শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:৪৯ pm
টিকা নিয়ে পৃথিবীতে যে বৈষম্য চলছে তা দূর করতে হবে। একটি নতুন পৃথিবী গড়তে হলে অবশ্যই সমতা বজায় রাখতে হবে। করোনার নতুন রূপ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করছে। ফের সবকিছু থেমে চলার উপক্রম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত পহেলা ডিসেম্বর ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী পাওয়ার পর সংক্রমণের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে যত মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে তার ৭৩ শতাংশই ওমিক্রনে আক্রান্ত। ইউরোপেও ওমিক্রন বিস্তার লাভ করছে দ্রুতগতিতে। এর মধ্যে নতুন খবর হিসেবে ওমিক্রন ও ডেল্টা ধরন মিলিয়ে ডেলমিক্রন নামে একটি ধরনের কথাও শোনা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ডেলমিক্রন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন কোনো ব্যক্তি ডেল্টা ধরনের আক্রান্ত হওয়ার পর ওমিক্রনে আক্রান্ত হচ্ছেন, তখন তিনি ডেলমিক্রন আক্রান্ত হচ্ছেন। এরপর ওই ব্যক্তি ডেলমিক্রন ছড়াচ্ছেন। এই যখন অবস্থা এর মধ্যে উঠে এসেছে বুস্টার ডোজের কথা। টিকা নিয়ে পৃথিবীতে বৈষম্য আগে থেকেই চলে আসছিল। একেবারে শুরু থেকে ধনী দেশগুলোর সঙ্গে টিকা নিয়ে পিছিয়ে পড়ে দরিদ্র দেশগুলো। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ডবিস্নউএইচও প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়াসিস এক সতর্কবার্তায় বলেছেন, ধনী দেশগুলো বুস্টার ডোজ চালুর জন্য যে তড়িঘড়ি শুরু করেছে তাতে ভ্যাকসিন নিয়ে বৈষম্য আরও বাড়বে। এ বুস্টার ডোজ দিয়ে কোনো দেশই মহামারি কাটাতে পারবে না। জাতিংঘের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের উচ্চ আয়ের দেশগুলোর ৬৭ শতাংশ মানুষ অন্তত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশগুলোর এর পরিমাণ ১০ শতাংশের কম। এই হলো বৈষম্যের অবস্থা যা দূর করতে তেমন কোনো সমন্বিত উদ্যোগ দেখা যায় না। পৃথিবী বহু আগেই সমতার নীতি ত্যাগ করে স্বার্থপরতার একপেশে নীতিতে চলতে শুরু করেছে।
সবকিছুতেই এই বৈষম্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এটা জীবনের প্রশ্ন। যে আশঙ্কা পূর্ব থেকেই ছিল এখন তা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে। পৃথিবীতে স্বার্থপরতার যে খেলা চলছে সেখানে অধিকাংশই বঞ্চিত হয়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে হবে। সবাই যেহেতু একসঙ্গে ভ্যাকসিন পাবে না তাই এর মধ্যেও করোনার তান্ডব চলবে। তাই সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া বিকল্প নেই। পৃথিবীর প্রতিটি দেশই যখন এই ভাইরাসের শিকার তাই প্রতিটি দেশেই এই টিকা সময়মতো পৌঁছানো প্রয়োজন। যদিও এখন পর্যন্ত সেভাবে সম্ভব হয়নি। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন এখন এতটাই প্রত্যাশিত যে সারা পৃথিবী যেভাবে একসঙ্গে এতদিন এর মোকাবেলা করে এসেছে, এখনো অর্থাৎ এই ভ্যাকসিন প্রয়োগেও একসঙ্গে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রম্নততার সঙ্গে সবার জন্য এই টিকা নিশ্চিত করা জরুরি। এখানে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
কারণ সামর্থ্য সবার সমান থাকে না। যার সেই সুযোগ নেই তার জন্য আমাদের বড় বড় দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পৃথিবীতে বহু দরিদ্র রাষ্ট্র রয়েছে যাদের ভ্যাকসিন নিজের দেশের জনগণের সবার জন্য একই সঙ্গে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যারা এখনো টিকা আসার স্বপ্ন দেখছে। আজ আমরা যারা টিকা নিতে পেরেছি বা পারছি তারা জানি ভ্যাকসিন কতটা প্রত্যাশিত একটি বিষয় ছিল। কিন্তু সবার জন্য মানে সব দেশের জন্য সাম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ থেকে সরে এসে কাজ করতে হবে। আজ যখন পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ ভ্যাকসিনের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে তখন এটি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও বিশ্বের রয়েছে।
এজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে। এখানে একটি সমস্যা হলো ভ্যাকসিন উৎপাদন। কারণ যে বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন রয়েছে তার তুলনামূলক উৎপাদন থাকতে হবে। তবে যেসব দেশ এখনো একজনকেও ভ্যাকসিন দিতে সক্ষম হয়নি তাদের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছাতে হবে সবার আগে। পৃথিবী যে পথে হাঁটছে তা সঠিক নয়। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে উঠলে তার ভিত্তি মজবুত হয়। ভ্যাকসিন পৌঁছে যাক পৃথিবীর প্রতিটি দেশে। তারপর একে একে পর্যায়ক্রমে তা প্রয়োগ করা হোক। আমি জানি এ কাজটি সহজ হবে না। তবুও আমাদের চেষ্টা করতে হবে।
২০২০ সাল থেকে শুরু করে চলতি বছর ২০২১ সালের শেষ পর্যন্তও করোনা মহামারি পৃথিবীতে তান্ডব চালিয়েছে। পৃথিবীর অর্থনীতি, রাজনীতি, খেলাধুলা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছু প্রায় স্থবির ছিল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে সবকিছু স্বাভাবিক হয়। চালু হয় অর্থনীতির চাকা। বিশ্ব কূটনীতি গতি পায়। মোট কথা, পৃথিবীতে জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এর মধ্যেই করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে। সবশেষে চলতি বছর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছিল মানবজাতির জন্য ভয়ঙ্কর। এর মধ্যে বিশ্বব্যাপী টিকা কার্যক্রম গতি লাভ করায় ক্রমেই মৃত্যু ও আক্রান্ত সংখ্যা কমতে থাকে। এই সুখবরের মধ্যেই দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। বিজ্ঞানীদের মতে এটাই এখন পর্যন্ত ভয়ঙ্কর ধরন। এই নতুন ধরনটি উদ্ভূত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। গত ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার খবর জানতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এরপর আরও কয়েকটি দেশে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া যায়। বিশ্বজুড়েই তুমুল উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এখন বিজ্ঞানীর নতুন এই ধরন নিয়ে ব্যস্ত।
বর্তমান টিকা এই ধরনের বিরুদ্ধে কতটুকু কার্যকর সেটাই নির্ণয় করার চেষ্টা চলছে। সেই সঙ্গে নতুন এই ধরনকে প্রতিরোধ কীভাবে করা যায় সেই চিন্তাও রয়েছে। ডেল্টা যেভাবে দ্রম্নতগতিতে ছড়িয়ে পৃথিবীতে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, মানুষের প্রাণ নিয়েছে সেভাবে ছড়ানোর আগেই ওমিক্রনের লাগাম টেনে ধরতে হবে। ডেল্টার সময়ের চেয়ে এখন পার্থক্য হলো এখন দ্রম্নতগতিতে টিকা কার্যক্রম চলছে। দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বজুড়েই উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে। করোনাভাইরাস কেন ভয়ঙ্কর তার একটি অন্যতম কারণ হলো প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ধরনের আবির্ভাব ঘটছে। এসব ধরন দ্রম্নত মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করছে। এখান থেকে সুরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা কার্যক্রম।
যেসব দেশ ইতিমধ্যেই দুটি টিকা নিশ্চিত করতে পেরেছে তারা এখন বুস্টার ডোজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু এতে কি টেকসই সমাধান আশা করা যায়। টেকসই সমাধান করতে হলে সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে হবে। একদিকে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ছে অন্যদিকে সামর্থ্যবান দেশগুলো বুস্টার ডোজ দেওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং এর বিপরীতে দরিদ্র দেশগুলো দুটি ডোজ সম্পূর্ণ করতে পারেনি। করোনা যেভাবে রুপ বদলাচ্ছে তাতে যে কোনো সময় নতুন কোনো ধরন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে সবার জন্যই দ্রম্নত টিকা নিশ্চিত করা যায়। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিকে নজর দিতে হবে। কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি অবহেলা করা উচিত হবে না। যে সব দেশে এখনো দুটি টিকাই নিশ্চিত করা যায়নি সে সব দেশের কী হবে? এসব দেশেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। এখন জনসমাগম হচ্ছে, কল-কারখানা চলছে। এসব পরিস্থিতিতে টিকা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ওমিক্রন খুব দ্রম্নতই ছড়িয়ে পড়ছে। ফ্লাইট বাতিল করা হচ্ছে। নতুন করে সবকিছু বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা চেপে বসেছে।
টিকা নিয়ে পৃথিবীতে যে বৈষম্য চলছে তা দূর করতে হবে। একটি নতুন পৃথিবী গড়তে হলে অবশ্যই সমতা বজায় রাখতে হবে। অলোক আচার্য : শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক