শুক্রবার, ২০ েপ্টেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:৩৯ pm

সংবাদ শিরোনাম ::
দুদকের তালিকায় ১০০ ব্যক্তির সম্পদের পাহাড় গড়েছেন যারা আ.লীগ ১৪ দলীয় জোটের নেতা ও মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে ৭৫০ মামলা ঢাবিতে সব ধরনের রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিখোঁজের সাতবছর পর ছেলেকে ফিরে পেলেন উচ্ছ্বসিত মা তানোরে আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত রাসিকের সাবেক কাউন্সিলর মনসুরের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন সেই রুবেল আরও ৭ দিনের রিমান্ডে সিলেবাস সংক্ষিতের দাবিতে রাজশাহীতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শেষে সমাবেশ পবায় উপজেলা প্রশাসনে ও কাটাখালি পৌরসভায় ভোগান্তি চিত্র নায়িকা পরীমণি পালন করলেন ‘বিবাহ বিচ্ছেদ’ দিন এক দফা দাবিতে রাজশাহীতে নার্সদের মিছিল শেষে মানববন্ধন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ববাসীর জন্য রহমত : দুধরচকী রাজশাহীতে শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন ডলার সংকটে বাংলাদেশকে সার দিচ্ছে না সরবরাহকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ড. ইউনূসের নাগরিক সংবর্ধনা বাতিল রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বিচারিক ক্ষমতা পেলো সেনাবাহিনী আন্দোলনের মুখে অবশেষে পদত্যাগ করলেন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ বাগমারায় অধ্যক্ষ ও সভাপতির অনিয়মের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি গুজব : আসিফ মাহমুদ একদিনের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা রাজশাহী আসছেন আজ
৭০ সালেই ‘দৈনিক পাকিস্তান’ কার্যত ‘দৈনিক বাংলাদেশ’ হয়ে যায়

৭০ সালেই ‘দৈনিক পাকিস্তান’ কার্যত ‘দৈনিক বাংলাদেশ’ হয়ে যায়

এই সাক্ষাৎকারটি ২০২০ সালের মার্চ মাসে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ থেকে অনুদানপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ শীর্ষক গবেষণার জন্য নেয়া হয়। দৈনিক জনকণ্ঠ ভবনে বসে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ।

মিনহাজ: ১৯৭১ সালে আপনি ‘দৈনিক পাকিস্তান’ সংবাদপত্রের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। পত্রিকাটি তখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ছাপা হতো, ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্টের অধীনে ছিল। মার্চের শুরুর দিকে বাংলাদেশের স্বাধীকার বা অসহযোগ আন্দোলনের প্রশ্নে এই সংবাদপত্রটির অবস্থান বা ভূমিকা কেমন ছিল?

তোয়াব খান: ১৯৭১ সালের মার্চের গণ-আন্দোলনের শুরুতে ‘দৈনিক পাকিস্তান’ কার্যত ‘দৈনিক বাংলাদেশ’-এ পরিণত হয়েছিল। ওই সময়ে পত্রিকাটিতে দুটি বিষয়ের সমন্বয় ছিল। একটা হচ্ছে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সংবাদ প্রকাশ। কারণ, এটা না করলে কাগজ টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। একই ভবনে অবস্থান হওয়ায় সে সময় দৈনিক পাকিস্তানও পুড়ে গিয়েছিল। সুতরাং দৈনিক পাকিস্তানে যারা কাজ করতেন তারা কোনো অবস্থাতেই চাইতেন না, কাগজটার ভূমিকা যাতে কোনো অবস্থাতেই জনবিরোধী হয়। কারণ জনবিরোধী সংবাদ ছাপা হলে জনগণ আবারও অফিসটি পুড়িয়ে দিতে পারে। এ জন্য ১৯৬৯-এর পর থেকে পত্রিকাটিতে ক্রমান্বয়ে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। যেমন- ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা ধারাবাহিক স্টোরি ছাপা হয়েছিল। এটা প্রায় টানা দেড় মাস ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত ‘এ দেশেই জন্ম আমার…’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। ফজলে লোহানী সাহেব ছিলেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, খুবই গুণী মানুষ। তিনি এই ধারাবাহিকটি লিখেছিলেন। ধীরে ধীরে দৈনিক পাকিস্তান-এর ওপর প্রেস ট্রাস্টের খবরদারি কমতে থাকে। বরং মানুষের চাহিদার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা ছিল।

১৯৭১-এর মার্চের আন্দোলন শুরুর পর ঢাকা থেকে সংবাদপত্র অন্যান্য জেলা শহরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ ট্রেন, বাস, প্লেন চলাচল বন্ধ ছিল। ঢাকার আশপাশে মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর- এসব অঞ্চলে পত্রিকা যেত। তখনকার মানুষের যা যা চাহিদা এবং আন্দোলনের যেসব কর্মসূচি ছিল, সেগুলো সিম্বলিক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রতিফলন ঘটানো হয়। যেমন- ‘বঙ্গবন্ধুর তর্জনী’- এটা কর্মী-সমর্থকদের জন্য একটা নির্দেশ। এভাবে আওয়ামী লীগের বা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ প্রকাশ করা হতো। এভাবেই পত্রিকাটি কার্যত ‘দৈনিক বাংলাদেশ বা দৈনিক বাংলা’য় পরিণত হয়েছিল। এটা হয়েছিল ১৯৭০ সালেই।

মিনহাজ: ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর ‘দৈনিক বাংলা’ হয়ে যাওয়ার এই বিষয়টি মার্চ থেকে, নাকি তারও আগে থেকেই হয়েছিল?

তোয়াব খান: আমি বলব এটা ১৯৭০-এর ১ জানুয়ারি থেকে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগেই ১ জানুয়ারি থেকে ইয়াহিয়া খান পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিটি চালু করলেন। তারপর থেকেই দৈনিক পাকিস্তান রাজনৈতিকভাবে ধীরে ধীরে ঘুড়ে দাঁড়ায়। গণমানুষ, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের পক্ষে চলে আসে।

মিনহাজ: হোটেল পূর্বাণী থেকে বঙ্গবন্ধু ১ মার্চই ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ৭ই মার্চ ভাষণ দেবেন। এই ভাষণ কাভারের জন্য ৬ মার্চ আপনারা কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

তোয়াব খান: সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধু যা বলবেন, যেভাবে বলবেন, মূল যে নির্দেশনা দেবেন- সেগুলোই ছাপা হবে, কোনো কিছুই বাদ যাবে না। বড় পরিসরে, গুরুত্বসহকারে ছাপা হবে। ৮ মার্চের সংবাদপত্র দেখলে দেখবেন, ‘সংগ্রাম চলবেই’ এই মূল শিরোনামের সংবাদ যেমন এসেছে। ঠিক তেমনি মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এটাও নিউজে এসেছে। মূল শিরোনামের ওপরে চারটি ব্লকে ছোট ছোট করে বঙ্গবন্ধুর চারটা শর্তও প্রকাশ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রকাশই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য।

মিনহাজ: ৮ মার্চের পত্রিকায় আপানারা ছেপেছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুর্নিবার তর্জনী তুলে ঘোষণার ছবি। পত্রিকাজুড়ে প্রায় সাত কলামে ছবিটি ছেপেছিলেন। আমি জানতে চাই ৭ই মার্চ দৈনিক পাকিস্তান-এর নিউজ রুমের পরিস্থিতিটা কেমন ছিল?

