বৃহস্পতিবর, ৩১ অক্টোব ২০২৪, সময় : ০১:১৯ am
নিজস্ব প্রতিবেদক : বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম প্রায় আকাশচুম্বী। পরিধেয় বস্ত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু চড়ামূল্যের এই বাজারে এখনো তিন টাকায় মেলে সালোয়ার কামিজ আর ৩০ টাকায় পাওয়া যায় শাড়ি। কোনো গোপনীয় এলাকায় নয়, আশ্চর্য শোনালেও রাজধানীর পুরান ঢাকার বেগমগঞ্জ এলাকার বেচারাম দেউড়িতে এমন সস্তায় পাওয়া যায় কাপড়।
শুধু মেয়েদের পোশাকই নয়, বেচারাম দেউড়িতে মেলে ছেলেদের শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি ও শীতের পোশাক। অভাব নেই বাচ্চাদের জামা-কাপড়েরও। তাই এই মার্কেট খ্যাতি পেয়েছে ‘পুরনো পোশাকের রাজধানী’ হিসেবে। সচ্ছল জনগোষ্ঠীদের ফেলে দেয়া জামা-কাপড়, হাড়িপাতিলের বিনিময়ে ফেরিওয়ালাদের সংগৃহীত বস্ত্রগুলোকেই একত্রিত করে কম দামে খুচরা ও পাইকারি দরে বিক্রি করেন বেচারাম দেউড়ির এই ব্যবসায়ীরা।
এই ব্যবসার জন্য নামকরা সেন্টু-পিন্টু মার্কেট, জাহাঙ্গীর মার্কেট, হাফিজ মার্কেট ছাড়াও বেচারাম দেউড়ির রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছে পুরনো কাপড় বিক্রির কয়েকশ’ দোকান। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েক দশকে পুরনো কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) বেচারাম দেউড়ি ঘুরে দেখা গেছে বেচা-কেনার ব্যস্ততা। যেন দম ফেলার ফুরসৎ নেই ব্যবসায়ীদের। ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কিনে আনা পোশাক বেছে বেছে আলাদা করছেন তারা। আর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা করছেন দর কষাকষি। দোকানগুলোর কর্মচারীরা ব্যস্ত থাকেন ছোট ছোট স্তূপ থেকে লুঙ্গি, প্যান্ট, শার্ট, শাড়ি, গেঞ্জি, কাঁথা, কম্বল ও লেপের কভার আলাদা করতে।
দরদাম
জাহাঙ্গীর মার্কেটের একটি দোকানের কর্মচারীরা জানান, ব্যবহারযোগ্যতা, ছেঁড়া-ফাটার পরিমাপ ও ধরন দেখে কাপড় আলাদা করেন তারা। ব্যবহার অযোগ্য ছেঁড়া-ফাটা বস্ত্রগুলোর দাম সবেচেয় কম। ব্যবসায়ীরা বলেন, ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে খুবই স্বল্পমূল্যে পিস হিসেবে জামা-কাপড় কেনা হয়। এক্ষেত্রে তেমন কোনো মানদণ্ড নেই, আন্দাজের ওপরেই ওঠানামা করে কাপড়ের দাম।
এখানে অবস্থাভেদে প্রতিটি সালোয়ার কামিজ বিক্রি হয় ৩ থেকে ৫০ টাকায়, লুঙ্গি ৫ থেকে ১০ টাকা, শার্ট ৫ থেকে ২০০ টাকা, শাড়ি ৩০ থেকে ২৫০ টাকা, জিন্স ২০ থেকে ২০০ টাকা, শীতের পোশাক ৫০ থেকে ৫০০ টাকা আর লেপের কভারের দাম হয়ে থাকে ২০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে।
মানিক নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা ফেরিওয়ালা, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছ থেকে এই জামা-কাপড়গুলো কিনি। মিস্ত্রি, শ্রমিকসহ নিম্ন আয়ের মানুষ আর কাপড় ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছ থেকে কাপড় নেয়। এখানে ২-৩ টাকায় শার্ট, প্যান্ট পাওয়া যায়। আবার ২০০-৩০০ টাকায়ও পাওয়া যায়। কোয়ালিটির ওপর দাম ওঠানামা করে।’
তিনি বলেন, ‘গেঞ্জি, শার্ট, প্যান্ট, লুঙ্গি ছাড়াও শীতের কাপড়, বাচ্চাদের কাপড় এখানে পাওয়া যায়। যত ছেঁড়া-ফাটা হয়, কাপড়ের দামও তত কম হয়।’
এসব কাপড়ের ক্রেতা কারা
পুরনো কাপড় কিনে পরিষ্কার ও ইস্ত্রির পর বিক্রি করেন অনেক ব্যবসায়ী। মূলত তারাই পুরনো কাপড়ের প্রধান ক্রেতা। আর তাদের কাছ থেকে এখানে পোশাক কিনতে আসেন নিম্নআয়ের মানুষ। কথা বলে জানা গেছে, রড কারখানার শ্রমিকদের জন্য মোজা তৈরিতে প্রয়োজন পুরনো জিন্সের প্যান্ট। ফার্নিচার, গাড়ি, প্রিন্টিং প্রেসে মোছামুছির জন্য পুরনো কাপড়ও কেনা-বেচা হয় বেচারাম দেউড়িতে।
যাত্রাবাড়ী থেকে এখানে আসা ক্রেতা নাসিমুল বলেন, ‘আমি প্রতি সপ্তাহে এখান থেকে কাপড় কিনে ফুটপাতের হকারদের কাছে বিক্রি করি। মানভেদে পিস হিসেবে কিনে নেই।’ ব্যবসায়ী মনিম জানান, ‘ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে আমরা পিস হিসেবে এই জামা-কাপড়গুলো কিনি। তারপর পাইকারি বিক্রি করি। বিভিন্ন ব্যবসায়ী আমাদের কাছ থেকে এইগুলা নেন। ঢাকার বাইরেও এই পোশাকগুলো যায়। ব্যবসায়ীরা একবারে অনেক জামা কাপড় কিনে নেন।’
ব্যবসার হালচাল
মেসার্স খালেক এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ী মো. মানিক জানান, এই ব্যবসার পুরোটাই চালাননির্ভর। যত বেশি বিনিয়োগ, তত বেশি লাভ। দোকান ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিলে মাসে হাজার বিশেকের মতো মুনাফা থাকে। দুই মাস আগে এখানে একটি দোকান ভাড়া নেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু হাফিজ।
তিনি বলেন, ‘এখানে আমার চাচার দোকান। তার দোকানেই ব্যবসা শিখেছি। সবকিছু এখন বন্ধ, ফ্রি সময়টাকে কাজে লাগাতে এই দোকান শুরু করলাম। প্রতিদিন একেকটি দোকানে দৈনিক ৮-১০ হাজার টাকার কাপড় বিক্রি হয়। ভেতরের দিকের দোকানে বিক্রি কম। করোনা পরিস্থিতির আগে একেকটি দোকানে ১৫-২০ হাজার টাকার কাপড় বিক্রি হতো। এখন বিক্রিতে ভাটা পড়েছে।
করোনার ধাক্কা
তরুণ বিক্রেতা হাফিজ বলেন, ‘করোনার সময় অনেক খারাপ টাইম কাটাইছি।’ মানিক বলেন, ‘১২-১৩ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করি। কিন্তু করোনার সময়টা সবচেয়ে খারাপ গেছে। দোকান বন্ধ ছিল, চাঁদপুরে বাড়িতে চলে গেছি। খাবার ছিল না, ওষুধ কেনার টাকা ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখনো দুই মাসের ভাড়া বকেয়া। বিক্রিও আগের মতোন নাই। খুব খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’
আরেক ব্যবসায়ী সোহাগ বলেন, ‘করোনার কারণে প্রায় সব ব্যবসায়ীরই দোকান ভাড়া বাকি আছে। সবাই চেষ্টা করছে ঘুরে দাঁড়াতে। ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়ছে। করোনায় কেউ কোনো সাহায্য করে নাই। নিজেরটা নিজেদেরই করতে হচ্ছে।’