শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০২:২৯ am
ডেস্ক রির্পোট : করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে চলছে কঠোর বিধি নিষেধ। এতে ঘরবন্দী মানুষ। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যেতে মানা। এই অবস্থায় আগামী কয়েকদিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পবিত্র ঈদ-উল-আজহা। ফলে রাজধানীবাসী কোরবানির হাটে গিয়ে দেখে শুনে পশু কিনতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। করোনা মহামারীতে এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে ‘ডিজিটাল পশুর হাট’। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর ইতোমধ্যে জমে উঠেছে ডিজিটাল হাট।
এছাড়া ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (মার্কেট প্লেস), ই-কমার্স সাইট, ওয়েবসাইট, ফেসবুকভিত্তিক সাইটগুলোতেও ইতোমধ্যে কোরবানির পশুর বুকিং ও বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। দেশের ক্রেতাদের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও ক্রেতারা কোরবানির পশুর বুকিং দিতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। গত ছয়দিনে অনলাইনে প্রায় ২০৬ কোটি টাকায় ২৬ হাজার ৩০৮টি গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে। বৃহস্পতিবার ৭৪১টি অনলাইন বাজারের তথ্যের ভিত্তিতে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এ তথ্য জানায়।
প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের এক বা দু’দিন আগে ক্রেতাদের বাসায় বাসায় গিয়ে কোরবানির পশু পৌঁছে দেবে। শুধু কোরবানির পশু বিক্রিই নয়, বুকিং করে দিলে জবাই দিয়ে বাসায় মাংস পৌঁছে দেয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, অনলাইনে গরু কেনাবেচায় গ্রাহক যখন গরু পাবেন, তখনই টাকা ছাড় করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, গত বছরের মতো এ বছরও গবাদিপশুর পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। গত বছর হৃষ্টপুষ্টকরণের আওতায় কোরবানির জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ সারাদেশে গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি। এ বছর এ কার্যক্রমের আওতায় মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং অন্য চার হাজার ৭৬৫টি পশুসহ মোট এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে।
চলতি বছর হৃষ্টপুষ্টকৃত গরু-মহিষের সংখ্যা ৩৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০টি, হৃষ্টপুষ্টকৃত ছাগল-ভেড়া ২৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৮ এবং গৃহপালিত গরু-মহিষের সংখ্যা ৬৮ লাখ ৮৮ হাজার ২০০ ও গৃহপালিত ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪৯ লাখ ৯২ হাজার ২৫২টি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারাদেশে ১ লাখ ৪৮ হাজারের বেশি পশু বিক্রির জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আপলোড করা হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ১৯ হাজার গবাদিপশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর অনলাইনে পশু বিক্রির সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর সারাদেশে অনলাইন-অফলাইনে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার গবাদিপশু কোরবানি উপলক্ষে বিক্রি হয়।
সম্প্রতি জুম প্ল্যাটফর্মে ‘ডিএনসিসি ডিজিটাল গরু হাট ২০২১’-এর উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার মানুষ এই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে গরু কিনতে পারবেন। এছাড়া রয়েছে পশু বিক্রি সংক্রান্ত বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যারা সারাদেশে সার্ভিস দিচ্ছেন। অনলাইনে কেনা কোরবানির পশুতে কোন ত্রæটি পেলে ফোনে বা ই- মেলে ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন (ই-ক্যাব) কাছে অভিযোগ করা যাবে। অভিযোগ গ্রহণের তিন কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগের সুরাহা করবে ই-ক্যাব। অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রেখে ২০২১ সালের ঈদ-উল-আজহায় অনলাইনে পশু বিক্রির ব্যবস্থা রেখে অনলাইনে পশু বিক্রয়ের নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে।
অনলাইন পশুর হাটের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আতিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, গতবার অনলাইনে তিন সপ্তাহে বিক্রি করেছিলাম ২৭ হাজার গরু। এবার টার্গেট কমপক্ষে ১ লাখ গরু যেন অনলাইনে বিক্রি করতে পারি। এক লাখ লোকের কাছে যদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গরু বিক্রি করতে পারি তাহলে কমপক্ষে ৫ লাখ লোক কিন্তু গরুর হাটে যাবে না। তাহলে আমরা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারব। আতিকুল ইসলাম জানান, তবে ডিএনসিসি ডিজিটাল হাট নিয়ে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ এসেছে আমাদের সামনে।
যেমন গতবার চ্যালেঞ্জ এসেছে টাকা দেয়ার পর গরু যদি খারাপ হয় তাহলে কাকে ধরব? এটি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা আমাদের এস্ক্রো পদ্ধতি দিয়েছে। এস্ক্রো পদ্ধতি হলো আপনি গরু কিনবেন আপনার টাকা কিন্তু বিক্রেতা সরাসরি পাবে না। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা এ্যাকাউন্টে যাবে। আপনি যখন নিশ্চিত করবেন আপনি গরুটা পেয়েছেন এবং গরু ঠিক আছে তারপরই টাকা ছাড় করবে। এই এস্ক্রো পদ্ধতিতে নতুন প্ল্যাটফর্মে কাজে লাগবে। কাজেই গরু কেনার পর ঠিক থাকবে না এটা আর হবে না এখন থেকে।
জানতে চাইলে ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ডিজিটাল গরুর হাট সবার জন্যই উন্মুক্ত একটা প্ল্যাটফর্ম। ডেইরি ফারমার্স এ্যাসোসিয়েশনের অধীনে দেশব্যাপী অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন, প্রান্তিক খামারি রয়েছেন তাদের আমরা যুক্ত করছি। ই-কমার্স সাইটগুলোও অনেক খামারির সঙ্গে যুক্ত আছে, তাদের আমরা যুক্ত করার চেষ্টা করছি এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। তমাল বলেন, ‘গত বছর দেখেছি অনেক গরু বিক্রি হয়েছে কিন্তু সেটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করেই কাস্টমারের কাছে চলে এসেছে।
খুরা রোগসহ অন্য সমস্যা নিয়ে অসুস্থ গরু চলে এসেছে এমন অনেক সমস্যা হয়।’ তিনি বলেন, একটা গরু এত দাম দিয়ে কেনার পর সেটার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট না থাকলে একজন কাস্টমার সেই মুহূর্তে কী করবেন, তিনি তো অনলাইনে আগেই টাকা পরিশোধ করেছেন। এমন অনেক সমস্যা হচ্ছে বা হতে পারে বলেই এ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সময় মতো পশু ডেলিভারির বিষয়ে আমাদের কঠোর দিকনির্দেশনা রয়েছে, আমরা সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করব।
তমাল বলেন, ডিজিটাল হাটে গেলে সেখানে ‘স অফারিং’ তথা মাংস কাটাকাটি নামে একটি সার্ভিস পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়ে বুকিং দিতে হবে। কেউ যদি গরু কিনতে চান তবে তাকে বলতে হবে, ‘আমি এই গরুটা হোম ডেলিভারি হিসেবে পেতে চাই’। তখন গরু কেটে হোম ডেলিভারি দিয়ে দেয়া হবে।’ ওয়াহেদ তমাল জানান, গরু যে ডিজিটাল হাট থেকে কিনতেই হবে তা নয়। যে কোনভাবে কিনলেই হবে। যদি কেউ তার বাসার জন্য গরু কেনে আর সে যদি তার বাসাতে গরু কোরবানি দেয়াকে কঠিন মনে করে তবে তিনি সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারেন। ‘সেখান থেকে গরু কোরবানি দিয়ে মাংস বাসায় পৌঁছে দেয়া হবে।
এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট টোকেন দেয়া হবে। এটি ঈদের দিন অথবা পরের দিন যেদিন আপনি চাইবেন সেইভাবেই দেয়া হবে।’ ওয়াহেদ তমাল জানান, বাসায় কোরবানির পশুর মাংস পেতে কসাইয়ের জন্য একটা সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। আর এটি তত্ত¡াবধায়ন করবে ডেইরি ফারমার্স এ্যাসোসিয়েশন ও সিটি কর্পোরেশন। আর ই ক্যাব অনলাইনে গরু কেনাটা নিশ্চিত করবে। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এবার ১ হাজার গরু নির্ধারিত ¯øটার হাউসে কোরবানি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। আগামীকালের মধ্যে কোরবানির গরু কিনে বুকিং দেবেন তাদের কোরবানির মাংস আমরা বাসায় পৌঁছে দেব। এজন্য ২৭০টি ¯øটার হাউস করেছে সিটি কর্পোরেশন।’
ডিজিটাল হাটে পশু বিক্রি নিয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ‘প্রথম দিনেই আমরা অনেক সাড়া পেয়েছি। আরও বেশি মানুষকে এই হাট সম্পর্কে জানানোর জন্য ই-ক্যাব থেকে টিভিসি ও বিলবোর্ড টাঙ্গানো হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীতে যতগুলো অস্থায়ী পশুর হাট বসবে, সেগুলোর প্রতিটির গেটের ব্যানারে এই হাটের বিজ্ঞাপন দেয়া হবে। আমরা আশা করছি, গেল বারের চেয়ে এবার ডিজিটাল হাটে ক্রেতার সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে।’
ঢাকা জেলা প্রাণিসম্পদ দফতরের কর্মকর্তা ডাঃ কাজী রফিকুজ্জামান বলেন, ‘ডিজিটাল হাট চালুর আগেই অনেক খামারি এবার তাদের পশু অনলাইনে বিক্রি করতে শুরু করেছেন। আমাদের কাছে সেই সংখ্যাটা আট শ’র বেশি। তবে এর বাইরেও অনেক খামারি আছেন, যারা তাদের পশু অনলাইনে বিক্রি করছেন।’ ডিজিটাল হাট উদ্বোধনের পর থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রায় ৩৩৮টি পশু বিক্রি হয়েছে। এই হাটে এ পর্যন্ত আড়াই লাখেরও বেশি ভিজিটর দেখা গেছে। ভালোকিনি ডটকমের সিইও কেরামত উল্লাহ বিপ্লব বলেন, ‘আমরা বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের সঙ্গে যৌথভাবে কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ৪০টি চরগ্রামের ৪০০ গরু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছি। যাতে কৃষকরা তাদের গরু সরাসরি রাজধানীর বিক্রেতাদের কাছে ন্যায্যদামে বেচতে পারবেন।’
প্রতারণা এড়াতে ডিজিটাল হাটে থাকবে কঠোর নজরদারি ॥ সম্প্রতি ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রস্তুতিমূলক একটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে সিটি কর্পোরেশন- পৌরসভাগুলোর ডেইরি এ্যাসোসিয়েশনের স্থানীয় প্রতিনিধি, ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন গ্রæপের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে অনলাইনে গবাদি পশু বেচাকেনার উদ্যোগ গ্রহণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত হয়। বিভাগীয় কমিশনাররা অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে নির্দেশনা দেয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়।
এছাড়া সিদ্ধান্ত হয়, সংশ্লিষ্ট ভেটেরিনারি সার্জনরা অনলাইনে আপলোড করার আগে গবাদিপশুর স্বাস্থ্যসনদ প্রদান করবে, যা অনলাইনে আপলোড করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির জন্য খামারিদের সংশ্লিষ্ট অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযোগের সহযোগিতা প্রদান করবে এবং আপলোডকৃত গবাদিপশুর ক্ষেত্রে মালিকের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, গবাদিপশুর বয়স, ওজন, মূল্য ও গবাদিপশুর ছবি প্রদান করতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে ডিজিটাল পদ্ধতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। গত বছর এ পদ্ধতিতে ভাল সাড়া মিলেছে। এ বছরও গত বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি পশু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। বিগত বছর পশু বিক্রি নিয়ে কিছু প্রতারণার অভিযোগও ছিল। অভিযোগের সংখ্যা সামান্য হলেও এ বছর যাতে এ ধরনের কোন ঘটনা না ঘটে সেজন্য পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্টের সঙ্গে পশুর ছবি আপলোড করার জন্য বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে ডিজিটাল হাটে ব্যাপক নজরদারি থাকবে, কেউ কোন প্রতারণার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র : জনকণ্ঠ