তোয়াব খান: তখন দৈনিক পাকিস্তান-এ প্রতিদিন সকালে রিপোর্টার, নিউজ এডিটর, চিফ রিপোর্টার ও সাব-এডিটরদের নিয়ে মিটিং হতো। সেখানে সিদ্ধান্ত হতো কী কী নিউজ যাবে। কোন রিপোর্ট কীভাবে কাভার করা হবে ইত্যাদি। ৭ই মার্চের ওই সকালে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যা যা হবে, যেভাবে হবে, যতটা সম্ভব ঠিক সেভাবে তুলে ধরা হবে।

মিনহাজ: ৮ মার্চের পত্রিকায় শেষের পাতায় আপনারা সাতটি ছবি ছেপেছিলেন। যেখানে ছিল বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর ছবি, মানুষের হাতে লাঠি, পতাকা হাতে নারী, লাঙ্গল কাধে কৃষকদের ছবি ইত্যাদি। এর পেছনে কি আপনাদের আলাদা কোনো পরিকল্পনা ছিল?

তোয়াব খান: সাংবাদিকতায় একটা কথা আছে ‘এক হাজার শব্দের চেয়েও একটি ছবি অনেক বেশি কার্যকর’। আর সে কারণেই সারা বিশ্বের প্রথম সারির ও পাঠকপ্রিয় সংবাদপত্রগুলো তাদের সংবাদপত্রের পাতাতে ফটোগ্রাফিক রিফ্লেকশন রাখার চেষ্টা করে। আমরাও সেই চেষ্টা করতাম। তবে এক্ষেত্রে দৈনিক পাকিস্তান-এর একটা সুবিধা ছিল। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় আমাদের অফিসটি পুড়ে যাওয়ার পর আমরা পত্রিকা ছাপানোর জন্য নতুন যন্ত্রপাতি পাই। আধুনিক সুবিধাসংবলিত প্রেস। এতে আমরা ছবি ভালো করে ছাপতে পারতাম। যুদ্ধের কিছু আগে থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় ছবির ব্যবহার বাড়তে থাকে।

আমি আপানার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়ার আগে একটু পুরাতন কথাতে আসি। ১৯৭০ সালে উপকূলে একটা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়। ১২ নভেম্বর। সাইক্লোন হওয়ার পর আমরা চিন্তা করলাম ছোট ছোট ছবি দিয়ে যদি ফিচার করা যায়, তাহলে একটা ভালো ফল পাব। পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করা যাবে। ওই সাইক্লোনটি ছিল ভয়াবহ। লাখ লাখ মানুষ মারা যান। উপকূলের অনেক লোকালয় এতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। পাঠককে আকৃষ্ট করার জন্য আমরা এই সাইক্লোনের বড় বড় ছবি ছাপানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। আমরা সফল হয়েছিলাম। দেখা গেছে, একটা লাশ পড়ে আছে, তার ওপরে একটা মরা সাপ পড়ে আছে। অর্থাৎ একটা সাইক্লোন মানুষ ও সাপ- উভয়ের জীবন শেষ করে দিয়েছে। মূলত ওই সাফল্য থেকেই আমরা ৮ মার্চের পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ফটোফিচার করার সিদ্ধান্ত নিই।

মিনহাজ: ওই সময়ে অন্যান্য পত্রিকার ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

তোয়াব খান: ইংরেজি পত্রিকা দ্য পিপল মোটামুটিভাবে জনগণের পক্ষে ছিল। এটি আওয়ামী লীগের এক অর্থে মুখপত্র ছিল। বাংলা যারা পড়তে পারতেন না, তাদের কাছে পত্রিকাটি জনপ্রিয় ছিল।

মিনহাজ: বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ টেলিভিশনে প্রচার হয়নি। আমরা বড় একটা শট অর্থাৎ ওপর থেকে তোলা একটা ছবি দেখি, এই ভিডিওটা পাকিস্তানের ডিএসপি (বর্তমানে ডিএফপি) নামের প্রকাশনা সংস্থাটি করেছিল, নাকি অন্য কেউ?

তোয়াব খান: এ বিষয়ে দুই ধরনের তথ্য আছে। মূলত কাজও করেছিল আলাদা দুটি পক্ষ। পুরো সমাবেশের যে ছবিটা ওপর থেকে তোলা, সেটা ডিএসপির তরফ থেকে ধারণ করা হয়েছিল। আবুল খায়ের নামের একজন ব্যক্তি ওই সময় ডিএসপিতে কাজ করতেন। উনি অভিনয়ও করতেন। আরেকটা বেসরকারি কোম্পানি অডিও রেকর্ডিং করেছিল, সেখানে কলিম শরাফি সাহেবও কাজ করতেন। তার আগেই কলিম শরাফিকে টেলিভিশন থেকে সরিয়ে দেয়ার পর উনি ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। তারা জয় বাংলা রেকর্ড বের করেছিলেন। যাই হোক যত দূর আমি জানি, ছবিটা ডিএসপির প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে না, ব্যক্তিগত তরফ থেকে তোলা হয়েছিল।

মিনহাজ: যতটা জানি, ২৫ মার্চের কালরাতে আপনি ইত্তেফাকের সিরাজুদ্দীন হোসেনকে বলেছিলেন, আপনারা (দৈনিক পাকিস্তান) পত্রিকা বের করতে পারছেন না। আপনার কাছে ওই রাতের ঘটনাপ্রবাহ একটু জানতে চাই।

তোয়াব খান: ২৫ মার্চ রাত ১০টার কিছু আগে থেকে আর্মি ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এরপর গোলাগুলির আওয়াজ হতে থাকে। আমাদের অফিসে শ্রমিক লীগের নেতা মান্নান এসেছিলেন। উনি যে হঠাৎ কোথা থেকে এসে উদয় হলেন তা আমি আজও বুঝতে পারিনি। উনাকে বললাম, কী বুঝলেন, কী চলছে? উনি বললেন, শুরু হয়ে গেছে। আমরা আর ফিরছি না। আমরা চলে যাচ্ছি। এই বলে উনি চলে গেলেন। আমরা তখন অফিসে বন্দি। বন্দি এজন্য যে, চতুর্দিকে গোলাগুলি। কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। আমাদের একই ভবনে ছিল মর্নিং নিউজের অফিস। মর্নিং নিউজে শহীদুল ইসলাম নামের একজন সাংবাদিক কাজ করতেন। পরে তিনি বাংলাদেশ টাইমসের এডিটর ছিলেন। শহীদুল হক ভীষণ মুসিবতে ছিলেন। কারণ, তার পরিবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের কাছে থাকত। রাজারবাগ এলাকাতেই বেশির ভাগ গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমরা ওই দিন যে পত্রিকাটি ছাপানোর জন্য তৈরি করেছিলাম, সেটি ওই দিন ছাপা হয়নি (২৬শে মার্চ)। তবে অনেক পরে ওই পত্রিকাটি ছাপা হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের কিংবা এরশাদের শাসনামলের দিকে।

মিনহাজ: ২৫ মার্চের পরের দিনগুলো আপনার কেমন কেটেছিল? তখন তো সবকিছু পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষের কঠোর নিয়ন্ত্রণে ছিল।

তোয়াব খান: তখন সময়গুলো ছিল আতঙ্কের। ১৯৭১ সালের মে মাসের এক বিকেলের কথা উল্লেখ করতে চাই। ওই দিন সকালে আমরা অফিসে যাই। কাজ শেষে বাসায় ফিরে বিকেলের দিকে আমি বিশ্রাম করছিলাম। এমন সময় আমাদের পত্রিকার চিফ রিপোর্টার ফোন করেন। তিনি জানতে চাইলেন আমার স্বাস্থ্য কেমন আছে। আমি একটু অবাকই হলাম। কারণ সকালেই অফিসে দেখা হলো। সম্পাদকীয় ও বার্তা বিভাগে সবার সঙ্গে মিটিং-আলোচনায় নানা কথা হলো। চিফ রিপোর্টারকে জানালাম, স্বাস্থ্যে আমার নতুন কিছু ঘটেনি, ভালোই আছি। তিনি কেন যেন জবাব দিলেন, না! আপনার স্বাস্থ্য ভালো নেই। তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখান। একটু অবাক করা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা।

টেলিফোনে আর কথা হলো না। ভাবছিলাম হঠাৎ স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ কেন? চিফ রিপোর্টার কোনো নবীন সাংবাদিক নন। অনেক অভিজ্ঞ। দীর্ঘদিন পেশায় ও রাজনীতিতে পোড় খাওয়া ব্যক্তি। সাংবাদিক ইউনিয়নেরও একজন সক্রিয় নেতা। সব মহলেই তার যথেষ্ট পরিচিতি আছে। তাই স্বাস্থ্য নিয়ে তার এই প্রশ্ন একটু চিন্তার বিষয়। ইতিমধ্যে আবার টেলিফোন। এবার আমাদের পত্রিকার একজন সিনিয়র সহকারী সম্পাদক। তিনি অবশ্য হেঁয়ালিতে যাননি। সরাসরি জানালেন, যা কিছু করার আজ রাতের মধ্যেই শেষ করে ফেলুন। কাল আপনার সঙ্গে দেখা না হলেই মঙ্গল। আরও স্পষ্ট ইঙ্গিত পেলাম। বুঝতে পারলাম, আমার আর অফিসে না যাওয়াই ভালো।

মিনহাজ: ওই সময়ের সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা ও সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাই।

তোয়াব খান: ২৫ মার্চের পর থেকেই কার্যত সংবাদপত্র অবরুদ্ধ। কঠোর সেন্সর বলবৎ। যা বলা হবে অর্থাৎ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী যা বলবে সেভাবেই লিখতে হবে, ছাপাতে হবে। এদিক-সেদিক হওয়ার সুযোগ নেই। ২৫ মার্চের পর বেশ কয়েক দিন তো সংবাদপত্র বন্ধই ছিল। প্রকাশনা আবার শুরুর পর দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দেয়া খবরই শুধু ছাপা হতো। সম্পাদকীয় কেউ লিখতেন না। নিজস্ব প্রতিবেদন প্রকাশের ধারেকাছেও কেউ যেত না। দখলদারদের দেয়া তথ্যবিবরণী (হ্যান্ডআউট) এবং তাদের বার্তা সংস্থা এপিপি (অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান) পরিবেশিত খবরই শুধু ছাপা হতো।

কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই দখলদারদের খেয়াল হলো সংবাদপত্রগুলো নিজেদের কোনো অভিমত বা সম্পাদকীয় প্রকাশ করছে না। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম এলো অবশ্যই সম্পাদকীয় লিখতে হবে। ওই অবরুদ্ধ সময়ে পত্রিকা পড়ার লোক, গ্রাহক সংখ্যা একেবারে তলানিতে। দলে দলে লোক ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে বা যাচ্ছে। ইত্তেফাক ও সংবাদ-এর অফিস কামানের গোলা দেগে জ্বালিয়ে দিয়েছে পাক সেনারা। পত্রিকাগুলো পৃষ্ঠা সংখ্যা অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে। সেনা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা আসার পর কয়েকটি পত্রিকা প্রথমে সম্পাদকীয় লিখতে আরম্ভ করল। অবজারভার হাউসের দুটি পত্রিকা পাকিস্তান অবজারভার আর পূর্বদেশ। প্রেস ট্রাস্টের মর্নিং নিউজ এবং আজাদও লেখা শুরু করেছিল। এদিকে কয়েক দিনের মধ্যেই দৈনিক পাকিস্তানকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেয়া হলো, দ্রুত সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত না হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো উপায় না দেখে দৈনিক পাকিস্তানও সম্পাদকীয় লেখার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। সহকারী সম্পাদক কবি হাসান হাফিজুর রহমান ২৫ মার্চের পর থেকে অফিসে আসেন না। তিনি নাকি ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। হাসান সাহেব ১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয় দিবসের আগে আর কোনো দিনই দৈনিক পাকিস্তান-এর কাজে যোগ দেননি। কবি শামসুর রাহমান ঢাকাতেই ছিলেন, তবে অফিসে আসতেন না। আহমেদ হুমায়ুন অফিসে আসেন; কিন্তু সম্পাদকীয় লেখার ফরমান জারি হওয়ার পর ঢাকা ছেড়ে দেশের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যান। নিয়মিত অফিস করেন সহকারী সম্পাদকের মধ্যে সানাউল্লাহ নূরী আর মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। তারা সম্পাদকীয় লিখতে অস্বীকৃতি জানান। তাদের বক্তব্য দখলদারদের গুণকীর্তনে তাদেরকেই শুধু ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই তারা প্রথম দিন লিখবেন না। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না পেয়ে প্রবীণ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকেই সেদিন সম্পাদকীয় লিখতে হয়েছিল।

