সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:১৬ am
ডেস্ক রির্পোট : নাটোরে অসম বয়সের ছাত্রকে বিয়ে করে ভাইরাল হওয়া সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহারের আত্মহত্যার ঘটনায় আদালত সোমবার সন্ধ্যায় তার স্বামী কলেজছাত্র মামুন হোসেনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।
এর আগে রোববার রাতে পিতার বাড়ির পাশের আবু বকর সিদ্দিকী কওমি মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে স্থানীয় খামার নাচকৈড় কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
বোনকে হত্যার অভিযোগে শিক্ষিকার চাচাতো ভাই প্রকৌশলী সাবির উদ্দিন নাটোর থানায় মামলা করতে আসলেও লাশের ময়নাতদন্তে প্রাথমিকভাবে হত্যার কোনো আলামত না পাওয়ায় পুলিশ আপাতত নিজেরাই অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেছে।
নাটোর থানার অফিসার ইনচার্জ নাছিম আহমেদ যুগান্তরকে বলেছেন, ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট এ হত্যার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাটিই তখন হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হবে। আর তাদের বাসায় যেহেতু অন্য কেউ ছিল না এবং তার স্বামী মামুন অনেক অসংলগ্ন কথা বলায় তাকে আটক করে সোমবার দুপুরে আদালতে পাঠানো হয়।
নাটোরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. মোসলেম উদ্দিন সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে শুনানি শেষে তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদালতের পুলিশ পরিদর্শক নজমুল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে উভয় পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জানা গেছে, খায়রুন নাহার গুরুদাসপুর বেগম রোকেয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক এবং স্থানীয় শহীদ শামসুজ্জোহা সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরের বছর দর্শন বিষয়ে স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। সেখানেই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সহপাঠী রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার আড়ানী পান্নাপাড়ার সহপাঠী জহুরুল ইসলাম বাবলুর সঙ্গে। পরে তাকেই বিয়ে করেন খায়রুন নাহার।
স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবলু পান্নাপাড়া আব্দুর রহমান (বিএম) কারিগরি কলেজের শিক্ষক। এখন পর্যন্ত তার বেতন চালু হয়নি। তাদের সংসারে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া ১৭ বছরের একটি ছেলে এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া সাত বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। বেতন না হওয়ায় কলেজ শিক্ষক স্বামী জহুরুল ইসলাম বাবলু রডমিস্ত্রির কাজ করার পাশাপাশি প্রতি রোববার নাটোরের তেবাড়িয়া হাটে ইজারাদারের সহকারী হিসেবে খাজনা দায়েরের কাজ করেন।
তিনি বৃদ্ধা মা, স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে সংসার ধরে রাখার অনেক চেষ্টা করলেও খায়রুন নাহার স্বামীকে তার বৃদ্ধা মা ও এলাকা ছেড়ে নাটোরে চলে আসার জন্য চাপ দেন। বাবলু মাকে ছেড়ে না আসায় খায়রুন নাহার তাকে তালাক দেন। স্বামী-স্ত্রীর সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাজশাহীর একটি বড় সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় ছেলে চলে আসেন নাটোরের চাঁচকৈড় নানার বাড়িতে। দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া ছোট ছেলে থেকে যান বাবা ও দাদির কাছে।
এসব বিষয়ে জহুরুল ইসলাম বাবলুর সঙ্গেও এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তালাকের পর থেকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন খায়রুন নাহার। এক বছর পর ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় তার অর্ধেক বয়সী কলেজ ছাত্র মামুনের সঙ্গে। ছয় মাস সম্পর্কের পর গত বছরের ১২ ডিসেম্বর কাজী অফিসে গিয়ে দুজন গোপনে বিয়ে করেন।
বিয়ের ৬ মাস পর গত জুলাই মাসে ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে বেশ আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সারাদেশের মানুষ হাজারো বিরূপ মন্তব্য করেন। তার সহকর্মীরা কথা বলা বন্ধ করেন। নাটোর শহরের বলারী পাড়ায় তারা ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। এখানে মামুন বেশির ভাগ সময় বাহিরে থাকত।
অর্ধেক বয়সী ছেলেকে বিয়ে করায় শ্বশুরপক্ষ মেনে নিলেও খায়রুন নাহারের বাবা ও ভাইয়েরা মেনে নেয়নি। তার পিতা গুরুদাসপুর উপজেলা পরিষদে চাকরি করতেন এখন অবসরে আর ছোটভাই এখনো সেখানে চাকরি করেন। তাদের পরিবার শিক্ষিত ও সচ্ছল। অপরদিকে সামাজিকভাবে তেমন কোনো অবস্থান নেই মামুনের পরিবারের। তার ওপর অর্ধেক বয়স কম, যে কারণেই তাকে মেনে নিতে চায়নি খায়রুন নাহারের পরিবার। মামুনের বিয়ে নিয়েও এলাকায় একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
রোববার সকালে পুলিশ মামুনকে আটকের সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে মামুন খায়রুন নাহারের বিভিন্ন ব্যাংক ও এনিজওতে ১৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে তার বাবার বাড়িতে থাকা বড় ছেলে ৬ লাখ টাকা দামের একটি মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল বলে যেসব কথা বলেছিল- তা সবই মিথ্যা বলে দাবি করেছে খায়রুন নাহারের বড় ছেলে বিনতো।
তিনি বলেন, মামুন নিজে বাঁচতে এখন মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
তিনি দাবি করেন, শয়ন ঘরে স্ত্রীকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে রাত সাড়ে ৩টার সময় তিনি বাসা থেকে মামুন বের হওয়ার অনেক গল্প বলেছে, অথচ সে নিজেই আবার বলেছে নামাজ পড়া হয়নি। তাহলে সে সকাল পর্যন্ত এই সময়টুকু কোথায় ছিল? কেন বাহিরে ছিল? কখন ফজরের নামাজের জামাত হয় এটাই তো সে বলতে পারেনি। সে সবাইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
এদিকে সোমবার দুপুরে মামুনদের বাড়িতে গেলে তার মা রাবেয়া বেগম দাবি করেছেন তার ছেলে নির্দোষ। তার ছেলে খায়রুন নাহারকে হত্যা করেনি। খায়রুন নাহার আগের দিনও তার সঙ্গে মোবাইলে গল্প করেছেন। গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসতে চেয়েছেন।
খায়রুন নাহারের ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন, বিয়ের পর নিজের কর্মস্থলের কোনো সহকর্মী খায়রুন নাহারের সঙ্গে কথা বলতো না। আত্মীয়স্বজনরাও তাকে ত্যাগ করেছিল। এর মধ্যে অসম বয়সের বিয়ে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা কটূক্তি তাকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। কিছুটা অভিমানী ও জেদি খায়রুন নাহার বিষয়টি শান্তভাবে মেনে নিতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছেন।
নিহত সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহারের চাচাতো ভাই প্রকৌশলী সাবির উদ্দিন বলেন, অসম বয়সের বিয়ে হওয়ায় খায়রুন নাহারের কলেজের কোনো সহকর্মী তার সঙ্গে কথা বলতো না। বাবা-মাসহ আত্মীয়স্বজনরা যোগাযোগ রাখত না। বিয়ের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় খাযরুন নাহার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।
তবে সাবির উদ্দিনের স্ত্রী নূরজাহান একই সময়ে বলেন, খায়রুন নাহারের স্বামী মামুন সবাইকে বলেছে সকালের দিকে খায়রুন নাহার মারা গেছে, কিন্তু তিনি সকাল সাড়ে ৮টায় এসে দেখেছেন লাশের শরীর একেবারে শক্ত হয়ে আছে। অনেক আগে মারা গেলে যেমন শক্ত হয়ে যাওয়ার কথা ঠিক তেমনটা। তাই তিনি খায়রুন নাহার আত্মহত্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সামিউল ইসলাম শান্ত জানান, খায়রুন নাহারের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। লাশের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেছেন, সিলিং ফ্যানে ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে যেভাবে ওড়না আগুন দিয়ে পুড়িয়ে খায়রুন নাহারকে তার স্বামী নামিয়েছেন এটা বিশ্বাসযোগ্য। বিষয়টি আত্মহত্যার মতোই মনে হচ্ছে। তারপরও মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত স্বামী মামুন বাহিরে থাকাসহ সব পয়েন্ট মাথায় রেখেই পুলিশ তদন্ত কাজ শুরু করেছে। আশা করা যায় খুব তাড়াতাড়িই পুলিশ সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহারের মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন করতে সক্ষম হবে।
প্রসঙ্গত, গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুর মোজাম্মেল হক ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাটোর শহরের বলারীপাড়ার হাজী নান্নু মোল্লা ম্যানশনের চারতলায় ভাড়া বাসায় স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতেন। সেখানেই তিনি আত্মহত্যা করেন।
তার মৃত্যুর খবরে নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা, পিবিআই পুলিশ সুপার শরিফ উদ্দিন, সহকারী পুলিশ সুপার মহসিন ও নাটোর থানার ওসি নাছিম আহমেদ এবং সিআইডি ও গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকটি টিমসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তার স্বামী কলেজছাত্র মামুনকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক করে ৫৪ ধারায় মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে। সূত্র : যুগান্তর