শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৪:৪৮ am
পরীমণি প্রসঙ্গ নিয়ে আমাকে আবার লিখতে হচ্ছে। তাঁর মানবিক ও নাগরিক অধিকারের ওপর যে আঘাত করা হয়েছে এবং তিনি যেভাবে অপবাদ ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, তার প্রতিবাদ করাটা আমার সাংবাদিকতার দায়িত্ব মনে করেছি। রিমান্ডে নেওয়ার নামে যাতে তাঁর ওপর অত্যাচার না হয়, জোর করে মিথ্যা জবানবন্দি যাতে নেওয়া না হয় এবং তাঁর ক্যারিয়ার যাতে ধ্বংস করা না হয়, এটাই এখন লক্ষ করার বিষয়। এ জন্যই এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করছি।
আমার উদ্বেগের কারণ, আমি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে অভিযোগ পেয়েছি, বোট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আমাদের পুলিশপ্রধান। তাঁরই ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার মামলা করেছিলেন পরীমণি। সেই মামলার আসামি প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পরীমণির বিরুদ্ধে অভিযোগ সাজিয়েছেন কি না, সেটাও ভেবে দেখা উচিত।
এই রাষ্ট্রশক্তি ও অর্থশক্তি তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে পিষে ফেলতে চাইছে এক অসহায় তরুণীকে। তাঁর বাসা তল্লাশির জন্য র্যাব কোনো তল্লাশি পরোয়ানা অথবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে যায়নি। বলা হচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট’ অভিযোগ পাওয়ায় র্যাব অ্যাকশন নিয়েছে। কিন্তু এই ‘সুনির্দিষ্ট’ অভিযোগ কী এবং এই অভিযোগ কারা করেছে, র্যাব তা বলেনি।
নিজের বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে ব্যাপার কী জানতে চেয়ে পরীমণি পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন সাহেবকে ফোন করেছেন। এটাকেও তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের একটা হাতিয়ার করা হয়েছে। মানুষ মাত্রই বিপদে পড়লে পরিচিতজনকে ডাকে বা তার সহায়তা চায়। হারুন সাহেবকে তাঁর কর্মদক্ষতার জন্য দেশের অনেকেই চেনেন। কিছুদিন আগে হেফাজতি মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের ব্যাপারেও তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। পরীমণি তাঁকে চেনেন বিধায় টেলিফোন করে থাকলে এমন কী অন্যায় করেছেন?
পরীমণিকে হেয় করার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও টানাটানি চলছে। ঢাকায় এমন অনেক নামকরা নারী আছেন, যাঁদের বেডরুমে লুকিয়ে ক্যামেরা রাখলে এর চাইতেও ভালো প্রেমের গল্প ফাঁদা যায়। পরীমণির বাড়িতে শূন্য মদের বোতলের সঙ্গে এলএসডি পাওয়ার গল্প যুক্ত করে যে অভিযোগ দাঁড় করানো হয়েছে, তাতে তাঁর প্রতিপক্ষ শক্তিশালী গ্রুপটি আশা করে তাঁকে জেলে পাঠাতে পারবে। যদি তা-ই হয়, তাহলে সেটা হবে ষড়যন্ত্রের জয়, সত্যের জয় নয়।
এ জন্যই আমি দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, নারী সমাজ ও নাগরিক সমাজকে এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানাই।
ডা. জাফরুল্লাহর মতো প্রবীণ ব্যক্তি পর্যন্ত বোট ক্লাবের ঘটনা থেকেই যে পরীমণির ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের এই ষড়যন্ত্র, এটা সহজেই বুঝতে পেরেছেন। আমাদের নেতারা সেটা কেন বুঝতে পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না, তা আমি জানি না।
পরীমণির বাড়িতে মাদকদ্রব্য পাওয়া সম্পর্কে একটা গল্প বলি। বিএনপি সরকারের আমলে আমি একবার লন্ডন থেকে ঢাকায় ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিই। শেখ রেহানা তা শুনে বললেন, ‘চাচা, এই সময়ে দেশে যাবেন না। আমিও যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু যাইনি। ঢাকা এয়ারপোর্টে নামলেই দেখা যাবে আমাদের ব্যাগেজে মাদকদ্রব্য রাখা আছে। এই মাদকদ্রব্য রাখার অপরাধে আমাদের গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশের দ্বারাই এই মাদক গোপনে আমাদের ব্যাগেজে ঢোকানো হবে।’
শেখ রেহানার সতর্কবাণী শুনে সেবার আমি আর ঢাকায় যাইনি। বর্তমান সরকার দেশে মাদক ব্যবসাবিরোধী অভিযান শুরু করেছে। এটা ভালো কথা। কিন্তু এর খারাপ দিক হচ্ছে, পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে মামলা সাজাতে না পারলেই মাদক ব্যবসা বা অবৈধ মাদক রাখার অভিযোগ আনে।