মিনহাজ: তারপর কী ঘটল? পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হলো?

তোয়াব খান: এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে দখলদার পাকিস্তানিরা এটা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগে যে, সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। যদিও হত্যাযজ্ঞ চলছিল। মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিল। আমি দৈনিক পাকিস্তান অফিসে দাঁড়িয়ে লাল ত্রিপল দিয়ে ঢেকে মরদেহ বোঝাই ট্রাক চলাচল করতে দেখেছি। তবে সেনা কর্তৃপক্ষ অনেক চেষ্টা করেছিল। ঢাকায় সবকিছু স্বাভাবিক এমন বিষয় প্রচার-প্রকাশের জন্য  তারা সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় পাঠায়। এই প্রতিনিধি দলে লাহোর-করাচির অনেক নামকরা সাংবাদিক ছিলেন। ছিলেন এসআর ঘোরি, এবিএম জাফরিসহ আরও অনেকেই। আবার এটাও শুনেছি মাজহার আলী খান (প্রখ্যাত বামপন্থি নেতা) এটি চৌধুরী, আসরার আহমেদের মতো সম্পাদক-সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারা আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দখলদারদের ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ প্রমাণের ঢাক পেটানোর চেষ্টায় সবচেয়ে বড় ব্যাক ফায়ার করেছিলেন অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস। তিনি এখানে এসে ঘুরে গিয়ে পাক সেনাদের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ‘জেনোসাইড’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন লেখেন। কিন্তু নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য তিনি তখন পাকিস্তান থেকে সেটি প্রকাশ করতে পারেননি। পাকিস্তানের মর্নিং নিউজের পাশাপাশি অ্যান্থনি লন্ডনের দ্য সানডে টাইমস-এ কাজ করতেন। তিনি ওই প্রতিবেদনটি দ্য সানডে টাইমসে প্রকাশ করেছিলেন ১৩ জুন, ১৯৭১। যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর আগে তিনি তার পরিবারকে লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর নিজেও দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলেন। এরপর অ্যান্থনি পাক দখলদারদের মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর মতো একটি বই লিখেছিলেন- ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’।

মিনহাজ: আপনি কবে, কীভাবে, কোন পথে ঢাকা থেকে ভারতের উদ্দেশে রওনা হলেন। ভারতে পৌঁছে আপনি কী করেছিলেন ?

