রবিবর, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:৫৮ am
ডেস্ক রিপোর্ট : জব্বার মোল্লাহর বয়স ৬৭ বছর। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। যার নেশা শুধু চুরি করা। কিশোর বয়সে এ কাজের হাতেখড়ি তার। সে সময় বাসা-বাড়ির ছাদে শুকাতে দেয়া কাপড় চুরি করতো। পরে ধীরে ধীরে হাত পাকতে থাকে। এরপর পুরোদমে নেমে পড়েন এ কাজে। পেশা হিসেবে চুরিকেই বেছে নেন তিনি।
নিজের সহযোগীদের নিয়ে বিভিন্ন লেবাস ধরে গত ৫০ বছর ধরে রাজধানীর বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে চুরি করে আসছেন জব্বার। শুধু তাই নয়, চুরির টাকায় গাজীপুরে গড়েছেন অনেক সম্পদ।
জব্বারের দলের সবাই বয়স্ক। মাথায় টুপি, পরনে থাকতো পাঞ্জাবি। পরিপাটি সাজে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াত তারা। যাতে প্রথম দেখায় তাদের কেউ সন্দেহ করতে না পারে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে চুরি করতেন তারা।
রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার এক বাসায় চুরির ঘটনার ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে জব্বার মোল্লাসহ তার দলের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ।
তারা হলেন, আজিমুদ্দিন (৫২), জামাল (৪৪), আবুল (৫০) । তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে চোরাই স্বর্ণালঙ্কার বিক্রিতে সহায়তার অভিযোগে আনোয়ার হোসেন (৪৪) আব্দুল ওহাব (৪৫) নামে দুই স্বর্ণালঙ্কারের দোকান মালিককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রায় নয় ভরি স্বর্ণ ও ৮২ ভরি রূপা, নগদ প্রায় ১৭ লাখ টাকা, দরজা ভাঙার যন্ত্রপাতি এবং মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
আজ রোববার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, গত ১৭ আগস্ট খিলক্ষেত থানাধীন নিকুঞ্জ-২ এর ১৫ নম্বর রোডে এক চিকিৎসক দম্পতির বাসায় দিনের বেলায় চুরি হয়। চোর চক্রের সদস্যরা তৃতীয় তলার দরজা ভেঙে ঘরের ভেতরে ঢুকে আলমারির ভেঙে ৪২ ভরি স্বর্ণ ও চার হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে যায়। থানা পুলিশের পাশাপাশি এই ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে গুলশান বিভাগের গোয়েন্দা পুলিশ।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় তারা জানতে পারে গত শনিবার পল্লবীর একটি বাসায় চুরি করার পরিকল্পনা করেছে চোর চক্র। এই তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা ছদ্মবেশে ওই এলাকায় অবস্থান নেয়। দুপুরের দিকে চোর চক্রের সদস্যরা পল্লবীর একটি বাসার তিন তলায় চুরি করতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের আটক করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্বর্ণালঙ্কার বিক্রিতে সহায়তাকারী দুই জুয়েলারি দোকানের মালিককেও গ্রেপ্তার করা হয়।
গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কামরুজ্জামান সরদার বলেন, ‘এই চোর চক্রের সদস্যরা ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় থাকে। তারা নির্দিষ্ট দিনে সবাই ঢাকার একটি জায়গায় এসে মিলিত হয়। তারপর কোনো আবাসিক এলাকায় একসঙ্গে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে যে বাড়িতে দারোয়ান নেই বা নিরাপত্তা ঘাটতি আছে, সেটি টার্গেট করে দিনের বেলায় চুরি করতে উঠে যায়। টুপি-পাঞ্জাবি পরিহিত দাড়ি মুখের মুরুব্বিদের দেখে কেউ সন্দেহ করে না। এই সুযোগে তারা বিশেষ কৌশলে ঘরের তালা ভেঙে চুরি করে নিয়ে যায়।’
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মুরুব্বি চোর চক্রের দলনেতা জব্বার মোল্লাহ। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীতে। কিশোর বয়স থেকেই সে ঢাকার কারওয়ানবাজার এলাকায় ভবঘুরে হিসেবে চুরি করা শুরু করে। প্রথম দিকে সে বিভিন্ন বাসা-বাড়ির ছাদে শুকিয়ে দেওয়া কাপড় চুরি করত। ধীরে ধীরে তার সঙ্গী হয় আজিমুদ্দিন, জামাল, আবুলসহ আরও অনেকেই। চুরির টাকায় গাজীপুরে জমি কিনে বাড়ি করেছেন জব্বার। সেই বাড়ি থেকে ভাড়াও পান তিনি। বর্তমানে তার চার স্ত্রী।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, এই চোর চক্রের সদস্যরা প্রায় ৫০ বছর ধরে চুরি করে আসছে। চক্রের সদস্যরা ঢাকার আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় বাস করে। চুরিটাকেই তারা পেশা হিসেবে নিয়েছে। এজন্য প্রায় প্রতিদিনই তারা ঢাকায় এসে মিলিত হয়ে ঘুরতে থাকে। বাসা টার্গেট করে প্রথমে দুই জন ভেতরে ঢুকে। দুই জন বাসার বাইরে থেকে পাহারা দেয়। দরজা ভাঙার পর বাকিরা বাসায় ঢুকে চুরি করে একে একে বের হয়ে যায়। সারা দিন চুরি করে সন্ধ্যায় তারা আবার নিজ নিজ বাসায় ফিরে যায়।
পুলিশ কর্মকর্তা কামরুজ্জামান সরদার জানান, চোর চক্রের সদস্যদের আদালতে সোপর্দ করে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাদের অন্যান্য সহযোগীদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
চোরাই স্বর্ণালঙ্কার কিনে নেয় জুয়েলারির মালিকরা
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, চোর চক্রের সদস্যরা চুরি করা স্বর্ণালঙ্কার নির্দিষ্ট একটি বা দুটি জুয়েলারির দোকানে বিক্রি করে। জুয়েলারির মালিকরাও জানে এসব চোরাই স্বর্ণালঙ্কার। কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রির লোভে চুরির স্বর্ণালঙ্কার জেনেও এক শ্রেণির অসাধু জুয়েলারি মালিকরা তা কিনে নিচ্ছে। গ্রেপ্তার হওয়া দুই জুয়েলারি মালিক আনোয়ার ও ওহাব চোরাই স্বর্ণালঙ্কার কেনার কথা স্বীকার করেছেন।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, জুয়েলার্স সমিতির উচিত তাদের সদস্যরা কোথা থেকে, কার কাছ থেকে, কীভাবে স্বর্ণ কিনছে, তা যথাযথ ভাউচারের মাধ্যমে এবং বৈধ উৎস থেকে স্বর্ণ কিনছে কি-না, তা যাচাই করা। অবৈধ উৎস থেকে স্বর্ণের কেনাবেচার কারণে অনেক ক্ষেত্রে চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, অপহরণ, খুনের মতো অপরাধের সংশ্লিষ্টতা থাকে।
জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা সতর্ক না হলে তাদেরও ধারাবাহিকভাবে চোরাই বা ডাকাতির স্বর্ণ কেনাবেচার কারণে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সূত্র : দৈনিক বাংলা