শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:০৭ am
আর কে রতন : হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ নিয়েই শত শত বছর ধরে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে ওরা আজও টিকে আছে। আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার ধার ধারে না ওরা। নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখে বেদে সমাজের প্রচলিত ব্যবসাকেই ওরা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। শত কষ্টের মাঝেও এতেই যেন ওরা সব সুখ-শান্তি খুঁজে পায়।
বেদে সমাজের নারীরাই সংসারের মূল চালিকাশক্তি। নারীরা দূর-দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জে গিয়ে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করতে অভ্যস্ত। নারীরা রোগের জন্য মানুষের কাছে তাবিজ, কবচ, ওষুধ, কড়ি বিক্রি করে এবং মানুষকে যাদু ও সাপ খেলা দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে। আর পুরুষরা পাখি শিকার করে এবং সাপ ও মাছ ধরে অর্থ উপার্জন করে। এভাবেই বেদে সম্প্রদায় তাদের কষ্টে গাঁথা যাযাবর জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। দাঁতের পোকা ফালাই। কোমর ব্যথা, বাত ব্যথায় শিঙা লাগাই। যাদু দেখাই।
সাপ খেলা দেখাই। খা-খা-খা বখখিলারে খা, কাঁচা ধইরা খা। প্রচলিত এ কথাগুলো নদীতে ভাসমান যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের নারীদের। সুর ও ছন্দ মিশ্রিত এ কথাগুলোই জানান দিচ্ছে বেদেদের উপস্থিতি। এদের আরেকটি অংশ সড়ক পথে এসে নদী তীরে বাঁশের চেরা ও পলিথিনের সাহায্যে অস্থায়ী ছোট ছোট ডেরা বেঁধে খুপরি ঘরে ঘাঁটি গেড়ে থাকতে দেখা যায়। রাতের বেলা কারো ঘরে সোলার বাতি আবার কারো ঘরে চার্জার লাইট ব্যবহার করে থাকে।
রাজশাহী কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহা. কামরুজ্জামানের বলেন, যাযাবর বা ভবঘুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেদে সম্প্রদায় অন্যতম। প্রান্তিক এই সম্প্রদায়ের সিংহভাগ নারী-পুরুষই ভাসমান জীবন যাপনে যুগ যুগ ধরে অভ্যস্ত। স্থানীয়ভাবে এরা ‘বাইদ্যা’ নামে পরিচিত। তাদের একটা অংশ ডাঙায় স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও বড় অংশ নৌকায় নদীতে ভাসমান অবস্থায় বসবাস করে আসছে। কালের প্রভাবে বেদের জীবন বৈচিত্র্যে এসেছে পরিবর্তন, হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। বেদেরা একটি ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠী। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের একটি অংশ।
কথিত আছে ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজ বল্লাল রাজার সাথে এরা এদেশে আসে। এর পর হতে তারা বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। তারপর সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। বেশির ভাগ বেদে সম্প্রদায়ের লোক চিকিৎসার সাথে স¤পৃক্ত বলে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে অভিহিত হয়। রাজশাহী সরকারী সিটি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগীয় প্রভাষক ইনাল হক বলেন, নৌকায় নৌকায় বা বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী ভাবে ভ্রাম্যমান ঘর করে কিছু দিনের জন্য থাকা এই ভাবে ঘুরে ঘুরে জীবন অতিবাহিত করার কারণেই এদেরকে যাযাবর বলা হয়। বৈচিত্রময় ও বর্ণিল জীবনের সবটুকু রং দিয়ে তারা তাদের জীবন সাজায়।
আমরা বেদের দেখতে পাই খুব পরিপাটি এবং রং-বেরংয়ের কাপড় পরিধান করে থাকে তারা। পোশাকের মতোই তাদের জীবন। কিন্তু সমাজের মূলধারার জনগণের সঙ্গে তাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি আলাদা হওয়ার কারণে তারা অনেকটাই পশ্চাৎপদ। আর এই পশ্চাতপদতার সূত্র ধরে তারা সাপ খেলা, তাবিজ-কবজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই বলে বেদেদের কাজকর্ম শুধু সাপ খেলা আর তাবিজ-কবজ বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা চুড়ি, ফিতা, বিভিন্ন শেকড়-বাকর বিক্রি ছাড়াও আদি ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতির অনেক উপকরণও তারা বিক্রি করে থাকে। বেদেরা মাতৃতান্ত্রিক হলেও বর্তমানে তাদের সমাজ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। সওদাগর শ্রেণী নাম দিয়ে তারা এখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তৈরি করেছে। কুসংস্কার ও উদাসীনতার কারণে বেদেরা শিক্ষার আলো ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত থাকায় শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রজন্মের পর প্রন্ম অন্ধকারেই পড়ে থাকে।
ফলে সচেতনতার অভাবে বেশিরভাগ সময়েই ওরা স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে। এমনকি অনেক সময় ওদের কেউ কেউ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণও করে। শিক্ষার আলো না থাকায় বাইরের জগত থেকে ওরা আলাদা। বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জানার আগ্রহও ওদের নেই। ওরা দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। বেদেরা শীতের মৌসুমে দেশের দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকায় ১ মাস করে ৫-৬ মাস থাকে।
বর্ষামৌসুমে ওদের ব্যবসায় ভাটা পড়ে। সে কারণে জীবিকার উদ্দেশ্যে ওরা আবার চলে যায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা বা উপজেলায়। বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই ওরা নদীতে নৌকায় ভেসে কাটায় এবং আরেক অংশ ডাঙ্গায় খুঁপড়ি ঘর করে সেখানে বসবাস করে থাকে। আজকের তানোর