তোয়াব খান: আমার জন্য দৈনিক পাকিস্তান-এ কাজ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর অনুচর জামায়াত নেতারা শান্তি ও সংহতি কমিটির আলখেল্লা নিয়ে সাংবাদিক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের ওপর নজরদারি শুরু করে। তারা নিয়মিত ইনফরমারের কাজ করছিল। মোহাম্মদপুর এলাকায় বসবাসরত আমাদের পত্রিকার এক নারী সাংবাদিকের মাধ্যমে আমাকে সাবধানে থাকার অনুরোধ করেন। কারফিউয়ের মধ্যে আটকা পড়ে মোহাম্মদপুরের ওই নারীকে তার এক আত্মীয়ের (যিনি জামায়াত নেতা) বাসায় রাত কাটাতে হয়েছিল। সেখানে তিনি জামায়াত নেতার সহকর্মীদের আলোচনা থেকে জানতে পারেন, দৈনিক পাকিস্তান-এর বার্তা সম্পাদককে সরিয়ে না দিলে পাকিস্তানপ্রেমীদের খবরা-খবর ওই পত্রিকায় ভালোভাবে যাবে না। তাই পাকিস্তানকে হেফাজত করার স্বার্থেই তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। জামায়াত নেতাদের মুখে ‘কঠোর ব্যবস্থা’র কথা শুনে ভদ্রমহিলা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। একই সময়ে আরও একটি ঘটনা আমার নিরাপত্তা নিয়ে সহকর্মীদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। এক রাতে মর্নিং নিউজ অফিসের গেটে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। এ নিয়ে তদন্তে এসে পাক বাহিনী মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তান ভবনটিতে তদন্ত তল্লাশির নামে ত্রাস সৃষ্টি করে। সন্ধ্যায় পাক সেনাদের আরও একটি দল এসে বিকেলের শিফটে কর্মরত সাংবাদিকদের রীতিমতো জেরা শুরু করে দেয়। পরিস্থিতি আরও ভীতিকর হয়ে ওঠে। আমি দ্রুত ঢাকা ত্যাগের প্রস্তুতি শুরু করি।

সীমান্ত পার হয়ে আমি প্রথমে বক্সনগর পৌঁছাই। সেখানে লাউড স্পিকারে গান চলছিল ‘শোনো একটি মুজিবের কন্ঠ… ।’ তারপর এল মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি, জয় বাংলা এবং ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

আগরতলা পৌঁছেই আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের সরকারের ক্যাম্প অফিসে নাম নথিভুক্ত করে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের সনদ তথা চিরকুট গ্রহণ করি। ১৯৭১ সালে এই চিরকুটের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ত্রিপুরা-পশ্চিমবঙ্গের যেখানেই যান, জয় বাংলার ওই ক্ষুদ্র চিরকুটটি প্রায় ম্যাজিকের মতো কাজ করত। আমি যত দ্রুত সম্ভব কলকাতায় পৌঁছাতে চাচ্ছিলাম। সেখানে আমাদের আত্মীয়স্বজন আছে।

মিনহাজ: কলকাতা পৌঁছে কী করলেন?

তোয়াব খান: কলকাতায় পৌঁছেই জীবনধারণের অপরিহার্য কিছু কাজ শেষ করে গেলাম বাংলাদেশ মিশন অফিসে। এটা আগে ছিল পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের অফিস। ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে সদলবলে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। এরপর পুরো ডেপুটি হাইকমিশন অফিস ভবন বাংলাদেশ মিশনে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশ থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী তথা উল্লেখযোগ্য যারাই আসছেন শরণার্থী হিসেবে, তাদের সবাই একবার বাংলাদেশ মিশন ঘুরে যাচ্ছেন। মিশন তাই সব সময় লোকারণ্য থাকত। আমি ও আমার ছোট ভাই বাচ্চুও গেলাম। উদ্দেশ্য যদি পরিচিত কারও সাক্ষাৎ পাই। প্রথম দিনেই টেলিভিশনের জামিল চৌধুরী, মুস্তফা মনোয়ার, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানসহ অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। জামিল চৌধুরী আমাকে রেডিওতে নিউজ অপারেশনের জন্য একটি বাজেট তৈরি করতে বললেন। আমি কিছুটা বিস্মিত। কারণ, কোথায় নিউজ প্রচার হবে, সেটা কি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্র, নাকি যুদ্ধাবস্থায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো একটি ব্যবস্থা? এসব প্রশ্ন আমার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।

মিনহাজ: তারপর তো খুব দ্রুত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ শুরু হলো এবং সেখানেও আপনি আপনার পূর্ব পরিচিত অনেককেই পেয়েছিলেন?

