শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৯:৫৮ pm
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান। গত রোববার রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেয় এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। এর ঠিক দুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটি একটি আফগান শিশুর।
নিউইয়র্ক পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, ছোট্ট মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, ‘আমাদের কেউ হিসাবে রাখে না। কারণ, আমাদের জন্ম আফগানিস্তানে।’ নিকটতম ভবিষ্যৎ নিয়ে এই শিশুর মতো আফগানিস্তানের অনেকেই এখন আতঙ্কে। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে এই আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি। কারণ, তাঁরা ইতিমধ্যে তালেবানের শাসন দেখেছেন।
আফগানিস্তানের কাবুল যে এখন আতঙ্কের নগরী, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেখানকার বিমানবন্দরের ভিডিও দেখলেই। সেখানে উড়োজাহাজে উঠতে হুড়োহুড়ি করতে দেখা গেছে আফগানদের। নিজের দেশে আফগানরা যে নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন না, তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। সর্বশেষ একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আফগানিস্তানের পাশে বিশ্বনেতাদের দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন আফগান ক্রিকেট দলের লেগ স্পিনার ও দেশটির টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক রশিদ খান। তিনি এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘আমার দেশে নৈরাজ্য চলছে। প্রতিদিন নারী, শিশুসহ হাজারো নিরীহ মানুষ শহীদ হচ্ছে। আমরা শান্তি চাই।’
শান্তি চাওয়ার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। কিন্তু সেই শান্তি, সেই অগ্রগতি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করতে যাওয়া তালেবানের হাত ধরে কতটা আসা সম্ভব, এই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। কারণ, একে তো আফগানিস্তানের শান্তি বহুদূরের পথ। আর অগ্রগতির কথা বলতে গেলেই আসে নারীদের প্রতি ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর শিক্ষা, নারীর স্বাস্থ্য, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো দেশের অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নারীদের এগিয়ে নেওয়ার আগ্রহ যে তালেবানদের খুব একটা নেই, তা অতীত শাসন থেকে স্পষ্ট।
এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া কিছু উপাত্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। সংস্থাটি বলছে, ২০০১ সালে যখন তালেবান সরকারের পতন হয়, তখন কোনো মেয়েশিশু স্কুলে যেত না। যদিও ওই বছর প্রায় ১০ লাখ ছেলে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ফলে প্রশ্ন ওঠে, নারীশিক্ষায় তালেবানের ভয় কিসের?
সাধারণভাবে একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রবণতা হলো নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা। এই অবস্থা বিশ্বজুড়েই বদলাতে শুরু করেছে। পুরো বিশ্বই এখন বুঝতে পারছে, সমাজের অগ্রগতির জন্য নারীর অগ্রগতি আবশ্যক। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকা সেই তালেবান কেন এই পশ্চাৎপদতা থেকে বের হতে পারল না? কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ২০ বছর পরেও নারীশিক্ষা, নারী ক্ষমতায়নের কথা কি ভাবতে পারছে তালেবান? অনেকে অবশ্য আপত্তি জানিয়ে বলতে পারেন, নতুন তালেবান সরকার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর আগে এসব প্রশ্ন কেন!
সত্যিকার অর্থে এসব প্রশ্ন ওঠার যৌক্তিক কারণ এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তালেবান কোনো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সেখানে শিক্ষার পরিবেশ কেমন হয়, তার একটি সরেজমিন প্রতিবেদন বছর পাঁচেক আগে করেছিল দ্য ডিপ্লোম্যাট। ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০১৬ সালে কুন্দুজ প্রদেশের কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। এরপর সেসব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করে শিক্ষা কারিকুলাম থেকে খেলাধুলা, সমাজবিজ্ঞান ও ইংরেজি ছেঁটে ফেলে তারা। সেই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৯০–এর দশকে ক্ষমতায় আসার পর ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা কারিকুলাম বাতিল করে তালেবান। সেই সময় মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তারা। আর এখন যেসব এলাকা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে, সেখানে মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ নারীশিক্ষার বিষয়ে তালেবানের মনোভাব বদল হয়নি।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। তালেবান যখন সরকারে ছিল, তখন তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল সৌদি আরব। নারীশিক্ষা, নারীর অগ্রগতির বিষয়ে এই দুই পক্ষের মনোভাব প্রায় একই রকম ছিল তখন। সৌদি আরব সেই গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসছে। নারীদের ওপর যে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল, তা খানিকটা শিথিল করেছে। কিন্তু তালেবান তার আগের অবস্থান থেকে খুব একটা সরেনি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত সরকার আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আগের অবস্থা বদলাতে শুরু করেছিল। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে আফগানিস্তানে সাক্ষরতার হার ছিল ১৮ শতাংশ। ২০১০ এসে সেই সংখ্যা ৩১ এবং ২০১৮ সালে এসে সাক্ষরতার হার বেড়ে হয় ৪৩।
এবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। ২০০১ সালে একজন নারীও স্কুলে যেতে পারছিল না। কিন্তু সেই চিত্র দ্রুত বদলাতে শুরু করে তালেবানবিরোধীরা ক্ষমতায় আসার পর। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনেসকোর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১২৪ জন ছেলের বিপরীতে ৮৩ মেয়ে ভর্তি হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ৭০ জন ছেলের বিপরীতে মেয়ে ভর্তি হয় ৪০ জন। বদল এসেছে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও। ২০১১ সালে উচ্চশিক্ষায় ৫ জন পুরুষ শিক্ষার্থীর বিপরীতে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২ জন। আর ২০১৮ সালে ১৪ জন পুরুষ শিক্ষার্থীর বিপরীতে নারী শিক্ষার্থী ছিল ৫ জন।
এসব ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় আফগানিস্তান এখনো পিছিয়ে। কিন্তু ২০০১ সালে শূন্য থেকে শুরু করা আফগান নারীদের বর্তমান অবস্থায় আসাটাও অগ্রগতি। আর এই অগ্রগতি যে শুধু সরকারি কিংবা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন বা সদিচ্ছার কারণে হয়েছে, এমনটা বিবেচনা করা অনর্থক। সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সাফল্যের মূল দাবিদার আফগান নারীরাই। কারণ, সংস্কার ভেঙে তাঁরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। নারীরা শিক্ষিত হওয়ার তাড়না বোধ করেছেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক রাষ্ট্রে আইন ভঙ্গ না করে, কারও ক্ষতি না করে যেকোনো কিছু করার অধিকার থাকার কথা। কিন্তু আফগান নারীরা সেই অধিকার পায়নি অতীতের তালেবান আমলে। আসন্ন তালেবান আমলেও তা পাওয়া যাবে—এমন আশাবাদী মানুষ হয়তো কমই মিলবে। হয়তো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া সেই ছোট্ট মেয়েটির কথাই বাস্তবে রূপ নিতে পারে। চূড়ান্ত হতাশ মুখচ্ছবিতে ওই মেয়েটি বলেই দিয়েছে, ‘আমাদের কথা কেউ ভাবে না। ইতিহাস পাতায় ধীরে ধীরে আমাদের মৃত্যু হবে।’
তবে কি এবারও নারী ইস্যুতে তালেবান আগের পথেই হাঁটবে? ইতিহাস বিবেচনায় নিলে অবশ্য ‘হ্যাঁ’ ভিন্ন অন্য কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
সূত্র : প্রথমআলো