শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:৪৫ pm
‘মৃত্যু এবং জীবন কিন্তু বিপরীত নয় বরং মৃত্যু হলো জীবনের অংশ।’
-হারুকি মুরাকামি, ঔপন্যাসিক
১.
আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার ঘটনা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য এক ভয়াবহ বার্তা দিয়ে গেল। স্মরণের বন্ধন ছিন্ন করে বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার জন্য এ জীবন ‘ত্যাগ’ নয়-এ যে কঠিন ‘ত্যাগ’। সমাজকে নাড়া দেওয়ার জন্য, মানবিক মূল্যবোধের গহিনে শেকড় ধরে টান দেওয়ার জন্য এক ব্যক্তির নিঃসংকোচ দুঃসাহস। বিষয়টি বেদনার, দুঃখের, কষ্টের-এতে কোনো সন্দেহ নেই। জীবনের এমন অভিজ্ঞতা আর কারও জীবনে না আসুক-এটাই প্রার্থনা। তবু এ সত্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। জীবনকে বোঝার জন্য-‘মৃত্যুর দামে’ ‘জীবনকে কেনা’র জন্য।
একজন মানুষ যে কত একা, তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মহসিন খান। ৫৮ বছর বয়সি একজন মানুষ, যার একদিন সবই ছিল, সব আছে। কিন্তু আজ তিনি নেই। একদিন অর্থ ছিল, প্রভাব ছিল, বিত্তবৈভব ছিল। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ছিল, এখনো আছে। কিন্তু বহুদূরে আক্ষরিক অর্থে যেন ‘মহাসিন্ধুর’ ওপারে। এতদিন সব থাকার মতো দেখিয়েছে। আসলে কেউ নেই, কিছু নেই।
৫৮ বছরের একজীবনে একবুক হাহাকার, শূন্য হৃদয়ের গোঙানি, ধূসর বেঁচে থাকার স্বপ্ন একজন মানুষকে কোথায় ভাসিয়ে নিতে পারে, তা মাত্র ১৬ মিনিট ২৫ সেকেন্ডে তিনি বর্ণনা করেছেন। জীবনের এত কঠিন বাস্তবতার নিখাদ বুনুনি আর হতে পারে না। জীবন কি এমনই? ‘আমরা সবকিছু করি সন্তান এবং ফ্যামিলির জন্য।…অনেকদিন যাবৎ আমি মেন্টালি আপসেট। জীবনে প্রতারিত হতে হতে।…আমি যদি আমার বাসায় মরে পড়েও থাকি, আমার মনে হয় না যে, এক সপ্তাহ কেউ জানতে পারবে, আমি মারা গেছি।…ছেলে বলেন, স্ত্রী বলেন, কেউই আপনার না।…নিজের ওপর নিজের এতটাই বিতৃষ্ণা হয়ে গেছে পৃথিবীতে এখন আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।’
জীবনের এ কেমন অসহায় ভাষ্য। জানি না আর শুনব কি না।
মহসিন খান বুধবার (২-২-২২) রাত পৌনে ১০টায় নিজের বাসা ধানমন্ডিতে লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেছেন। পৃথিবীর কারোর প্রতিই তার কোনো অভিযোগ নেই। নির্ভার হয়ে এসেছিলেন পৃথিবীতে, একেবারেই নির্ভার হয়ে গেলেন। কিন্তু এই সমাজের, এই রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই। পরিবারের? আমরা এখন কোন পরিবারে বাস করি। কোন সমাজে আছি? পারিবারিক বন্ধন, মায়া-ভালোবাসা কি একেবারেই হারিয়ে গেছে? কর্তব্য বা দায়িত্ববোধের কথা না-ই তুললাম, আজ মানবিক মূল্যবোধটুকুও নির্বাসিত, হারিয়ে গেছে? আহারে মানুষ, বড় একা!
কখনো কখনো পিতা সন্তানকে চেনে না, সন্তান পিতাকে চেনে না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে টান পড়ে। একটা বয়সে এসে কারও কারও কাছে চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যায়। যেন কোনোদিন কেউ কাউকে দেখেনি, যেন কোনোদিনই কোনো সম্পর্ক ছিল না, হায়রে বন্ধন! রক্তের টানও ধরে রাখতে পারে না!
২.
