শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:১৫ pm
শিক্ষার্থী শিশু-কিশোররা এখনো সড়কে নিরাপত্তা, হাফ পাস বা অর্ধেক ভাড়ার দাবি নিয়ে প্রতিদিনিই সড়কে নামছে। তাদের হাতে প্লাকার্ড ‘ হাফ পাস তাদের অধিকার, নিরাপদ সড়ক চাই, হেলপার-কনডাকটর ও চালকদের অসদ্ব্যবহার, মেয়ে ছাত্রীদের গায়ে হাত দেয়া, ধর্ষণের হুমকি, হেনস্তা ইত্যাদি বন্ধের দাবি করছে। সরকার পক্ষ শিক্ষার্থীদের হাফপাসের ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা কার্যকর হয়েছে বিআরটিসিতে। বেসরকারি বাসের মালিকদের কাছে দাবিটি মেনে নেবার আহ্বান জানারেও তারা তা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছে, তাতে তাদের ক্ষতি হবে। সরকার বাহাদুর তার মানসম্মান নিয়ে চুপকে বসে আছেন। কবে নাগাদ শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবে পরিণত হবে, তা কেউ বলতে পারে না।
এরাব কোমলমতি ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে নটরডেম কলেঝজর ছাত্র নাঈম হাসান নিহত হবার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে। তার সঙ্গে যোগ হয় বাসে হাফ ভাড়া নেবার দাবিসহ মোট নয়টি দাবি। এর আগেও ২০১৮ সালে জাবালই-নূর নামের বাসের ধাক্কায় নিহত হয় দুই শিক্ষার্থী। সে-সময় যে আন্দোলন শুরু করেছিলো শিশু-কিশোররা, তার প্রতিদান দেবার প্রতিশ্রুতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দেবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু আজো সড়ক নিরাপদ তো হয়ই নি বরং আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বাসে/ট্রাকে/ ময়লাবহনকারী সিটি করপোরেশনের গাড়িগুলো।
একটি করে প্রাণ যায় আর আমরা দেখতে পাই বাসের/ ঠ্রাকের চালকদের দক্ষতা/যোগ্যতা/ লাইসেন্সহীনতা, নকল ওভাড়াটে ড্রাইভার ইত্যাদির শত শত অবৈধ ও দুর্নীতির চিত্র। ওই চিত্র কিন্তু অচল নয়, সচল। চলচ্চিত্রের মতোই সেই সব দুরাচার/দুর্নীতি চলছে অব্যাহতভাবে। সরকার এর কোনো সমাধান করতে পারছে না।
সরকার কেন পারছে না এই সমস্যার সমাধান করতে। কারণ বহুকারণের মধ্যে সরকারের ভেতরে থাকা গণপরিবহণখাতের বিনিযোগকারীরা রয়েছেন যেমন তেমনি বাসমালিকদের ম্রমিক নেতারাও রয়েছেন। বাস মালিকরা বিনিয়োগ করে লাভ চাইবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অতিলাভ করতে চাইলে তারা জিম্মি হয়ে পড়ে ম্রমিক ও শ্রমিকনেতাদের লোভ ও লালসার ঘেরে। এবং এরাই সরকারকে সঠিক কাজটি করতে দিতে চায় না। আর সরকার যেহেতু এই রকম শত রকম সংস্থার সহযোগদাতা, তাই প্রকৃত জনগণের/ শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারছে না। কিছু মানুষ আছেন যারা বলেনসরকার নিজেই তো বাস/ট্রাক মালিকদের রাজনৈতিক এজেন্ট, তাই তো শিক্ষার্থীদের দাবি বাস মালিকদের মানাতে পারে না। আসল সত্য কোথায় নিহিত, তা তো আমরা জানি না, তবে সরকার যদি শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ নাগরিকরা যে মনোভাব নিয়ে বড় হবে, তা সরকারের জন্য সুখকর ফল দেবে না।
২.
গণপরিবহনে যে নৈরাজ্য চলছে, তা পুরোনা ঘটনা। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুরু করেছিলেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। সড়কে এক নির্মম অ্যাক্সিডেন্টের ফলে কাঞ্চনের স্ত্রী নিহত হলে তিনি এই আন্দোলন মুরু করেন। এবং তিনি আজো নিরাপদ সড়কের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তার দাবি ও তার যুক্তিগুলো সরকারের কানে পৌছে না বা সরকার নিরাপদ সড়কের কনসেপ্টের সঙ্গে পরিচিত নন বলে তার দাবি মেনে নেন না। সরকার যখন কোনো হত্যাকান্ড, নির্বাচনী সহিংসতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটায়, তখন আমাদের মনে হয়, সরকার কোনো মানুষ নয়, ওই রাজনৈতিক সরকার কাঠামোতে জনপ্রতিনিধি নেই, নেই প্রশাসনেও কোনো মানুষ,যেন তারা রোবোটিক কোনো যন্ত্র, যারা জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে পারেন। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, দুই চারজন সড়কে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়াটা একটি সাধারণ ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এই সব বিচ্ছিন্ন ও সাধারণ ঘটনার জন্য সরকার নামক বিশাল সাম্রাজ্য তো আর কাঁদতে বসতে পারে না। তাই তারা নিয়মিত কাজ করেন এবং নিয়মিতই সড়কে/মহাসড়কে হত্যার ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। তাদের মনে কোনো রকম বেদনা/কান্না বা অনুভূতির কোনো ইতরবিশেষ হয় না।
কিছু বাস মালিকের কাছে যখন একটি রাজনৈতিক সরকার জিম্মি, তখন এ-নিয়ে কথা বলাই উচিত নয়। আমরা এ-নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। তবে, শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করুন সরকার, এটা চাই। কারণ সরকার একটি প্রশাসিনিক কাঠামো হলেও, এর চালকের আসনে বসে আছেন জনগণের প্রতিনিধি। আর সে-কারণেই জনগণের দাবি পূরণে সরকার দায়-দায়িত্ব রয়েছে। সরকারও সেটা মনে করে, তবে যদি বাসের মালিকদের সঙ্গে পেরে না ওঠে, তাহলে কি করতে হবে, তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা আছে।
৩.
গণপরিবহনের মালিকদের বাসের চেহারা দেখলে মনে হবে না যে এগুলোর কোনো যানচলাচলের পারমিশন আছে। এতোটাই পুরোনো ও লক্কড় চেহারার সেগুলো যে সেই পরিবহনে যাত্রার কোনো ইচ্ছাই যাত্রীরা পাবেন না। কিন্তু সেগুলোই দিব্বি চলছে। সেগুলো আসনও ভাঙা ও নোংরা, মনে হয় সড়কে নামানোর পর সেগুলো পরিস্কার করা হয়নি। যাত্রীদের সেবা দেবার নামে বাসের চালক/হেলপার/ কনডাকটররা যাত্রীদের সঙ্গে যে আচরণ করে, তাকে সেবা না বলে অন্যায় ও অবৈধ বলাই ভালো। তারা ছাত্রীতদর গায়ে হাত দেয়, ধর্ষনের হুমকি দেয়.. যা নিয়মিতই ঘটে থাকে।
এ-সব বাসের মালিকরাই শিক্ষার্থীদের হাফ পাস দিতে চায় না। আমরা বলতে চাই বিআরটিএ-র উচিত ওই লক্কড় গাড়িগুলোর লাইসেন্স বাতিল করে দেয়া। ঘুষ খেয়ে আর কতো আবর্জনায় চড়াবেন যাত্রী সাধারণকে? দয়া করে পরিবহণখাতের দুর্বৃত্তদের দমন করুন।
পরিবহন খাতকে উদ্ধার করতে পারে সরকার নতুন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ও তা বাস্তবায়ন করে। সরকার যেহেতু দেশের সবখাতকে ডিজিটালাইজ করতে চলেছে, তাই এখাতেও সেই বিষয়টি প্রয়োগ করলে উপকার মিলবে। একটি সরকারি কোম্পানির মাধ্যমে মহানগরের যাত্রী পরিবহন করতে উদ্যোগ নিতে পারে। নিউ ইয়র্কে যেমন মেট্রোপলিটান ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি যেমন বাস ও পাতাল ট্রেনের সব কিচু পরিচালনা ও উন্নয়ন কাজ করে তেমনি একটি অথোরিটি করে গোটা জঞ্জাল অপসারণ করা যেতে পারে। দরকার কেবল সদিচ্ছার। লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।