নিজস্ব প্রতিবেদক : বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের উত্তরাঞ্চলে ১৪ লাখ তালবীজ লাগানো হয়েছিল। এত দিনে সেগুলো মাটি ছেড়ে দাঁড়ানোর কথা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- বিএমডিএ এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। এতে খরচ হয়েছে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে অন্তত ৮০ ভাগ তালগাছেরই হিসাব নেই। অভিযোগ রয়েছে, বিএমডিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে নয়-ছয় হয়েছে প্রকল্পের টাকা।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের তথ্য বলছে- বাংলাদেশে বজ্রপাতের জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালই ছিল সবচেয়ে উদ্বেগজনক। ওই বছর প্রায় ৪৩ লাখ বজ্রপাত হয়। এতে মারা যান প্রায় ২৬৩ জন মানুষ। দেশে এখনও প্রতি বছর গড়ে অন্তত দেড়’শ মানুষের মৃত্যু হয় কেবল বজ্রপাতে।
আর ফিনল্যান্ডের বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালার তথ্য মতে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৪০ লাখেরও বেশি বজ্রপাত আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। তবে গত বছর ছিল এ সংখ্যা ২৫ লাখের কিছু কম। এমন পরিস্থিতিতে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তালবীজ লাগানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরই রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা খরচে ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক ও খালের ধারে ১৪ লাখ তালবীজ রোপণ করা হয়।
প্রকল্প কর্মকর্তা ও বিএমডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মির্জাপুর খাড়ির প্রথম সোলার থেকে বান্ধারা ক্রসড্যাম পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারে ১২ হাজার, সরমংলা খাড়ির বেইলি ব্রিজ থেকে জগপুর ব্রিজ খালের পাড় পর্যন্ত ৮ কিলোমিটারে ৪ হাজার এবং সরমংলা খাড়ির ভাসপুর মৌজার সীমানা থেকে সয়িলা মৌজা পর্যন্ত ৮ কিলোমিটারে ৪ হাজার তালবীজ রোপণ করা হয়। এই ২০ হাজার তালবীজ রোপণে খরচ দেখানো হয় ২০ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
তিনি আরও জানান, পুঠিয়া উপজেলার বিহারিপাড়া শাহবাজপুর কান্দ্রা থেকে বাড়ইপাড়া খালের পাড়ে ১৪ কিলোমিটারে ২০ হাজার, চারঘাটের জয়পুর বাজার থেকে তারাপুর শলুয়া বালাদিয়াঢ় পর্যন্ত খালের দুই পাড়ে ১০ কিলোমিটারে ২০ হাজার, তানোর উপজেলার জোহাখালিখাল-জুরানপুর থেকে চান্দুড়িয়া পর্যন্ত ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে ২০ হাজার, কাকনহাট রেলগেট থেকে কুন্দলিয়া পর্যন্ত সড়কের দুই ধারে ১৫ কিলোমিটারে ২০ হাজার তালবীজ রোপণ করা হয়। এ ছাড়াও, পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের চকপ্রসাদপাড়া ক্রসড্যাম থেকে বাকশিমইল পর্যন্ত খাড়ির ধারে ২০ হাজার তালবীজ লাগানো হয়।
তবে, সরেজমিনে বিভিন্ন উপজেলার প্রকল্প এলাকা ঘুরে শতকরা ২০ ভাগ গাছও চোখে পড়েনি। তালবীজ কোথাও কোথাও গর্ত খুঁড়ে লাগানো হয়েছিল। আবার কোথাও কোথাও না লাগিয়েই তড়িঘড়ি করে বীজ ফেলে পালিয়ে যান ঠিকাদার। ঠিকমতো বীজ না লাগানোর কারণে এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়েছিল পবা উপজেলা দর্শনপাড়ার খাড়িধারে। এখানে ২০ হাজার তালের আঁটি লাগানোর কাজ পেয়েছিলেন বিএমডিএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ এক ঠিকাদার। ওই ঠিকাদার শর্ত মোতাবেক আঁটি না লাগিয়েই বিল তুলেছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
শীর্ষ কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী, এক বছর পাহারা ও পরিচর্যা শেষে তালগাছ বুঝে নেয়ার কথা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বিএমডিএ’র। কিন্তু বছর না ঘুরতেই এখন গাছের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও সরেজমিন কাজের মান দেখে খুশি হয়ে বিল পরিশোধ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের।
‘বরেন্দ্র এলাকায় তালবীজ রোপণ কর্মসূচির প্রকল্প’-এর পরিচালক ও বিএমডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম অবশ্য স্বীকার করেছেন, এই প্রকল্পে কিছু নয়-ছয় হয়েছে।
তিনি জানান, শর্ত মোতাবেক কাজের মান সন্তোষজনক না হওয়ায় কয়েকজন ঠিকাদারকে বিল দেয়া হয়নি। তবে কোন কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করা হয়নি তার তালিকা তিনি দেখাতে পারেননি। এখনও অন্তত ৬৫ ভাগ গাছ আছে।
এদিকে, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন বিএমডিএ’র নতুন চেয়ারম্যান সাবেক এমপি বেগম আখতার জাহান।
এ বিষয়ে সুশাসন বিশ্লেষক সুব্রত কুমার পাল বলছেন, ‘জনগণের কল্যাণে প্রধানমন্ত্রী নানা প্রকল্পকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তার নির্দেশেই প্রকল্প নেয়া হয়। অথচ এ ধরনের প্রকল্পগুলোতেও আমরা লুটপাট হতে দেখেছি। তালগাছ রোপণ প্রকল্পেও যারা দুর্নীতি করেছেন, জনগণের টাকা নয়-ছয় করেছেন; তাদেরকে অবিলম্বে আইনের আওতায় না আনা হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর যে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা তা বাস্তবায়ন হবে না। এ ধরনের দুর্নীতিতে অভিযুক্তরাই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন পরিকল্পনা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।