নানা প্রকার জন্ম-মৃত্যু নিয়েই সংবাদকর্মীদের কাজ। প্রতিদিনই খুন, জখম, আত্মহত্যা, মৃত্যু স্থান করে নেয় সংবাদপত্রের কলামে কলামে। এসব নিয়েই সাজানো আমাদের সংসার। আমরা এসব ঘটনাকে সিঙ্গেল কলাম, ডবল কলাম, থ্রি-সি, ফোর-সিতে সাজিয়ে প্রতিদিন পাঠকের দরবারে হাজির করি। সেই জন্ম-মৃত্যুর মিছিলে হঠাৎ একজন ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা খুব ছোট্ট একটি সংবাদমাত্র। কিন্তু কখনো কখনো সেই এক কলামের সংবাদও আমাদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করে তোলে, আমাদের চিন্তাকে স্তব্ধ করে দেয়। আমরা হারিয়ে ফেলি জীবনের অর্থময়তা। জীবন একটি সক্রিয় সত্তা, সেই সক্রিয় সত্তার বিপরীত অস্তিত্ব মৃত্যু নয়-সে কথা এ লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি-জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির জবানে। এটাই সত্যি যে, মৃত্যু আমাদের জীবনের অনিবার্য অংশ। কিন্তু অপমৃত্যু তা নয়। অপমৃত্যু জীবনের অংশ নয় বলেই আমাদের তা সিঙ্গেল, ডি-সি, থ্রি-সিতে বিন্যস্ত করতে হয়।
৩.
বুধবার রাতে ফেসবুক লাইভে এসে ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের নিজের লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যার দৃশ্য আমাদের চিন্তার ক্ষমতাকে ঘূর্ণাবর্তের মতো এলোমেলো করে দিয়েছে। অভাবনীয় এমন লাইভে এসে মৃত্যু এটাই প্রথম নয়। ইতঃপূর্বে এক যুবক আদাবরে তার স্বজনদের ওপর অভিমান করে স্বজনদের এমন লাইভে রেখে ফাঁসি নিয়ে আত্মহত্যা করে নিজের জীবনদীপ নিভিয়ে দিয়েছে। তারও কিছুদিন আগে বোধকরি রাজধানীর ভাটারায় এক তরুণ তার প্রেমিকার ওপর অভিমান করে তাকে লাইভে রেখে ফাঁসিতে ঝুলেছে। এবার সেরকম দৃশ্য আমরা দেখলাম ধানমন্ডিতে একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব পরিণত বয়সি মানুষ মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে নিজে নিজে তার জীবনের গতি থামিয়ে দিলেন।
এই মৃত্যু সত্যিই বেদনার্ত করে সাধারণ মানুষকে। আমরা যারা নিজেদের সুস্থ মানুষ বলে দাবি করি তাদের ‘সুস্থতাকে’ প্রশ্নবিদ্ধ করে। ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ-এসব ঘটনাকে তার ধৈর্যের সীমানায় নিতে পারেননি। বলেছেন সে কথা তার ‘সুইসাইড লাইভে’। এই যে অনাস্থা, সেটা তো আরও ভয়ংকর। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনকে অনাত্মীয়রূপে অনুভব করা তো এক ভয়ংকর বাস্তবতা।
এই ভয়ংকর বাস্তবতাই কি আমাদের সমাজের অংশ হয়ে উঠছে? তাই তো সত্য মনে হয়। না হলে কেমন করে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জনপ্রতিনিধি একরামের অবোধ সন্তানেরা এ কথা বলতে পারে-‘ভূতকে ভয় লাগে না, মানুষকে ভয় লাগে।’ জনপ্রতিনিধি একরামের অবুঝ শিশুরা তাদের জীর্ণ দেওয়ালে, মার্কারের কালিতে উৎকীর্ণ করেছে এই ভীতির কথা। ‘মানুষ’ এমনই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে-মানুষেরই কাছে! এই সত্য কী করে অস্বীকার করতে পারি আমরা?
সভ্যতার এই ‘গভীর অসুখ’কে কী করে অস্বীকার করা সম্ভব।
৪.
করোনা মহামারির ভেতরে এর চেয়ে ভয়ংকর সব সংবাদ আমরা ছেপেছি। আপন সন্তান অশীতিপর বৃদ্ধ মা-বাবাকে রাস্তায় ফেলে গেছে। করোনায় মৃত পিতার মুখাগ্নি করার সাহস পায়নি একমাত্র উত্তরাধিকারী সন্তান। শুধু যে আত্মীয়স্বজন তাই নয়, পাড়া-প্রতিবেশীরা পর্যন্ত অনেক বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে এই দুঃসহ করোনাকালে।
সেই ভয়াবহ ট্রমা পৃথিবীর মানবকুল কবে কাটিয়ে উঠবে, তা বলা দুঃসাধ্য। মানবসভ্যতা এক গ্রেট ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা কেবল আমাদের শারীরিক মৃত্যুর ভীতি আতঙ্কেই অপ্রকৃতিস্থ করেনি। বোধকরি আমাদের আত্মিক অপ্রকৃতিস্থিরও জন্ম দিয়েছে। ‘পৃথিবীর এই গভীর অসুখ’ কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত মানব উদ্যোগ। এটা শুধু আমাদের দেশের সংকট নয়, এ সংকট মানবসভ্যতার।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্যনতুন আবিষ্কার যেমন আমাদের জীবনকে সহজ এবং নিকটতর করছে, তেমনই একই সঙ্গে সেসব আবিষ্কারে তমসাও তৈরি করছে। দূরত্ব তৈরি করেছে, ভীতি তৈরি করছে। এই ভীতি থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন প্রযুক্তির যথার্থ ও সদ্ব্যবহার। প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধকে সবার ওপরে তুলে ধরার। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে-তা ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক পর্যায়ে যে আবেদন রাখছে, পরিবেশবাদী গ্রেটা থার্নবার্গ বা মানবতাবাদী মালালা ইউসুফ জাই-তাদের সেই মানবিক আহ্বানে সাড়া দেওয়া এক অনিবার্য প্রয়োজন। সে প্রয়োজন কড়া নাড়ছে আমাদের হৃদয়ের দ্বারে-তাতে সাড়া দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
প্রতিটি সামাজিক পরিবর্তন মানবীয় বোধ এবং বোধিকে পুনর্বিন্যস্ত করার বাস্তবতার জন্ম দেয়। সেটা সঠিকভাবে পুনর্বিন্যস্ত না করার একটি পুঞ্জীভূত ব্যর্থতা জমে আছে মানবসভ্যতার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আসন্ন ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের’ ধাক্কা; এই ধাক্কাকে সামলাতে হলে সম্মিলিত মানবিক উদ্যোগেরও কোনো বিকল্প নেই।
আজ বিশ্বব্যাপী মানুষে মানুষে যে বিচ্ছিন্নতা, তা যেমন অপনোদন করতে হবে, তেমনই প্রজন্ম পরম্পরা যে বিচ্ছিন্নতা, তারও অপনোদন জরুরি। মানবিক সম্পর্কগুলোকে পরিচর্যার ভেতর আনতে হবে। ধর্মীয় পরিভাষায় যাকে বলে সন্তানের হক, মা-বাবার হক, আত্মীয়ের, প্রতিবেশীর সর্বোপরি ভিনদেশি গোত্র, জাতির হকও আমাদের জীবনের পরিচর্যায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আমাদের প্রাচীন কবি যে পঙ্ক্তি রচনা করেছিলেন-‘শুনহ মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
মানুষ এবং মনুষ্যত্বকে স্থান দিতে হবে সবার ওপরে। সর্বকাজে, সর্ব পদক্ষেপে। আমার মনে হয়, ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের আত্মত্যাগ সে সত্যটিই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল।
এ রকম জীবন প্রত্যাখ্যান করা মৃত্যু নয়, প্রয়োজন জীবনবরণ করা, জীবন উদ্যাপন করা মৃত্যু, যে মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক অংশ।
৫.
মহানবি (সা.)-এর একটি হাদিস আছে-‘ছোটদের যে স্নেহ করে না, বড়দের যে শ্রদ্ধা করে না, সে আমার উম্মতের অংশী নয়।’ শিশু-তরুণ-যুবক-বৃদ্ধ-মানব প্রজন্ম এক পরম্পরা। এই পরম্পরার মধ্যে ভেঙে পড়া সাঁকোকে আবার পুনর্বিন্যস্ত করে, শক্ত করে গড়ে তোলার বিকল্প দেখি না।
আমরা সবাই আপনারে নিয়ে বিব্রত, বিধ্বস্ত। আমরা ভুলেই গেছি এ সত্য যে,
‘আপনারে লয়ে বিব্রত হতে আসে নাই কেউ অবনী’ পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ লেখক, সাইফুল আলম : সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর ও সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব।