শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:৩৮ pm
পৃথিবীতে যেমন ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের মানুষ রয়েছে, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন ভাষাও রয়েছে। সব ভাষাই মহান আল্লাহর দান। তিনিই মানুষকে কথা বলা শিখিয়েছেন। ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা তাঁর অন্যতম নিদর্শন। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নির্দেশনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই অনেক নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা: রুম, আয়াত: ২২) আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি এবং মনের ভাব প্রকাশ করি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। যেকোনো ভাষার মাধ্যমেই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যায়। আল্লাহ শোনেন, বোঝেন এবং প্রার্থনা কবুল করেন।
ভাষা কোনো ধর্মের প্রতিনিধিত্ব না করলেও ধর্ম তার নির্দেশনাবলি প্রকাশ এবং উপাসনার মাধ্যম হিসেবে একটি ভাষাকে গ্রহণ করে। সেটি সে ধর্মের দাপ্তরিক ভাষা। ইসলাম ধর্মের দাপ্তরিক ভাষা আরবি। আরবি ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। মহানবী (সা.) আরবিভাষী হওয়ায় তাঁর কথা, কাজ ও সম্মতি বা হাদিস আরবি ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। আরবি মুসলমানদের ধর্মের ভাষা। আরবি ভাষা ইসলামি জ্ঞানচর্চা ও মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে একজন মুসলমানের জীবনে তার মাতৃভাষাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃভাষা বোঝা, শেখা, চর্চা করা এবং ইসলামের দাওয়াত ও অন্যান্য কল্যাণকর কাজে তা প্রয়োগ করা তার কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা সব নবী-রাসুলকে নিজ নিজ ভাষার ঐশী বাণী দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ইসলামি দৃষ্টিকোণে ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগের কিছু শিষ্টাচার এবং বিধিনিষেধ রয়েছে। কয়েকটি এখানে আলোকপাত করা হলো:
সঠিক কথা বলা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।’ (সুরা: আহযাব, আয়াত: ৭০)। সঠিক কথার ব্যাখ্যা হলো, যে কথা চার বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ—
এক. বিশুদ্ধ হওয়া। মহানবী (সা.) অত্যন্ত বিশুদ্ধভাষী ছিলেন। তাঁর বাণীই বিশুদ্ধতার জ্বলন্ত প্রমাণ।
দুই. সত্য হওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা দূরে থাকো মিথ্যা কথা বলা থেকে।’ (সুরা: হজ, আয়াত: ৩০)
তিন. গাম্ভীর্যপূর্ণ হওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে। কারণ, যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। কোনো নারী যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস না করে। কারণ, যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।’ (সুরা: হুজুরাত, আয়াত: ১১)
চার. কোমল হওয়া। মহানবী (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে, যার কথা ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি, হাদিস: ১০)
স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা: স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাষায় এমনভাবে কথা বলতে হবে যেন সবাই তা বুঝতে পারে। মুসা (আ.)-এর মুখে জড়তা থাকায় তিনি আল্লাহর কাছে আবেদন করেছিলেন, ‘আমার ভাই হারুন—সে আমার চেয়ে প্রাঞ্জলভাষী; অতএব তাকে আমার সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে। আমি আশঙ্কা করি তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে।’ (সুরা: কাসাস, আয়াত: ৩৪)
স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাষা সবার জন্যই কাম্য বিষয়। প্রয়োজনে কোনো কথা তিনবার বলতে হবে। পবিত্র কোরআনে অনেক কথা তিনবার করে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘মহাপ্রলয়, মহাপ্রলয় কী? মহাপ্রলয় সম্পর্কে তুমি কী জানো?।’ (সুরা: আল-কারিয়া, আয়াত: ১-৩)। এ ছাড়া নবী (সা.) অনেক কথা তিনবার করে বলতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) যখন কোনো কথা বলতেন, তা তিনবার বলতেন, যেন তা বোঝা যায়। (বুখারি, হাদিস: ৯৫)
শালীনতা বজায় রাখা: সর্বদা শালীন ভাষায় কথা বলা উচিত। কাউকে ভর্ৎসনা, গালমন্দ ও অভিসম্পাতমূলক, অশ্লীল ও অশালীন কথা ইমানদারের জন্য মোটেও শোভনীয় নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তি কারও প্রতি ভর্ৎসনা ও অভিসম্পাত করে না এবং অশ্লীল ও অশালীন কথা বলে না।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৯৭৭)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া পাপ আর তার সঙ্গে লড়াই করা কুফরি। (বুখারি, হাদিস: ৪৮)
অনর্থক কথা না বলা: যেসব কথার মধ্যে ইহকালীন ও পরকালীন কোনো উপকার নেই, ইমানদার ব্যক্তির তা থেকে বিরত থাকা খুবই দরকার। আল্লাহ তাআলা অনর্থক কথা বলা থেকে বেঁচে থাকাকে মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র এবং যারা অনর্থক কথা বলা থেকে বেঁচে থাকে।’ (সুরা: আল-মুমিনুন, আয়াত: ১-৩) হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেন, ‘ব্যক্তির ইসলামি গুণ এবং সৌন্দর্য হলো, অহেতুক কথা ও কাজ পরিহার করা।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩১৮)
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ পরিহার: কাউকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা, অন্যায়ভাবে দোষারোপ করা, অবমাননাকর ও মন্দ নামে ডাকা কোনো ইমানদারের ভাষা হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। যারা তওবা করে না তারা জালিম।’ (সুরা: হুজুরাত, আয়াত: ১১)
বিতর্কিত ভাষা বর্জন: আল্লাহ তাআলা তাঁর একনিষ্ঠ বান্দার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে সালাম।’ (সুরা: ফুরকান, আয়াত: ৬৩), অর্থাৎ তারা শান্তি কামনা করে এবং তর্কে লিপ্ত হয় না।
পরিশেষে বলা যায়, ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগে সংযত হতে হবে। বিশুদ্ধ, স্পষ্ট ও শালীন ভাষায় কথা বলতে হবে। অশ্লীল, অনর্থক, ব্যঙ্গাত্মক, ঝগড়া ও দ্বন্দ্বমূলক ভাষা পরিহার করতে হবে। সর্বোপরি কথা বলার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহির কথা স্মরণ রাখতে হবে। ভাষার মাসে ভাষা ব্যবহারে সচেতন হওয়া আমাদের অন্যতম কর্তব্য। লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় । সূত্র : আজকের পত্রিকা