শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৪:৩৫ am
তিনি মহাকাব্যের মহানায়ক। তার স্মৃতিস্তম্ভ স্বাধীন বাংলাদেশ। তিনি আজ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের রাষ্ট্রপিতা। এমন মানুষের কি মৃত্যু হয়? খ্রিষ্ট সম্পর্কে তার অনুসারীরা বলেন, ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের পরেই তিনি জীবিত হন। তার কাছে নত হন রোমান সম্রাট। যারা তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন।
এ যুগে স্বাধীন বাংলার জনক সম্পর্কে বলা যায়, ঘাতকের বুলেট তার মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। ঘাতকের বংশধররা তার স্মৃতি ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। তিনি প্রাচীন উপকথার পাখির মতো দিগন্ত উদ্ভাসিত করে আবার জেগে উঠেছেন। বিশ্বের মানুষ অবাক হয়ে দেখেছে তার জন্মশতবার্ষিকীতে মহাকাব্যের পাতা থেকে মহানায়কের নবউত্থান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলার স্থপতি। জাতি আজ সশ্রদ্ধচিত্তে তার মৃত্যুদিবস পালন করছে।
যার মৃত্যু নেই, তার আবার মৃত্যুদিবস কী? বঙ্গবন্ধুরও মৃত্যুদিবস নেই। ১৫ আগস্ট তারিখে কিছু নরপশু তার বুকে গুলি চালিয়েছে। মানুষটিকে তারা মেরেছে। তিনি তার আদর্শের মধ্য দিয়ে নবজন্ম গ্রহণ করেছেন। সক্রেটিস বিষের পাত্র হাতে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার মৃত্যু ঘটাচ্ছো না, আমাকে অমরত্ব দান করেছো।’ সক্রেটিসের এই কথাটি বঙ্গবন্ধুর বেলাতেও প্রযোজ্য। তিনি ছিলেন নশ্বর মানুষ। মৃত্যু তার একদিন হতোই। কিন্তু ঘাতকের বুলেট তাকে চির অমরত্ব দান করেছে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজ শেখ মুজিব। আর ঘাতকের দল মানুষের ঘৃণা আর অভিশাপ নিয়ে কবরে শায়িত।
উপমহাদেশে দুটি রাজনৈতিক ধারা। একটি সাম্প্রদায়িক, অন্যটি অসাম্প্রদায়িক। অসাম্প্রদায়িক ধারাটির জন্ম দিয়েছিলেন মোগল সমাট আকবর। এজন্যই তাকে বলা হয় গ্রেট মোগল বা মোগল আজম। পণ্ডিত নেহেরুর মতে আকবর ছিলেন আধুনিক ভারতের ফাউন্ডিং ফাদার। আধুনিক ভারতের স্থপতি। আকবরের শেষ জীবন হয়েছিল দুঃখময়। তার অসাম্প্রদায়িক ধর্মাদর্শ দ্বীনে ইলাহির সমর্থক, আইনে আকবরির প্রণেতা আবুল ফজল ও ফৈজিকে উগ্র মৌলবাদীরা হত্যা করে। ঔরঙ্গজেবের আমলে এই উগ্র মৌলবাদীরাই ক্ষমতায় বসে। ঔরঙ্গজেব তার নিজের বড় ভাই দারা উপনিষদ ফার্সিতে অনুবাদ করার অপরাধে ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করেন। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা তখনই।
নবাবি আমলে নবাব আলীবর্দী ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা উভয়েই বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। ইংরেজ আমলে দেওবন্দের আলেমদের দুভাগে ভাগ হতে দেখা যায়। একদল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন, অপর দল কংগ্রেসবিরোধী। হিন্দুদের সঙ্গে মিশে কোনো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যেতে নারাজ। ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের আন্দোলনে যেসব আলেম ছিলেন, তারা হলেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মাদানি প্রমুখ। এই আলেমদের সাম্প্রদায়িক ধারাটির নেতা ছিলেন মওলানা আজাদ সোবহানী। জিন্না তাকে দিয়ে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দে ভাঙন ধরান এবং সোবহানী জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম নামে পাল্টা দল গঠন করেন। এই দল জিন্নার পাকিস্তান দাবি সমর্থন করে।
ফরিদপুরের পীর বাদশা মিয়া ও দুদু মিয়ার জন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ততটা মাথা তুলতে পারেনি। সম্ভবত সে কারণে গোপালগঞ্জের শেখ পরিবারেও পারেনি। শেখ মুজিব শৈশব থেকেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবেশে মানুষ হয়েছেন। তার কৈশোর কেটেছে খেলাফত ও অসহযোগের যুক্ত আন্দোলনের মধ্যে। খেলাফত আন্দোলনের নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাংলার মুসলমানদের দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। ফজলুল হকের অসাম্প্রদায়িক কৃষক প্রজা পার্টির মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিরাট নির্বাচন বিজয় এবং গরিবের জন্য ডালভাতের ব্যবস্থা করার কর্মসূচি যুবক মুজিবকে বেশি প্রভাবিত করেছে।
মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের জনজোয়ারের সময় বঙ্গবন্ধু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন এবং মুসলিম লীগ রাজনীতিতে যোগ দেন। কিন্তু কৈশোর থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যার মানস গঠন করেছে, তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুসারী হন কী করে? তিনি আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে যুক্ত হন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই কলকাতাকে সারা পাকিস্তানের রাজধানী, চট্টগ্রামকে নেভাল হেডকোয়ার্টার করা এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলেছেন।
স্বাধীন বাংলার স্থপতিকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমার বলার কথা, সম্রাট আকবরের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় আবুল ফজল, ফৈজি ও দারাশেকোর মতো শেখ মুজিব সাম্প্রদায়িকতার ছুরিতে আত্মহুতি দিয়েছেন। আকবর চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমানের মিলিত এক নতুন ভারত গড়তে। ধর্মান্ধদের ছুরি তার স্বপ্নকে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে শাহজাদা দারাশেকোর ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ার স্বপ্নকে। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকেও হত্যা করতে চেয়েছে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি।
কিন্তু এবার তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। আকবর ও দারাশেকো তাদের স্বপ্নকে একটি আন্দোলনে রূপ দিতে পারেননি। তাকে জনগণের শিকড়ে পৌঁছে দিতে পারেননি। যে কাজটি সাম্রাজ্যের অধিপতি না হয়েও জনগণের অধিনায়ক শেখ মুজিব পেরেছেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তার আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। তার স্বপ্নের সোনার বাংলা এখনো গড়ে না উঠলেও গড়ে ওঠার পথে এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে চলার পথেই শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে। পালিত হয়েছে সারা বিশ্বময়।
তিনি আজ মৃত্যুহীন। মহাকাব্যের মহানায়ক। টুঙ্গিপাড়ায় তার সমাধির সামনে বিনম্রচিত্তে নতশিরে হাজার মানুষ। সম্ভবত তাদের মনে আজ একটি গানই বাজছে-
‘মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা, তোমার দয়া
রবে চির পাথেয় চির যাত্রারণ।’
হে মহানায়ক, হে চিরসারথি, তোমার মৃত্যুহীন জীবনের জন্য আমাদের অশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মান। মুজিব মারা গেছে, বঙ্গবন্ধু চিরজীবিত। সূত্র : যুগান্তর