শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:১৩ pm
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঘা (রাজশাহী) : বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিল জায়দা বেগম। তার বয়স যখন ছয় বছর, বাবা মীর মসলেম উদ্দিন হঠাৎ মারা যান। তার এক ভাই ও দুই বোন রয়েছে। জায়দা ছিল সবার বড়। বাবার মৃত্যুর কিছু দিন পর ভাইটাও মারা যায়।
পরে জায়দা মামা নুর মোহাম্মদের কাছে আশ্রয় নেয়। মামাও কিছু দিন পর মারা যায়। বাবার রেখে যাওয়া আট বিঘা জমি ছিল। এই জমি রাক্ষুসে পদ্মা গ্রাস করে নেয়।
অবশেষে কোনো উপায় না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দু-মুঠো ভাতের জন্য কিস্তিতে কেনা ভ্যান নিয়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে বেড়াতে শুরু করেন জায়দা। এই গ্রামে ৫ কাঠা জমি কিনে শুরু করেন নতুন জীবন। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদে কোনো পেশাকে ছোট করে দেখেননি জায়দা বেগম। এভাবেই পার করেন জীবনের ৫০ বছর। জায়দা বেগম আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
বৃহস্পতিবার জায়দা বেগম জানান, স্থানীয় এক এনজিও থেকে কিস্তিতে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত অটোভ্যান কিনেছে। নিজ এলাকায় কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাস্তায় ভ্যান নিয়ে নামেন। তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজ এলাকা জোতকাদিরপুর-নারায়ণপুর-বাঘা-আড়ানী সড়কে ভ্যান চালান। যাত্রী পরিবহন করে লকডাউনের আগে প্রতিদিন আয় হতো প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।
জানা যায়, বাবার মৃত্যুর পর তাদের থাকার জায়গাটুকু পদ্মাগর্ভে চলে যায়। ফলে নিরুপায় হয়ে পড়েন জায়দা। এর মধ্যে খুব কষ্টে দুই বোনকে অন্যত্র বিয়ে দেন। এদিকে জায়দা বেগমের চেহারা কালো বলে কেউ বিয়ে করতে চায়নি।
৩০ বছর বয়সে শাহা জামাল নামে একটি ছেলেকে বিয়ে করেন। তাদের বছরখানেক সংসারের মাঝে পেটে সন্তান আসে। কিন্তু সন্তান জন্মের আগে স্বামী চলে যান। অভাবী সংসারে ভারতের সীমান্তবর্তী পদ্মার দুর্গম বাংলাবাজারচর ছেড়ে ছেলে জায়দুল হককে পেটে নিয়ে প্রায় ৩০ বছর আগে চলে আসেন উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের জোতকাদিরপুর গ্রামে।
এখানে এসেও জন্ম নেওয়া ছেলেসন্তান, বৃদ্ধ মা, নানিকে নিয়ে কি করে সংসার চলবে চিন্তায় পড়েন। অবশেষে কোনো উপায় না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দু-মুঠো ভাতের জন্য কিস্তিতে কেনা ভ্যান নিয়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে বেড়াতে শুরু করেন। এই গ্রামে ৫ কাঠা জমি কিনে শুরু করেন নতুন জীবন। এভাবেই পার করেন জীবনের ৫০টি বছর।
তার নানি দুই বছর ও মা এক বছর আগে মারা গেছেন। ছেলেকে এক বছর আগে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে ছেলেসহ তিনজনের সংসার। মাসে তার ছয় হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। করোনাভাইরাসে লকডাউনের কারণে এনজিও কিস্তি নিয়ে পড়েছেন বেকায়দায়। লকডাউনের আগে সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা দিতে কোনো অসুবিধা হতো না।
জায়দা বেগম বলেন, আমার বাবার বড় মেয়ে ছিলাম আমি। আমি কালো বলে বাবার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শিখিয়ে সরকারি চাকরি করাবেন। কিন্তু কপালে ছিল না, তাই হয়নি। আমি এখন রাস্তায় অটো চালাই। তবে দেশে নারীদের জন্য পরিবহণের বিশেষ কোনো সুবিধা নেই। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলে নারী চালক বৃদ্ধি পাবে।
এ বিষয়ে বাঘা বাজারের দরগা মেডিকেল হলের গ্রামীণ চিকিৎসক আবদুল লতিফ মিঞা বলেন, বর্তমানে রাস্তায় যে হারে দুর্ঘটনা হয়। নারীরা সহজে ধৈর্যহারা হয় না। ওভারটেক করার প্রবণতা থাকবে না। সে ক্ষেত্রে নারীরা ভ্যানচালকের আসনে এলে দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যাবে। গাড়িচালক হিসেবে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি নিরাপদ।
সাবেক স্থানীয় বেসরকারি স্ব-উন্নয়ন প্রকল্প কর্মকর্তা আবু বাক্কার সিদ্দিকী বলেন, খামখেয়ালি স্বভাব আর অকারণে ধৈর্যহারা কম হয় মেয়েরা। যে কোনো সাহসী পেশাতে মেয়েদের এগিয়ে আসতে পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। আজকের তানোর