তোয়াব খান: স্বাধীন বাংলা বেতারের একনিষ্ঠ কর্মী, সাংবাদিক ও শিল্পীদের সঙ্গে একে একে পরিচিত হতে শুরু করলাম। তবে সৌভাগ্যের বিষয় ছিল অনেকেই আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। বার্তা বিভাগের দায়িত্বে থাকা কামাল লোহানী দৈনিক সংবাদ-এ আমার সহকর্মী ছিলেন। বেতার কেন্দ্রের অন্যান্য দায়িত্বে প্রশাসনের আসফাকুর রহমান, বাংলা সংবাদ পাঠক সৈয়দ হাসান ইমাম, ইংরেজি সংবাদের দায়িত্বে ছিলেন আলী যাকের ও আলমগীর কবির।

মিনহাজ: আপনি ‘পিন্ডির প্রলাপ’ সংবাদ ভাষ্যটি নিয়ে কাজ করতেন। এ বিষয়ে যদি বিস্তারিত একটু বলতেন। আর সার্বিকভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা ও শ্রোতাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই?

তোয়াব খান: আমার সংবাদভাষ্যটির নাম দেয়া হয় ‘পিন্ডির প্রলাপ’। সত্যি কথা বলতে কী, স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান শোনার জন্য শরণার্থী শিবিরে এবং শিবিরের বাইরে আশ্রয় গ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। শুধু যে শরণার্থীরাই অনুষ্ঠান শুনতেন, এমন নয়। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের ৩০-৪০ শতাংশই ছিলেন পূর্ববঙ্গের। এরা সবাই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের একনিষ্ঠ শ্রোতা। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হওয়া সম্প্রচারটি চলত সন্ধ্যা থেকে ৪-৫ ঘণ্টা। সকালেও অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। প্রচারিত অনুষ্ঠানের মধ্যে সংবাদ, সংবাদভাষ্য, দেশাত্মবোধক গান, নাটক থাকত। প্রচার করা হতো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র। মুকুল সাহেব চরমপত্র নিজে লিখতেন এবং স্বকণ্ঠে ঢাকাইয়া উচ্চারণে বিশেষ বাচনভঙ্গিতে পাঠ করতেন। অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য শরণার্থী শিবিরের লোকজন, বাড়িঘরে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরা, পূর্ববঙ্গ থেকে আগত পশ্চিমবঙ্গবাসী এবং রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। এ ছাড়া পাকিস্তানের লম্পট স্বৈর সেনাশাসক ইয়াহিয়া খানের কার্যকলাপ নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক ধারাবাহিক নাটক ‘জল্লাদের দরবার’ও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায়।

মিনহাজ: ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিন বেতারকেন্দ্রে আপনারা কী করেছিলেন। ঐতিহাসিক এই দিনটিতে বেতারে কী সম্প্রচার হয়েছিল?

তোয়াব খান: পাক দখলদারদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে গান লেখা হলো তাৎক্ষণিকভাবে। গানটি ছিল ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই, বাংলার ঘরে ঘরে।’ সুর দিলেন সুজেয় শ্যাম। আর সেই সুরের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল বাংলার ঘরে ঘরে। এরপর মুক্ত স্বদেশে ফেরার পালা। ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে কাজ করছি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এমন সময় জানানো হলো কাল, অর্থাৎ ২৩ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার দেশে ফিরে যাবে সন্ধ্যায়। সকালে স্বাধীন বাংলা বেতারের একটি বিশেষ দল ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ বিমানে ঢাকা যাবে। এই বিমানে আমাকেও যেতে হবে। এই দলটির একটি বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ঢাকায় ফিরে রেডিও বাংলাদেশের ঢাকাকেন্দ্রে অনুষ্ঠান সম্প্রচার চালু করতে হবে। নানা ঝুটঝামেলায় আগে থেকেই ঢাকাকেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ আছে।

ঢাকাকেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরুর সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারের পরিসমাপ্তি ঘটবে। মিনহাজ : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। তোয়াব খান : আপনাকেও ধন্যবাদ। সূত্র : দৈনিক বাংলা

স্যোসাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

ads




© All rights reserved © 2021 ajkertanore.com
Developed by- .:: SHUMANBD ::.