আমার সমর্থন পরীমণির দিকে এ জন্য যে তাঁর প্রাইভেট লাইফ সম্পর্কে আমি কোনো জাজমেন্ট দিতে চাই না। কিন্তু তিনি যে দেশের নব্য ধনী ও তাদের সহযোগী একশ্রেণির পুলিশ ও র্যাব অফিসারের ক্রোধের পাত্রী হয়ে তাঁর নাগরিক অধিকার হারিয়ে পুলিশের রিমান্ডে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছেন, তার প্রতিবাদ করা। একই অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত দুই মডেলকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়নি। কারণ, তাঁদের ওপর ভয়ানক শক্তির কোনো ক্রোধ নেই। ক্রোধের পাত্রী পরীমণি। আজ যদি সমাজ তাঁকে অত্যাচারিত হতে দেখেও নীরব থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে এবং দেশে আইনের শাসনের বদলে মাফিয়াদের রাজত্ব সৃষ্টি হবে।
পশ্চিমা সভ্য দেশে আমরা কী দেখছি? হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনের ফলে আজ ওয়েস্টিনের মতো বিরাট ধনী জেলে। ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু প্রতিষ্ঠিত ও নামী চিত্রতারকা স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, ওয়েস্টিন তাঁর ছবির নায়িকা করার লোভ দেখিয়ে তাঁদের শয্যাসঙ্গী করেছেন। কোনো প্রতিষ্ঠিত নায়িকা তাঁর প্রস্তাবে রাজি না হলে ছবি থেকে বাদ দিয়ে তাঁর ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছেন। এক চিত্রতারকা প্রকাশ করেছেন, ওয়েস্টিনের ছবিতে অভিনয় করার জন্য তিনি ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন। ওয়েস্টিন তাঁকে জোর করে বাথরুমে নিয়ে ধর্ষণ করেন।
এসব চিত্রতারকা বহুকাল নির্যাতিত হয়েও লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খোলেননি। মিটু আন্দোলনের সুযোগে তাঁরা একসঙ্গে মুখ খোলেন। সে জন্য কেউ তাঁদের রাতের রানি, রাস্তার বাজে মেয়ে বলে প্রচার চালায়নি, যে প্রচার চলছে বাংলাদেশে পরীমণির বিরুদ্ধে। পরীমণি উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতে পারেন। এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করেছিলেন ব্রিটেনের বর্তমান রানির ছোট বোন প্রিন্সেস মার্গারেট। সে জন্য কেউ তাঁকে পতিতা বলেনি। পরীমণি প্রিন্সেস মার্গারেট নন। সাধারণ পরিবারের পিতৃমাতৃহীন একটি মেয়ে। নিজের সাহস ও চেষ্টায় পরীমণি চলচ্চিত্রে নিজের জায়গা করে নেওয়ার সংগ্রামে যুক্ত আছেন। কিন্তু এখন তাঁর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির মিডিয়া ও মিডিয়া কর্মী পরিচয়ের ব্যক্তি তাঁদের যে চরিত্র দেখালেন, তা কোনো সভ্য সমাজে দেখা যায় না।
আমি আজ জীবনসায়াহ্নে পৌঁছেছি। পরীমণিকে সমর্থন করার পেছনে আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। আমি দেশের নব্য ধনীদের শক্তির দম্ভ এবং ওই দম্ভের সঙ্গে কিছু ঊর্ধ্বতন র্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তার যোগসাজশ দেখে ভয় পাচ্ছি। হাসিনা সরকারকে আন্দোলন করে ক্ষমতা থেকে হটানো যায়নি। এখন চলছে দেশের জনজীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন অস্থিরতা সৃষ্টির চক্রান্ত চলছে। এই অস্থিরতা সৃষ্টিরই একটি অংশ পরীমণিকে নানা মামলায় ফাঁসানো কি না, সেটা সচেতন সবাইকে আমি ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই।
আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবারও অনুরোধ জানাই, কাছের লোকেরও কানকথায় প্রভাবিত না হয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা দ্বারা চারদিকের অবস্থা বিবেচনা করুন। বিতর্কিত চরিত্রের কিছু র্যাব ও পুলিশ অফিসার সম্পর্কে খোঁজখবর নিন এবং প্রয়োজন হলে তাঁদের অপসারণ করুন। পরীমণির মতো অসহায়দের জীবন ও সম্মান বাঁচান।
আমার কথা, যে পুলিশ ও র্যাব সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আজ পর্যন্ত কিনারা করতে পারছে না (অথবা ইচ্ছে করেই করছে না) এবং যারা বোট ক্লাবের ঘটনায় ধর্ষণচেষ্টায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাইরে বেরিয়ে এসে প্রতিশোধ গ্রহণের চক্রান্ত করার সুযোগ দিয়ে আক্রান্ত নারীকে সুরক্ষাদানের বদলে হায়েনার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের ওপর দেশের মানুষ আস্থা রাখবে কী করে? লেখক : বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট। লন্ডন, বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১।