ভোর হয়ে আসছে। নীরব চারদিক। ময়মনসিংহ শহরের চোখে ভোররাতের আদুরে ঘুম। এ রকম নীরবতা ভেঙে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে আটটি গাড়ির বহর। আকুয়াপাড়ার আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়িগুলো এসে থেমে গেল শেষ মাথায়। ধূসর রঙের চারতলা সিকান্দার ভিলার সামনে।
কালো উর্দি পরা একজন গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকালেন। এরপর ডান হাত তুলে সঙ্গীদের ইশারা দিলেন। খুলে গেল আট গাড়ির দরজা। নেমে পড়লেন আরও ৪০ জন। ভারী বুটের আওয়াজে মাটি কেঁপে উঠল। দলের নেতাও কালো উর্দি পরা। কাঁধে লে. কর্নেলের ব্যাজ। বুকে নামফলকের জায়গাটা খালি। এক মিনিটেরও কম সময়। ততক্ষণে চারতলা ভবনের চারদিক নজরবন্দী। আশপাশের বাড়ির ছাদে উঠে পড়লেন কেউ কেউ। কয়েকজন দরজার সামনে।
নিচতলায় কলাপসিবল গেটে বড় তালা ঝুলছে। পাশে চারতলার চারটি কলবেল। কোনো কিছু না ভেবে একটি বেলে চাপ দিতেই পাখির কিচিরমিচির শব্দ। তৃতীয় তলা থেকে বারান্দায় এসে উঁকি দিল এক কিশোর, ঘুম জড়ানো চোখে জিজ্ঞেস করল, কে?
সকালের ঘুম ভাঙার বিরক্তি নিয়ে বারান্দায় আসা কিশোর উঁকি দিয়েই থমকে গেল। নিচের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করে না, নিচে নেমে এল।
একজন মেজর জানতে চাইলেন–এ বাড়িতে একটি শিশুর জন্ম হয়েছে?
কিশোরের ভয়ার্ত চোখ, মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ।
সে কোথায়? জানতে চাইলেন মেজর।
নিচতলার ভাড়াটের ঘর দেখিয়ে দিল কিশোর। মেজর সামনে দাঁড়ানো লে. কর্নেলের দিকে তাকালেন, মনে হলো শিকার মিলেছে। আর দেরি করার সময় নেই। একজন নিচের তলার দরজায় ঘা দিলেন। দুবার ঘা দিতেই ক্যাচক্যাচ শব্দে কে যেন দরজা খুলে দিলেন।
ঘরে মশারির ভেতরে বোরকা পরা দুই নারী। একজন বসে, আরেকজন শুয়ে। মনে হলো বসে থাকা নারী দরজা খুলে দিয়ে আবার বিছানায় উঠে বসেছেন। নিজের ঘরের বিছানায় বোরকা পরে শুয়ে থাকা দেখে কর্মকর্তারা হতবাক।
এক নারীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী?’
নারী চমকে উঠে বললেন, ‘এ নামে তো কাউকে চিনি না।’
আপনার স্বামী কোথায়? প্রশ্ন করতেই ত্বরিত জবাব, ‘বিদেশে।’
পাশে আরেকটি ঘর, শুয়ে আছেন এক যুবক। তাকে টেনে তুলে আচমকা জিজ্ঞেস করা হলো, ‘এই, এখানে তোর বউ কোনটি?’
যুবক থতমত খেয়ে এক নারীকে দেখিয়ে বলল, ‘এইটা আমার বউ।’
কর্মকর্তার প্রশ্ন, ‘তাহলে ওই নারী কে?’
যুবক জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘উনি বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী।’
এবার বল, বাংলা ভাই কোথায়? জানতে চান কর্মকর্তা। নারী বলেন, আমি জানি না। কর্মকর্তারা চাপ সৃষ্টি করতেই বলেন, মুক্তাগাছায় আছেন। মুক্তাগাছার কোথায় জানতে চাইলে জবাব আসে, ‘সেটা জানি না, কোনো দিন যাইনি।’
কর্মকর্তারা এবার সরাসরি যুবককে বলে বসেন, ‘এই, তুই জানিস। চল আমাদের সঙ্গে।’ যুবক উপায়ান্তর না দেখে হ্যাঁ–সূচক মাথা নেড়ে নিচে নেমে আসে।
যে দলটি এই অভিযান চালাচ্ছে, তাদের নেতা লে. কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ। দলের বাকি সদস্যরা র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্য। এঁদের হাতে আছে ভারী অস্ত্র আর বুলেটরোধী পোশাক। কারও মুখে কোনো রা নেই। সবাই শুধু দলনেতার আদেশ ফলো করছেন।
গাড়িগুলো আবার ছুটতে শুরু করল। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল হাইওয়ে ধরে পশ্চিমে, মুক্তাগাছার দিকে।
২০০৬ সালের ৬ মার্চের সকাল। জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী ফাহিমা এবং তাঁকে শনাক্তকারী সেই যুবককে নিয়ে সকাল সোয়া ৬টায় শুরু হয় র্যাবের ‘অপারেশন মুক্তাগাছা’। মুক্তাগাছা থানা থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে যাওয়ার পর শেষ হয়ে গেল পাকা রাস্তা। গাড়ি আর চলে না। এবার শুধু পায়ে হাঁটা।
সারা দেশে তখন জেএমবির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকে ডাকাতি করছে জেএমবি। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৬টি হামলায় ৭৩ জন নিহত আর প্রায় ৮০০ লোক আহত হয়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। দেশ-বিদেশের চাপের মুখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। জঙ্গি নির্মূলের দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নেমেছেন লে. কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ। এর চার দিন আগে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেট থেকে আবদুর রহমানকে ধরতে ৩৩ ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান হয়েছে।
সব জিজ্ঞাসাবাদেই আবদুর রহমানের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে বাংলাভাই কোথায়? কিন্তু শায়খ রহমান মুখ খুলতে নারাজ। ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ভেঙে পড়েন শায়খ রহমান। রাত পৌনে ১টার দিকে তিনি জানান, বাংলা ভাই ময়মনসিংহে অবস্থান করলেও তিনি তাঁর ঠিকানা জানেন না। ঠিকানা জানে রিমন। রিমন তাঁকে ময়মনসিংহে বাংলা ভাইয়ের আস্তানায় নিয়ে যেত। আমানুল্লাহ রিমন হলো কলেজছাত্র।
‘রিমন কোথায়?’
শায়খ বললেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য সিলেটে গেছে। দক্ষিণ সুরমার একটি বাড়িতে আছে। রাতেই সে খবর সিলেটে র্যাব-৯কে জানানো হয়। অধিনায়ক তখন সিলেটে নেই। মেজর শিব্বির রাত সোয়া ২টায় রিমনকে আটক করেন।
সিলেটে রিমনকে জেরা চলছে আর ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে রওনা হয়ে গেছেন র্যাবের কর্মকর্তারা। গুলজার উদ্দিন ছাড়াও দলে আছেন কমান্ডার মাসুক হাসান আহমেদ, মেজর জাভেদ, মেজর কোরবান, মেজর আতিক, মেজর ওয়াছি, ক্যাপ্টেন তানভিরসহ ১৫-২০ জন কর্মকর্তা। সঙ্গে নেওয়া হয়েছে সিলেটে শায়খ রহমানের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা জঙ্গি হানিফকে।
সিলেটে রিমনকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে আকুয়াপাড়ার উজ্জ্বল ভিলায় বাংলা ভাই আছেন বলে জানায়। আরও নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের পর সিকান্দার ভিলার নাম বলে। রিমন জানায়, ওই বাসায় কিছুদিন আগে একটি শিশুর জন্ম হয়েছে। সেই সূত্রই ছিল ‘অপারেশন মুক্তাগাছা’র সবচেয়ে বড় ক্লু।
জঙ্গিবিরোধী প্রতিটি অভিযানেই র্যাবের কর্মকর্তাদের অনুসরণ করেছি ছায়ার মতো। চাঞ্চল্যকর গোয়েন্দাকাহিনির মতোই সেই সব অভিযানের পরতে পরতে ছিল উত্তেজনায় ঠাসা। এসব অভিযানে কর্মকর্তারা যে সাহস দেখাতেন, তা ছিল শিউরে ওঠার মতো। এখনো মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
মুক্তাগাছার রামপুর গ্রামে পৌঁছানোর আগে র্যাব সদস্যরা ৯টি দলে ভাগ হয়ে যান। একটি দল বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী–পুত্র ও সেই লোকটির পাহারার দায়িত্ব নেয়। এরপর তাঁরা সবাই প্রায় পাঁচ কিলোমিটার মেঠো পথে হেঁটে চলে আসেন সেই বাড়ির সামনে, যেখানে বাংলা ভাই আছেন বলে জানিয়েছিল সেই যুবক।
বাংলা ভাইয়ের বউ–ছেলেকে পাশের বাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়। র্যাব কর্মকর্তারা তখন চারদিক থেকে বাড়িটি ঘেরাও করে ফেলেন। লে. কর্নেল গুলজার হুংকার দিয়ে বলেন, ‘বাংলা, তোর দিন শেষ। তুই বেরিয়ে আয়।’ হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে দাড়িওয়ালা এক লোক বেরিয়ে দৌড়াতে থাকে। তাকে বাংলা ভাই ভেবে ধাওয়া করেন কয়েকজন। বাড়ির সামনে র্যাব কর্মকর্তারা ভেতরে ঢুকবেন কি না, ইতস্তত করছেন। আশপাশে কেউ নেই। সব ঘরের দরজা বন্ধ।
এগিয়ে এলেন সার্জেন্ট রফিক। সজোরে দরজায় লাথি মারলেন। দরজা খুলে গেল। সার্জেন্ট রফিক ভেতরে মুখ বাড়াতেই লাঠির বাড়ি এসে পড়ল তাঁর মাথায়। হাতের পিস্তলটি পড়ে গেল। ভেতরে একটি গুলির শব্দ। সবার সন্দেহ, বাংলা ভাই ভেতরেই আছেন। গুলজার আবার চিৎকার দিলেন, ‘বাংলা, তুই আমার ফোর্সের গায়ে হাত তুলেছিস। তোকে আমি খুন করে ফেলব।’
হঠাৎ ঘরের ভেতরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। পুরো বাড়ি আগুনে জ্বলে উঠল। ঘরের ভেতর থেকে এক লোক বের হয়ে আসতেই কনস্টেবল সাত্তার চিৎকার করে উঠলেন—স্যার, বাংলা ভাই।
ঘরের এক দিকে কর্নেল গুলজার, আরেক দিকে কমান্ডার মাশুক। মাঝখানে মেজর কোরবান আর ক্যাপ্টেন তানভির। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর থেকে একটি ক্ষতবিক্ষত দেহ ছিটকে বাইরে এল। সে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাংলা ভাই তখনো ঘরের ভেতরে। তাঁর সাড়া নেই। হঠাৎ গায়ে কম্বল জড়িয়ে দরজার সামনে এলেন বিশালদেহী দাড়িওয়ালা লোক। তাঁকে দেখে কারও চিনতে বাকি থাকে না—বাংলা ভাই।
এতক্ষণে কেউ খেয়াল করেনি, সার্জেন্ট রফিক যে পিস্তলটি ফেলে এসেছেন, সেটা পড়ে আছে বাংলা ভাইয়ের পায়ের কাছে। গুলিভর্তি নাইন এমএম পিস্তল। বাংলা ভাইয়ের হাত খালি। তাঁর নিজের অস্ত্রটিও হাতে নেই।
র্যাবের হুংকারে কাজ হলো। বাংলা ভাই বলেন, ‘আল্লার দোহাই, আমাকে কিছু করবেন না।’
আবার হুংকার—`কথা কম, বেরিয়ে আয়।’
সারা মুখে ছাই মাখা অবস্থায় গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন বাংলা ভাই, দুই হাত মাথার ওপরে তুলে। র্যাব কর্মকর্তারা কম্বল খুলে হাঁটু গেড়ে বসতে বলেন, কিন্তু বাংলা ভাই অনড়, এভাবে বসবেনই না। এমন সময় র্যাব কর্মকর্তার মুখে `ফায়ার’ শুনে সুবোধ বালকের মতো হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসেন সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচজন র্যাব সদস্য তাঁকে কবজা করে ফেলেন।
এ সময় ঘটে এক মজার ঘটনা। বাংলা ভাইকে হ্যান্ডকাফ পরানো দরকার। কিন্তু হ্যান্ডকাফ পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁর কাছে হ্যান্ডকাফ ছিল, তিনি গেছেন দৌড়ে পালানো লোকটার পিছে। পরে পাশের ঘর থেকে একটা ছেঁড়া শাড়ি জোগাড় করে এনে বাংলা ভাইয়ের হাত বাঁধা হয়। ঠিক তখনই পুরো ঘরটা দপ করে জ্বলে ওঠে।
বিস্ফোরণে আহত বাংলা ভাই কাতরাচ্ছেন আর শায়খ রহমানের নাম ধরে গালিগালাজ করছেন। র্যাবের একজন তাঁর কাছে যেতেই বাংলা ভাই বলেন, ‘ভাই, আমার স্ত্রীর পর্দা যেন ঠিক থাকে।’
র্যাবের দুজন সদস্য বাংলা ভাইকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন রিকশাভ্যানের ওপরে, কিন্তু এত ওজনের বাংলা ভাইকে দুজনে মিলে টেনে তোলা যায়? তাঁকে টেনে তুলতে ছয়-ছয়জন র্যাব সদস্যও হিমশিম খাচ্ছিলেন।
২০০৭ সালের ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে অন্য পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে বাংলা ভাইয়ের ফাঁসি কার্যকর হয়; ময়মনসিংহের কারাগারেই। সূত্র : আজকের পত্রিকা