্ডার-চাঁদাবাজিসহ দখলদারিত্বের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তারা কেউ মনোনয়ন পাবেন না। সূত্র জানায়, তাদের সকলের আমলনামা যাচাই-বাছাই শেষে মনোনীতদের তালিকায় স্থান দেবেন দলের হাইকমান্ড। বাকিদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন জুটছে না বলেই আভাস দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন পার্টির নীতিনির্ধারকরা। দল ও সরকারের ইমেজ ক্ষুন্নকারীরা আছেন বাদ পড়ার তালিকায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে দলীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে ৩য় বারের মতো মাঠ জরিপের কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম জানিয়েছেন, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই এই মাঠ জরিপের কাজটি তদারকি করছেন। এই মাঠ জরিপের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই তিনি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন। সূত্র : দেশ বাংলা