রবিবর, ১০ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৫:২৬ am
কোরবানী ওয়াজিব। আর করোনার হাত থেকে জীবন বাঁচানো ফরজ। কোনটাকে গুরুত্ব দেবে বাংলাদেশ? বুঝে ওঠার আগেই লকডাউন প্রত্যাহার আবার প্রজ্ঞাপন ২৩ জুলাই থেকে লকডাউনের। আর এতে মনে হচ্ছে- বরাবরের মত গরিবদের হবে মরণদশা; যাদের নূন আনতে পানতা ফুরোয় স্বাভাবিক সময়েই। আর লকডাউনে হবে ভয়াবহ মন্দ পরিস্থিতি। তার উপর বেসরকারী কিন্ডারগার্টেন স্কুলের লক্ষ লক্ষ শিক্ষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সিএনজি চালকসহ বিচিত্র পেশার প্রায় ৫ কোটি মানুষের সাথে সাথে বেকায়দায় পরবে বেকারত্বের অভিশাপে পরা আরো ২ কোটি মানুষ; সেই সাথে থাকবে নিন্মবিত্ত-মধ্য নিন্মবিত্ত আরেকটি শ্রেণির কমপক্ষে ৪ কোটি মানুষ।
সবমিলিয়ে ১০ কোটি মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে খামখেয়ালির লকডাউনে নির্মম মৃত্যুর মুখোমুখি হবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ ৯ টি মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা-অপরিকল্পনার কারনে। এমতবস্থায় তাদের উচিৎ উন্নত বিশে^র মত কমপক্ষে ৫ কোটি মানুষকে ১৪ দিনের খাবার নিশ্চিত করা, বাড়ি ভাড়া নিশ্চিত করা। তারপর লকডাউন ঘোষণা করা। তা না করে বলছে- ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত যে কঠোর লকডাউন শুরু হবে, তা চলাকালিন সময়ে- সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। -সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহণ (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) সব প্রকার যানবাহন বন্ধ থাকবে। শপিংমল/মার্কেটসহ সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে। -সব পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে। -সব প্রকার শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে।
জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক [বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান (ওয়ালিমা), পিকনিক, জন্মদিন, পার্টি ইত্যাদি], রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। -সরকারি কর্মচারীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন এবং দাপ্তরিক কাজসমূহ ভার্চুয়ালি সম্পন্ন করবেন। -আইনশৃঙ্খলা ও জরুরি পরিষেবা, যেমন কৃষিপণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যাবলী, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তাব্যবস্থা, ডাকসেবা, ব্যাংক, ফার্মেসি ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি/অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদান সাপেক্ষে যাতায়াত করতে পারবে। -জরুরি পণ্য পরিবহণে নিয়োজিত ট্রাক/লরি/কাভার্ডভ্যান/নৌযান/পণ্যবাহী রেল/ফেরি এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। বন্দরসমূহ (বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল) এবং তৎসংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। -কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাদি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিক্রয় করা যাবে। -খাবারের দোকান, হোটেল সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রয় (অনলাইন/টেক ওয়ে) করতে পারবে। -আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট প্রদর্শন করে গাড়ি ব্যবহারপূর্বক যাতায়াত করতে পারবে।
কোভিড-১৯. করোনাকাল, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, শাটডাউন-লকডাউন-মৃত্যুমিছিলসহ সবকিছুকে পেছনে ফেলে এখন চলছে কোরবানীর পশুর হাটের নামে মানুষকে করোনাযুদ্ধে পরাস্ত করার-অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্রের হাত ধরে রাজনীতিকরা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি, চিকিৎসকরা চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা, জনপ্রতিনিধিরা সেবার নামে লুটতরাজের রামরাজত্ব বানানোর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রের কারণেই হুট করে টানা ১৪ দিন নিন্মবিত্তদের খাদ্য নিশ্চয়তা না দিয়ে লকডাউনের নামে ভোগান্তি দিয়ে আবার রাজনৈতিক কর্মীদেরকে কোরবানীর পশুর হাটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামানোর সুযোগ করে দিয়ে লকডাউন প্রত্যাহার করেছে। একই সাথে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত আবার কঠোর লকডাউন শুরু করবে বড়লোকের গরু খাওয়ার আয়োজনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তারা কি করবে? যারা গরিব মা-বাবা-স্বজনদের সাথে ঈদ করার জন্য গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো; তারা পরবে চরম ভোগান্তিতে। তাদের জন্য সুপরিকল্পিত কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। অপরিকল্পিত পদক্ষেপের সূত্রতায় আমজনতা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও অথর্ব পরামর্শশ্রেণি ঠিকই ভালো আছে, ভালো আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রী-সচিব-আমলারা। ভালো আছেন-থাকবেন ২৩ আগস্টের পরের লকডাউনে দ্বৈত সিদ্ধান্তের ঢেউয়ে আছড়ে পড়া রাজনৈতিক-ক্ষমতাসীনরাও।
