শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:৪১ am
এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের আধিপত্য একচ্ছত্র। তাদের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে নাজেহাল বিরোধীরা। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি মাঝেমধ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নানাবিধ কারণে তাদের নেতা-কর্মীরা মাঝে মাঝে রণে ভঙ্গ দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান গ্রহণের নীতি অনুসরণ করেছে। ফলে বিএনপি একটা বিবৃতিনির্ভর দলে পরিণত হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়ার পর বিএনপি কার্যত দুর্বল হয়ে যায়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনিও একাধিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এই দুই ‘দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি’কে মূল নেতৃত্বে রেখে দলকে চাঙা করা সম্ভব হয়নি।
প্রায় ১৬ বছর ধরে তারা ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। এখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে দলটি রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায় ফেরার আপ্রাণ লড়াইয়ে ব্যস্ত। বিএনপির এই গা-ঝাড়া দিয়ে মাঠে নামার ঘটনা রাজনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি প্রায় ১৬ মাস। নির্বাচনকে ঘিরে এরই মধ্যে রাজনীতিতে ফিরে এসেছে উত্তাপ। গত তিন সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, পালটা-পালটি ধাওয়া ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো জেলায় হামলার ঘটনা ঘটছে। হামলা করা হচ্ছে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধনের মতো কর্মসূচিতে। কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হচ্ছে। কোথাও আবার একই জায়গা ও একই সময়ে পালটা-পালটি কর্মসূচি ডাকছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। হামলায় দলীয় অফিসের পাশাপাশি নেতাদের বাড়িঘর ও ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানও রক্ষা পাচ্ছে না। এতে দলটির শত শত নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। ভোলা, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন বিএনপি কর্মীর মৃত্যুও হয়েছে। সব মিলিয়ে তৃণমূলের রাজনীতি হঠাৎ সংঘাত-সংঘর্ষময় হয়ে উঠছে।
ক্ষমতাসীনরা যে বিএনপিকে সহজে রাজপথ ছেড়ে দেবে না, তা বলাই বাহুল্য। ক্ষমতায় থাকার জন্য যা করার, তারা তাই করবে। আপাতত গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় যেতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। সেই লক্ষ্যে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে আনার চেষ্টাসহ মাঠেও কড়া দৃষ্টি রেখেছে দলটি, নিয়েছে নানা কৌশল। কম যাচ্ছে না বিএনপিও। সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে মাঠ দখলের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
প্রধান দুই দলের দ্বৈরথের মধ্যে বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির (জাপা) কর্মকাণ্ড রহস্যাবৃত। সম্প্রতি জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের অনুসারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। দুটি পক্ষই দলে নিজেদের আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারে চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত টানা যাচ্ছে না। ছোট ছোট দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি সরকারবিরোধী একটা বড় প্ল্যাটফরম গড়তে চাইছে। এ ব্যাপারে গোপন তৎপরতা চলছে বলেও খবর মিলছে।
রাজনৈতিক ময়দানের এমন দৃশ্যপটের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন পরবর্তী সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দফায় দফায় সংলাপ করে ১৪ সেপ্টেম্বর আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। এর আগে দেড় শ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের কথা জানিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ১৯ সেপ্টেম্বর ২ লাখ নতুন ইভিএম কেনার প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সংস্থাটি।
ইসির প্রস্তুতির সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে দল গোছানোর পাশাপাশি নানা কৌশল নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচন কঠিন হবে মেনে মাঠেও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে দলটি। দলের নেতারা বলছেন, প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি দলীয় নেতাদের মাধ্যমে বর্তমান সংসদ সদস্য এবং মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আমলনামা যাচাই-বাছাই চলছে। এমপিদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের বাদ দিয়ে নাকি সৎ, যোগ্য, জনপ্রিয় ও দক্ষ প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হবে।
তবে আওয়ামী লীগের জন্য এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। আগের দুটি নির্বাচন (২০১৪ ও ২০১৮) নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এবার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ রয়েছে। এই তাগিদ থেকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে বিএনপির একটি অংশ ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে গোপনে বৈঠক করেছে বলেও খবর রটেছে।
শাসক দলের নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা শুরু হলেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান এখনো বদলায়নি বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, এই সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নেবে না তারা। তাদের দাবি, বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নিরপেক্ষ ওই সরকার যে নির্বাচন কমিশন করবে, সেই কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে, সেখানে তারা অংশ নেবে।
এসব দাবি আদায়ে বর্তমান সরকারের পতনের বিকল্প কিছু নেই মেনে বিএনপি আন্দোলন করছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, এই আন্দোলনের সঙ্গে সমমনাদের সমর্থনও রয়েছে।
তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির মাঠ দখলের কৌশল খুব সহজে বাস্তবায়ন হবে বলে মনে হয় না। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে স্বল্প পরিসরে হলেও মাঠে থাকার সুযোগ হয়তো দেয়া হবে, কিন্তু মাঠ দখলের চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করবে ক্ষমতাসীনরা। আর এটা যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ঘটবে, তা কিন্তু নয়। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় দলীয় মনোনয়ন ও আধিপত্য ধরে রাখতে স্থানীয় নেতারাই বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেবেন। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল সামনে রেখেও অনেকে নিজেদের শক্তি ও উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে যেসব এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটেছে, অত্যুৎসাহী স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই এসব ঘটনা ঘটিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির চলমান সম্পর্ক নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির সমমনাদের অনেকে অস্বস্তিতে রয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও মিত্রের সংখ্যা কমছে। ২৩ দফার ভিত্তিতে ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে সক্রিয় ছিল তারা। ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সময় তারা জোটকেও ধরে রেখেছে। জোটের দলগুলোর মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার ক্ষোভ থাকলেও সেটা নানাভাবে ম্যানেজ করেছে ক্ষমতাসীনরা। তবে নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে, শরিক দলগুলোর সঙ্গে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তত বাড়বে। ইতিমধ্যে গত ২৪ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ। একই সঙ্গে তিনি অন্য শরিকদেরও জোট ছাড়ার আহ্বান জানান। সমমনা দলগুলোকে পাশে রাখতে আওয়ামী লীগও নিশ্চয়ই চেষ্টা করে যাবে।
তবে রাজনীতির মাঠে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কেউই কিন্তু স্বস্তিতে নেই। আওয়ামী লীগের যেমন গ্রহণযোগ্যতার সমস্যা রয়েছে, স্বৈরতন্ত্রী হয়ে ওঠার বদনাম রয়েছে, বিএনপিরও রয়েছে আস্থার সংকট। তারা বড় বড় কথা বললেও আন্দোলনে ক্ষমতাসীনদের কতটুকু ঘায়েল করতে পারবে, তা নিয়ে রয়েছে বড় সংশয়। এর আগে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিল। তাদের তখন দাবি ছিল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করা তো দূরের কথা, কোনো কার্যকর আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেনি। বরং নির্বাচনের আগে ও পরে যে রাজনৈতিক সহিংসতা ও আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে, তার দায় পড়েছে দলটির ওপর।
এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে নানা নাটকীয়তার পর বিএনপি অংশ নিয়েছিল কয়েকটি দলের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। সেই নির্বাচনে বিএনপি আসন পেয়েছে মাত্র পাঁচটি। আর তাদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিবেচনা করলে সব মিলিয়ে মাত্র সাতটি।
বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে বাধ্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বাস্তবায়ন করবে- এ ব্যাপারে প্রবল আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো বাস্তব কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার একই কায়দা অবলম্বন করে অতীতের মতো এবারও আওয়ামী লীগ পার পাবে, এমন গ্যারান্টিও দেয়া যাচ্ছে না। তবে বিএনপি যে আসন্ন শীতে মাঠ দখলের মরিয়া চেষ্টা চালাবে এবং সেই চেষ্টাকে নস্যাৎ করতে ক্ষমতাসীনরা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা মোটামুটি নিশ্চিত। তার মানে রক্তপাত, সংঘাত, সংঘর্ষ আর অনিশ্চয়তা ছাড়া আপাতত রাজনীতির অন্য কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।