বুধবা, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:৩৪ pm
ডেস্ক রির্পোট : বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ হাজার মেগাওয়াট। তবে এখন ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি গত আটই এপ্রিল একটি অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, দেশের ৯৯ দশমিক আট শতাংশ জনগণকে বিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। মুজিববর্ষেই তারা এটি শতভাগে নিয়ে যেতে চান।তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সক্ষমতা থাকলেও গড় উৎপাদন হচ্ছে নয় হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট।
এই মাসের এক তারিখ, পহেলা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ১৩০৭৫ মেগাওয়াট। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় ১১৬০ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন লক্ষ্যমাত্রা ২৫ হাজার মেগাওয়াটকে ছাড়িয়ে গেল। কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন করেছে।
কিন্তু ঢাকা বা বড় শহরগুলোতেেও লোডশেডিং থাকছে। তবে এখন গ্রামীণ এলাকায় অনেক বেশি লোডশেডিং হচ্ছে বলে জানা যায়। তাহলে এতো বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকার পরেও কেন সবাই পুরোপুরি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে না?
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বর্তমান চিত্র আসলে কী?
রাজবাড়ীর জেলা শহর থেকে কল্যাণপুর গ্রামটি মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখানকার বাসিন্দা আমেনা বেগমের বাড়িতে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে এক ঘণ্টা থাকে না। এই লোডশেডিংয়ের সঙ্গে তাদের গ্রামের সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
”আমরা বলি, বিদ্যুৎ তো যায় না, মাঝে মাঝে আসে,” তিনি বলছিলেন।
পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি নয় লাখ। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র?
বাংলাদেশে বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ চাহিদার অনুমান এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনাতেই গলদ রয়েছে বলে মনে করেন অনেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। এমন অভিযোগও রয়েছে যে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ধরা হয়েছে এবং দরকারের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতিদিনের বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও অনেক গ্রাহকই ঠিকমতো বিদ্যুৎ পাননা। বিশেষ করে এজন্য সবচেয়ে বেশি ভুগছেন গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা থাকলেও সঞ্চালন ও সরবরাহ লাইনের অভাব থাকায় বিদ্যুতে গ্রাহকদের কাছে সেটি ঠিকমতো সরবরাহ করা যায় না।
বিদ্যুতের ক্ষতি ‘ক্যাপাসিটি চার্জে’ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ গত জুন মাসে একটি প্রতিবেদনে মে মাসের একদিনের চিত্র তুলে ধরে দেখিয়েছিল যে, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশ বসিয়ে রেখে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দেয়া হচ্ছে।
অর্থাৎ সরকার যেসব তেল ও গ্যাস ভিত্তিক রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছিল, চুক্তি অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে না পারলে একটি নির্ধারিত চার্জ দিতে হয়। এটাই ক্যাপাসিটি চার্জ। বর্তমানে বাংলাদেশে টাকার অংকে সেটি বছরে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) ২০২০ সালে একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয়, বাকি ৫৭ শতাংশ অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেয়া হয়।
২০২২১-২২ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে যে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও বিভিন্ন সংস্থাকে ঋণ দেয়ার জন্য ৪৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে কৃষির পরের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এই বছর এই খাতে ভর্তুকি দেয়া হবে নয় হাজার কোটি টাকা। অবশ্য সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য, ভর্তুকি দেয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ হয়, তার চেয়ে কম মূল্যে গ্রাহকদের কাছে সেটি বিক্রি করা হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও সঞ্চালন-সরবরাহ ব্যবস্থা নেই
বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে সমন্বয়হীনভাবে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হলেও সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে সঞ্চালন ও সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়নি। ফলে বড় একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা বিভাগ পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতউল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”উৎপাদনের বিষয়গুলো বেশ লোভনীয়, লাভজনক, তাই সবাই এগুলো বানাতে চায়। রাজনৈতিকভাবে যারা শক্তিশালী, তারাই এগুলোর কন্ট্রাক্ট নেয়। কিন্তু ট্রান্সমিশন আর ডিস্ট্রিবিউশনে সেই আগ্রহটা নেই।”
তিনি জানান, বিদ্যুতের খরচের ক্ষেত্রে উৎপাদনে ৪০ শতাংশ, সঞ্চালনে ৪০ শতাংশ আর সরবরাহে ২০ শতাংশ খরচ হয়।
”উৎপাদনে একটা সংকটকে সামনে এনে সরকার উচ্চ কমিশনে উৎপাদনের চুক্তি করেছে। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে এখানে পয়সা বেশি, সুবিধা বেশি- এসব কারণে। আসলে ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা বলা হলেও বাস্তবে কিন্তু তা নায়। যেখানে ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা লেখা, সেখানে হয়তো উৎপাদন হয় ২০ মেগাওয়াট। ”
মি. রহমতউল্লাহ বলছেন ”আমাদের আসল চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট, কিন্তু আমাদের সরবরাহ লাইন হয়েছে সাত আট হাজার মেগাওয়াটের। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে, কিন্তু সেটা মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না। ফলে বিরাট একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গেছে। গ্রামে কিন্তু এখনো মারাত্মক লোডশেডিং হচ্ছে। অনেক মানুষ তাদের চাহিদা মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এদিকে ট্রান্সমিশন আর ডিস্ট্রিবিউশনের অভাবে কেন্দ্রগুলোও ঠিক মতো উৎপাদন করতে পারছে না।”
এই সমন্বয়হীনতা কাটাতে আরও তিন চার বছর কেটে যাবে বলে তিনি ধারণা করেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে সঞ্চালন লাইন রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ২৮ হাজার কিলোমিটার করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আর বর্তমানের বিতরণ লাইন রয়েছে ৬ লাখ ১৪ হাজার কিলোমিটার, যেটি আগামী নয় বছরের মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার করার পরিকল্পনা রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সঞ্চালনে কিছুটা ঘাটতি আছে। তাই সবসময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে হয়তো কিছুটা সমস্যা হয়।
তবে তিনি বলেন, এই সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে এটি তৈরি হয়ে যাবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা