মঙ্গবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৮:৪৬ pm
ডেস্ক রির্পোট : দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ এর নাম। এর মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করে বারান্দা দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে গ্যালারির ডানপাশের দেয়ালে বড় বড় কয়েকটি কাচের ডিসপ্লে বোর্ড।
এগুলোতে মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা, বীরত্বপূর্ণ ও অসামান্য অবদানের জন্য বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-পরিচয় লেখা। এ তালিকা আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যায় জড়িত আত্মস্বীকৃত ও আদালতের রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামও।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কান্ডে রীতিমতো হতবাক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় যে কোনো সিদ্ধান্ত প্রজ্ঞাপন বা গেজেট আকারে জারির প্রথম দিন থেকেই তা কার্যকর করতে হবে। এটিই নিয়ম। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যায় জড়িত ও আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলের পর এখনো তাদের নাম-ছবি বা উপাধিসংবলিত বোর্ড ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’র মতো জায়গায় রাখাটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। তারা তো স্বাধীনতাবিরোধী ছিল। তা হলে তাদের কৃতিত্ব কেন প্রদর্শন করা হচ্ছে! রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে এগুলো থাকতে পারে না। এর দায় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই।’
ডিসপ্লে বোর্ডে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারি এটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় স্মৃতি সংগ্রহশালাটি। একই বছরের ৬ মার্চ তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা আবুল ফজল সংগ্রহশালাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শহীদ শিক্ষকপত্নী বেগম ওয়াহিদা রাহমান, বেগম মাসতুরা খানম ও শ্রীমতী চম্পা সমাদ্দার ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রহশালার স্থায়ী প্রদর্শনী গ্যালারির উদ্বোধন করেন। শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় মোট তিনটি গ্যালারি আছে।
দুটি দেয়ালে আটটি ডিসপ্লে বোর্ড রয়েছে। পাঁচ ইঞ্চি বাই পাঁচ ইঞ্চি এমএম মাপের কাচের তৈরি বোর্ডগুলো। প্রথম গ্যালারির দেয়ালে সাঁটানো বোর্ডে আছে ‘বীরবিক্রম’ খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। এখানে লম্বা লম্বা দুটি কাচের দুটি বোর্ডে লেখা আছে খেতাবপ্রাপ্তদের নাম, সেক্টর, পদবি ও গেজেট নম্বর। দ্বিতীয় গ্যালারির দরজায় টাঙানো আছে জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের ছবি।
এর ঠিক পাশেই দেয়ালে বসানো হয়েছে দুটি বোর্ড। এখানে ‘বীরউত্তম’দের নাম ও পরিচয় লেখা। এর একটি বোর্ডের তালিকার তিন নম্বরে আছে জিয়াউর রহমানের নাম। তার নামে পাশে লেখা- অধিনায়ক, জেড ফোর্স। পদবি- লে. জেনারেল। এর পাশের বোর্ডটিতে সাত ‘বীরশ্রেষ্ঠ’র তালিকা। তার পরে আরও সারি সারি তিনটি বোর্ডে ডিসপ্লে করা হয়েছে ‘বীরপ্রতীক’দের নাম। ‘বীরপ্রতীক’দের তালিকার ১৭ নম্বরে আছে লে. কর্নেল এএম রাশেদ চৌধুরীর নাম। এ তালিকার ৭৯ নম্বরে আছে নায়েব সুবেদার মোসলেহ উদ্দিন খানের নাম। রাশেদ চৌধুরী ও মোসলেম উদ্দিন খান বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ৬ জুন জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদ-প্রাপ্ত চার খুনির মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিল করে সরকার। এর ফলে লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিমের ‘বীরউত্তম’, লে. কর্নেল নূর চৌধুরীর ‘বীরবিক্রম’, লে. এএম রাশেদ চৌধুরীর ‘বীরপ্রতীক’ এবং নায়েক সুবেদার মোসলেম উদ্দিন খানের ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব বাতিল হয়।
ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের হত্যা মামলায় আত্মস্বীকৃত খুনি এই চারজনের এসব খেতাব বাতিল করা হলো। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মনে করে, খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় বঙ্গবন্ধুর এই চার খুনির নাম থাকা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ১৮ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক আনন্দকুমার সাহা। এ সময় তিনি শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে তালিকাসংবলিত বোর্ডগুলো বসানোর উদ্যোগ নেন। বোর্ডের জন্য খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংগ্রহের কাজটি করেন চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক আমিরুল মোমেনীন চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘প্রোভিসি (আনন্দকুমার সাহা) স্যার আমাকে ডেকে কাজটি করতে বলেছিলেন। এ জন্য অবশ্য কোনো কমিটি বা টেন্ডার করা হয়নি। আমি আর আরেকজন মিলে ডিজাইন করেছিলাম। তবে নামগুলো লেখার সময় মেজর ডালিমের নামটি আমি বাদ দিয়েছিলাম। জিয়াউর রহমানের নামও বাদ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফাইনালি বাদ দেওয়া হয়নি। আর বোর্ডে থাকা মোসলেহ উদ্দিন খান ও রাশেদ চৌধুরী- এরাই বঙ্গবন্ধুর সেই খুনি কিনা, সেটি আমরা বুঝতে পারিনি।’
তবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘরের মতো জায়গায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নাম ও বীরত্বগাথা লেখা থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতিন্ডলীর সদস্য অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম।
তিনি বলেন, ‘খেতাব বাতিলের আগে বোর্ডগুলো বসানো হলেও গেজেট প্রকাশের পর পরই তা ফেলে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটি করেনি’। নামগুলো দ্রুত মুছে ফেলা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার কিউরেটর ড. সফিকুল ইসলাম বলেছেন, খেতাবপ্রাপ্তদের গেজেট দেখেই নাম লেখা হয়েছে। পরে তাদের খেতাব বাতিলের গেজেট প্রকাশ হয়েছে কিনা, তা জানা নেই।
তবে সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দকুমার সাহা বলেন, ‘বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নাম রাখাটা আমাদের ভুল হয়েছে। এটি অনিচ্ছাকৃত। শিগগিরই অপসারণ করা হবে।’
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, সংগ্রহশালায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নাম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় থাকার বিষয়টি জানা নেই। এটি সম্ভবত আগের উপাচার্যের আমলে হয়েছে। তবে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্র : আমাদের সময়