এমন করে একবার কঠোর, একবার প্রত্যাহার করে কোন সমাধান সম্ভব নয়; এতে করে রাজনৈতিক ক্ষমতা আকড়ে রাখা যাবে ঠিকই, কিন্তু করোনা সংক্রমণরোধ বা করোনায় মৃত্যু সংখ্যা কমানো সম্ভব নয়। কেননা, এই যে পশুর হাট, দূর দূরান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকায় আসছে, এক জেলা থেকে আরেক জেলা যাচ্ছে, কে যে করোনা পজিটিভ তা কিন্তু কেউ জানে না। আর এভাবে সংক্রমণ হতেই হতেই দেশে করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। প্রতিদিনই হচ্ছে নতুন রেকর্ড। এক দিনে মারা গেছে ২২০ জন। একই সময়ে এবার সংক্রমণে রেকর্ড হয়েছে। এদিন দেশে সর্বাধিক ১৩ হাজার ৭৬৮ জনের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়। পেছনের গণমাধ্যমের আলোকে বলা যায়, ২০২০ সালের ৮ মার্চ করোনা শনাক্তের পর একদিনে এটাই সর্বোচ্চ সংক্রমণ। এমন দিনেই করোনা নিয়ন্ত্রণে চলমান কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঈদ উপলক্ষে ১৫ জুলাই থেকে কার্যকর হবে শিথিল বিধিনিষেধ। আর এখন পবিত্র ঈদুল আজহা কেন্দ্র ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহণ, রেল চলাচলের পাশাপাশি খুলে দেওয়া হবে শপিংমল ও দোকানপাট। রাজধানীসহ সরা দেশে বসবে পশুর হাটও। কিন্তু তবু বলতে চাই-সাহসে চলতে চাই বলে যে, জাতির মঙ্গলের জন্য পশুর হাট বন্ধ রাখুন। তা না হলে এই পশুর হাটের মাধ্যমেই প্রতিদিনের মৃত্যু দাঁড়াবে ৫০০ রও বেশি। গণমাধ্যম বলছে- ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৪ হাজার ৬৭টি। শনাক্তও হয়েছে সবচেয়ে বেশি। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৩১.২৪ শতাংশ। আগের দিন শনাক্ত হয়েছিল ১১ হাজার ৮৭৪ জন। এদিন চিহ্নিতের হার ছিল ২৯ দশমকি ৬৭ শতাংশ। এ নিয়ে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হয়েছে ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৭। ২৪ ঘণ্টায় ২২০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ভাইরাসটি। যা আগের দিনের চেয়ে ১০ জন কম। এর আগে গত রোববার সর্বোচ্চ ২৩০ জন মারা যান। এ নিয়ে ২৭ জুন থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রতিদিনই শতাধিক লোকের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে করোনা। সব মিলিয়ে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেল ১৬ হাজার ৬৩৯ জনের।
সরকারি হিসাবে ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৭০২০ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হলেন আট লাখ ৮১ হাজার ৫২১ জন। সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব বিভাগেই করোনা বিস্তারে ঊর্ধ্বগতি। ২৪ ঘণ্টায় মোট আক্রান্তের প্রায় অর্ধেকেই ঢাকা বিভাগের। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে পাঁচ হাজার দুজন। শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৪২ শতাংশ। গাজীপুরে শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ। চট্ট¯্রাম বিভাগেও এক দিনে শনাক্ত দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব হাসপাতালেই রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। ঢাকার অনেক হাসপাতালে খালি নেই আইসিইউ। শয্যা না পেয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। রাজধানীর হাসপাতালের রোগীদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের। সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬২৭টি ল্যাবে নমুনা সং¯্রহ ও পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১৩০টি, জিন এক্সপার্ট ৫০টি, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ৪৪৭টি। এসব ল্যাবে ৪৬ হাজার ৪৫টি নমুনা সং¯্রহ করা হয়। দেশে এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৭০ লাখ ১৫ হাজার ২৩৪টি। পরীক্ষা বিবেচনায় এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৫ দশমিক ১৭ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬১ শতাংশ। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১৪২ ও নারী ৭৮ জন। এদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১৬৭ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ৪০ জন ও বাড়িতে ১৩ জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৬৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৭, রাজশাহী বিভাগে ২৩, খুলনা বিভাগে ৫৫, বরিশাল বিভাগে চার, সিলেট বিভাগে ছয়, রংপুর বিভাগে ১৮ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১৩ জন আছেন। তবে ভাবনার বিষয় হলো- ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ১২১ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৪৬ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ২৬ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ১৭ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে নয়জন এবং ২০ বছরের নিচে একজন রয়েছেন।
এত কিছু দেখে শুনে আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বলতে চাই- বর্তমান পরিস্থিতিতে কঠোর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার মতো নয়, এটা সত্য। কিন্তু কোরবানির ঈদে মানুষকে চাইলেই আটকে রাখা যেতো। কিন্তু সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের স্বার্থরক্ষায় তাদেরই লিজ নেয়া পশুর হাট খোলা রাখার লক্ষ্যে লকডাউন প্রত্যাহার কিছু লোকের সাময়িক লাভের জোয়ার-টাকার ফোয়ার আনলেও ক্ষতিগ্রস্থ হবে-ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের অগণিত মানুষ। যা অন্তত একটি সভ্য দেশের দাবিকারী বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার চালকদের কাছে প্রত্যাশা করি না…। লেখক : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি