শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:০২ am
‘কামরুদ্দীন হীরা’ :
ভাসমান মানুষগুলো অবশেষে ঠিকানা পেল। রাস্তার ধারে পলিথিন দিয়ে খুপড়ি বানিয়ে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় যে মানুষগুলো আধো ঘুমে আধো জাগরনে রাতের তারা গুনতো তারা এখন আধাপাকা ঘরে সুয়ে সুখ নিদ্রা দেবার সুযোগ পাবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুসারে প্রতিটি পরিবার দু’টি সেমিপাকা টিন শেড ঘর একটি বসার ঘর সহ একটি রান্না ঘর ও একটি টয়লেট বরাদ্দ দিয়ে ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের মাঝে বিতরণ শুরু হয়েছে। দেশের গৃহহীন-ভূমিহীন ন’লাখ মানুষ তার স্বপ্নের ঠিকানা পাবে সরকারের এ প্রকল্পের মাধ্যমে। গত ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সারা দেশের উপজেলা প্রশাসনের সাথে যুক্ত হয়ে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের মাঝে ঘর বিতরনের মাধ্যমে তাদের স্বপ্ন পুরন করেন। সারা দেশের আট লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এ তালিকা অনুযায়ী গৃহ নির্মান ও পরিবার পুনর্বাসন চলবে। উপকার ভোগী প্রতিটি পরিবারকে দু’শতক জমির রেজিস্ট্রি মালিকানা দলিল হস্তান্তর সহ নতুন খতিয়ান ও সনদ হস্তান্তর করা হয়। প্রতিটি জমি ও বাড়ির মালিকানা স্বামী ও স্ত্রীর যৌথ নামে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় রাস্তা, স্কুল, মাদ্রাসা ও বাজার রয়েছে।
মুজিব শত বর্ষের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব হিসেবে দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাসমান মানুষদের একটি ঠিকানা উপহার দিতে পেরে। সত্যি বলতে কি রোধে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, পথে প্রান্তরে রাত কাটানো মানুষগুলোও খুব আনন্দিত। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, ঢাকা বিভাগে এক লাখ ২৯ হাজার ১৯৭, ময়মনসিংহ বিভাগের ৩৬ হাজার তিন, চট্রগ্রাম বিভাগের এক লাখ ৬১ হাজার ২৯৭, রংপুর বিভাগের এক লাখ ৮৩ হাজার ৮৩৪, রাজশাহী বিভাগের ৯৬ হাজার ৫০৪, খুলনা বিভাগের এক লাখ ৪২ হাজার ৪১১, বরিশাল বিভাগের ৮০ হাজার ৫৮৪, সিলেট বিভাগের ৫৫ হাজার ৬২২ ঘর হীন পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে জমি ও ঘর নেই এমন পরিবারের পাশাপশি ১০ শতাংশের জমি আছে। অন্যদিকে ২১ জেলার ৩৬টি উপজেলায় ৪১টি প্রকল্প গ্রামে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণের মাধ্যমে তিন হাজার ৭১৫টি পরিবার পূর্ণবাসন করা হয়েছে। একই সাথে একক ঘর ও ব্যারাকে মোট ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন ঘরহীন পরিবারকে জমি ও ঘর দেওয়ার ঘটনা বিশে^ এই প্রথম।
আশ্রয়ন-২: প্রকল্পের আওতায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ২৪ হাজার ৫৩৮টি পরিবারের জন্য মোট বরাদ্ধ ৪১৯ দশমিক ৬০ কোটি টাকা। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয়ে অধীন ৩৮ হাজার ৫৮৬টি ঘর বরাদ্ধ ব্যায় ধরা হয়েছে ৬৫৯ দশমিক ৮২ কোটি টাকা। ভূমি মন্ত্রণালয়েল অধীন গুচ্ছ গ্রাম দ্বিতীয় পর্যায়ে সিভিআরপি প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৬৫টি ঘর বরাদ্ধ করা হয়েছে। এখাতে বরাদ্ধ ৫২ দশমিক ৪১ কোটি টাকা। অতিরিক্ত পরিবহন বাবদ বরাদ্ধ (প্রতিটি ঘরের জন্য চার হাজার টাকা) মোট ২৬ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। এছাড়া সারা দেশের সব উপজেলায় জ¦ালানি বরাদ্ধ ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৪০ কোটি টাকা। মোট ৬৬ হাজার ১৮৯ পরিবারের জন্য বরাদ্ধ এক হাজার ১৬৮ দশমিক ৭১ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ন-২ প্রকল্প এই ঘর নির্মানে সামগ্রিক কার্যক্রম সমন্বয় করেছে। প্রত্যেক উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তত্ত্বাবধানে গঠিত কমিটি ঘর গুলো নির্মাণ করেছে।
রোধে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো নির্বাচনের সময় কখনো কখনো প্রার্থীর নিয়ামক শক্তি হলেও ভোটের পর এসব মানুষের খবর কেউ রাখে না। রবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বসত ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার শুরু করা আশ্রয়ন প্রকল্পের কাজ বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে টানা এক যুগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে আ’লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকার। ক্ষমতার দীর্ঘ এ সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে কঠোর পরিশ্রম করছেন দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দূরদর্শী নেতৃত্বেই গ্রামীন অবকাঠামো, খাদ্য নিরাপত্তা, শান্তি চুক্তি, সমুদ্র বিজয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি, নারী ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইর্ষনীয় সাফল্য এসেছে। দেশের চলমান এমন উন্নয়নের মাঝেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষনা করেন, ‘মুজিব বর্ষে দেশে কোন মানুষ গৃহহীন থাকবেনা। সরকার সব গৃহহীন, ভূমিহীন মানুষকে ঘর তৈরি করে দিবে’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ঐ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। আর সেই প্রতিশ্রুতির আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন শুরু হলো ২৩ জানুয়ারি।
১৯৯৭ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আশ্রয়ন প্রকল্পের সংখ্যা দু’হাজার ১৭২। নির্মিত ব্যারাকের সংখ্যা ২২ হাজার ১৬৪। ব্যারাকে পূনর্বাসিত ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা এক লাখ ৬৫ হাজার ৬৬৮। জমি আছে কিন্তু ঘর তৈরির সামর্থ নেই এমন এক লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৪ পরিবারকে সহযোগিতা করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিবারের জন্য নির্মিত বিশেষ ডিজাইনের ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে ৫৮০টি। পুনর্বাসিত পরিবারের সংখ্যা তিন লাখ ২০ হাজার ৫২। এর আগে মুজিব বর্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হিসাবে কক্সবাজারের জন্য নির্মিত ৫ তলা বিশিষ্ট ২০টি বহুতল ভবনে প্রথম পর্যায়ে ৬০০ জনবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে একটি করে ফ্ল্যাট উপহার দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ৫তলা বিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন তুলে চার হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পূনর্বাসিত করা হবে বলে জানা গেছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিকানাহীন মানুষকে ঠিকানা দিয়ে প্রমাণ করলেন আসলে মানুষ মানুষের জন্য। আন্তরিকতা আর ভালবাসা থাকলে যেকোন কাজ অসাধ্য নয়, তা তিনি আবারো প্রমাণ করলেন। ৭০ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের মাঝে মুজিব বর্ষের সেরা উপহার তাদের ঠিকানা তুলে দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই গৃহায়ন প্রকল্পে কোন শ্রেণী বাদ যাচ্ছে না। বেদে শ্রেণীকেও আমরা ঘর করে দিয়েছি। হিজড়াদের স্বীকৃতি দিয়েছি এবং তাদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দলিত বা হরিজন শ্রেণীর জন্য উচ্চ মানের ফ্ল্যাট তৈরি করে দিচ্ছি। চা শ্রমিকদের জন্য ঘর করে দিয়েছি। এভাবে প্রতিটি শ্রেণির মানুষের পূনর্বাসনে আমরা কাজ করছি।’ তার ইচ্ছা শক্তি এবং বাস্তবায়নে ক্ষমতার প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্তা আছে। সে দিন বেশি দূরে নয়, এদেশের সব মানুষ তার আপন ঠিকানায় উদ্ভাসিত হবে। দেশ হবে স্বনির্ভর। বাংলাদেশ উন্নত বিশে^র একটি সেরা দেশ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাড়াবে। আমরা সে দিনের প্রতিক্ষায় রইলাম।