শনিবর, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:৫৩ pm
আজ ১১ জুন, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দিনটি স্মরণীয়। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা, দেশরত্ন ও জননেত্রী শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবস। এদিন দেশের কথিত শাসকদের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা। তার হাত ধরেই বাঙালি জাঁতি পেয়েছে গণতন্ত্র। আর তিনিই হলেন আমাদের গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা, মাদার অব হিউম্যানিটি শেখ হাসিনা।
২০০৮ সালের এই দিনে প্রায় ১১ মাস কারাভোগের পর দেশের আপামর জনতার অব্যাহত দাবির মুখে কারামুক্ত হন দেশের সফলতম প্রধানমন্ত্রী ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ১১ জুন সংসদ ভবন চত্বরে স্থাপিত বিশেষ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি।
২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর পতন হয়-বিএনপি জামায়াত সরকারের। গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই সরকারের ভেতরে নানা টানাপোড়েনে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা নেয় বিশেষ এক সরকার- যা ‘ওয়ান ইলেভেনের সরকার’ নামে অধিক পরিচিত। এই সরকার রাজনীতিসহ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে একের পর এক বিধি জারি করে।
এমন পরিস্থিতিতেই ১৫ মার্চ ২০০৭ সালে অসুস্থ পুত্রবধূকে দেখতে ও নিজের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কিন্তু এরপর শেখ হাসিনা যাতে দেশে ফিরতে না পারেন সেজন্য সেসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। দেয়া হয় চাঁদাবাজির মামলা। তবে, মিথ্যা মামলা মোকাবিলার জন্য সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফেরার প্রস্তুতি শেখ হাসিনা। কিন্তু বিমানবন্দরে বোর্ডিং পাস না দেওয়াসহ নানা বাধার মুখে পড়তে হয় তাকে। সে সময় বিশ্বের ৪১ দেশের ১৫১টি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে না দেওয়া নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হয়।
শেখ হাসিনা তৎকালীন সরকারের বেআইনি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেশে ফেরার ঘোষণা দেন। সরকারের আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ্বব্যাপী। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক দৃঢ়তা, সাহস ও গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর চাপে সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়। ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অসুস্থ পুত্রবধূকে দেখতে ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পর থেকে দেশের ভিতরে উচ্চাভিলাষী চক্র তাকে দেশে ফিরতে না দেওয়ার নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
প্রথমে জনৈক ঠিকাদারকে বাগে এনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া হয় চাঁদাবাজি মামলা। এফআইআর এ নাম না থাকার সত্বেও ঘাতক জামাত শিবিরের দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়। চাঁদাবাজির সাজানো মামলাটি দায়ের করা হয় ৯ এপ্রিল। মিথ্যা মামলাটি আইনগতভাবে মোকাবেলার জন্যে তিনি তাঁর সফর সংক্ষিপ্ত করে ১৪ এপ্রিলের মধ্যে দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নেন। তখনকার সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টা মেজর জেনারেল আবদুল মতিন (অব.) শেখ হাসিনাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, তাড়াহুড়ো করে দেশে ফেরার প্রয়োজন নেই। বলা হয় তিনি যেন তাঁর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষ করে নির্ধারিত সময়ে দেশে ফেরেন।
পরে যোগাযোগ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, শেখ হাসিনার মর্যাদা ও সম্মানহানির কোনও কিছুই সরকার করবে না। এমনকি প্রেসনোট জারির আগের দিন ১৭ এপ্রিলও সেই উপদেষ্টা বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে না দেওয়ার কোনও সিদ্ধান্ত তার জানা নেই। আবার প্রেসনোট জারির পর সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, প্রেসনোটের এ প্রসঙ্গে তার কোন বক্তব্য নেই। সবচেয়ে বিস্ময়কর বক্তব্য দিয়েছিলেন আইন ও তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রেসনোট ইস্যু করার পর শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেন। সেদিন রাতে তাঁর বক্তব্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে দেশে দেশের কোনও টিভি চ্যানেল বা পত্রিকায় শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়নি। সরকার তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞার খবরটি বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনাকারী সকল এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়। বিমান ও স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে যখাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
এদিকে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করার পর যোগাযোগ উপদেষ্টা জেনারেল মতিন সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও দেশে ফিরলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২২ এপ্রিল (২০০৭) বিশ্বের ৪১ দেশের ১৫১টি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে না দেওয়া সম্পর্কিত রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। ২৫ এপ্রিল (২০০৭) ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ শেখ হাসিনাকে বোডিং পাস না দেওয়ার জন্যে দু:খ পকাশ করেছিল। তারা জানিয়েছিল, বাংলাদেশ এভিয়েশন অথরিটির এক লিখিত নোটিশের কারণেই এই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিল। ২০০৭ সালের ৩ মে আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পত্রিকা ‘আউট লুক’ এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে তাঁর সংগ্রামের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যক্ত করেছিলেন।
আপনি বাংলাদেশে ফিরে যান এটা তারা চায় না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা আমার জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারছে না। এই দেশে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, মাকে হত্যা করা হয়েছে, আমার ভাইদের ও পরিবারের বেশ কিছু সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তা স্বত্ত্বেও আমি আমার দেশে ছিলাম, জনগণের অধিকারের জন্যে সংগ্রাম করেছি। আমি ৫ বছর ক্ষমতায় ছিলাম, আমার সরকার ছিল খুবই সফল।
২০০৭ সালের ৭ মে সেসময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন আওয়ামী লীগ সভাপতি; বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেদিন বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর পর্যন্ত রাজপথে মানুষের ঢল নামে। দেশে ফিরলে জনতার স্রোত তাকে অভ্যর্থনা জানায়। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে মিছিল শোভাযাত্রা নিয়ে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে ফিরে আসেন আওয়ামী লীগ প্রধান, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নানা নাটকীয়তার পর ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার করে প্রথমে তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সংসদ ভবন চত্বরে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে নিয়ে আটক রাখা হয়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে ভোর হওয়ার আগে ধানমন্ডির ৫ নং সড়কে অবস্থিত তার স্বামীর বাসভবন সুধাসদন হতে অত্যন্ত অসম্মানজনক ভাবে অনেকটা সাধারণ আসামির মতো টেঁনে হিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে তিন কোটি টাকা আদায়ের অজুহাতে প্রথমে একটি মামলা দেয়া হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে এগারোটি মামলা রুজ্জু করা হয়। যখন শেখ হাসিনাকে আটক করা হয় তখন তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতেই ছিলেন। কারাবন্দি থাকাকালীন কারাগারের অভ্যন্তরে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তখন বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে মুক্তি দেওয়ার দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। সেই সাথে আওয়ামী লীগসহ এর অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ক্রমাগত চাপ, আপোসহীন মনোভাব ও অনড় দাবির প্রেক্ষিতে অবশেষে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
মুক্তি পেয়েই চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যান তিনি। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ই তার অস্থায়ী জামিনের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়। মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা ইংল্যান্ড গমন করেন। ৫ নভেম্বর শেখ হাসিনা চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন ও ঘোষিত সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন। ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর স্থায়ী জামিন দেয়া হয় তাকে। পরে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকার গঠিত হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বড় পরিবর্তনগুলোর একটি ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। এই দিনে আবির্ভাব ঘটেছিল কথিত ওয়ান ইলেভেন-এর। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের একতরফা সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবরণে গঠিত হয় সেনা নিয়ন্ত্রিত ‘অন্তর্বতীকালীন সরকার’। ‘ওয়ান ইলেভেন’ এর এই পটপরিবর্তন নানা অস্বস্তির জন্ম দেয় শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই দুই বছরে দল ভাঙা-দল গড়ার ‘খেলা’ও ওই সময়ে দেখে জনগণ।
পাঁচ বছরের বিএনপি-জামায়াত জোটের অপশাসনের পর চেপে বসা শাসককূল তখন রীতিমতো ত্রাস। রাতারাতি সবকিছু বদলে ফেলার আভাস দিয়ে রাজনীতি থেকে জঞ্জাল পরিষ্কার করার কথা তখন এমন করে বলা হতো, যেন রাজনীতি এক গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত। অবশ্য জোট অপশাসন রাজনীতিকে অনেকটাই সে পর্যায়ে নিয়ে যায়। আর সেই সুযোগেই চেপে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে ‘অন্তর্বতীকালীন সরকার’ নামের নতুন এক শাসনব্যবস্থা। ওয়ান-ইলেভেন নামের পট পরিবর্তনের পর সরকার পরিচালনায় আসা এই সরকারের আমলে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করার পর সাহসী রাজনীতির পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাসকে মুছে ফেলার কী কুৎসিত-নির্মম ও ভয়াবহ চক্রান্তই না করেছিল প্রতিক্রিয়াশীল চক্র! চেষ্টা করেছে সংকীর্ণ রাজনীতির হীনমন্যতার ছদ্মাবরণে তার ভাবমূর্তি নস্যাৎ করতে। রাজনৈতিক নিষ্ঠুর প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও চক্রান্তের জাল বিছিয়েছে গোপনে!
ওয়ান-ইলেভেনের এই পটপরিবর্তন নানা অস্বস্তির জন্ম দেয় শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই দুই বছরে দল ভাঙা-দল গড়ার ‘খেলা’ও দেখে জনগণ। সে সময় দুর্নীতির মামলায় বহু রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়।
আমরা যদি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই জীবনের সিংহভাগ তাকে থাকতে হয়েছে কারা অভ্যন্তরে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের এই মহান নেতাকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানের চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধুর মতোই যেন ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে তার কন্যা শেখ হাসিনাকে।
দেশের মানুষ যখন অধিকারবঞ্চিত, ১৯৮১ সালে তিনি চেপে বসা শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশে ফিরে দাঁড়িয়েছেন অধিকারবঞ্চিত মানুষের পাশে। শেখ হাসিনার চলার পথটা সহজ ছিল না কোনোদিনই। রাজনীতিতে জেল জুলুম নতুন কোন ঘটনা নয়। মহৎ রাজনীতিকরা কারাগারে বসেই তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা করেছেন, এমন অনেক নজির আছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনাও নির্জন কারাবাসকালে অলস সময় কাটাননি। কারাগারের নির্জনতাকে তিনি তার সৃজনশীল রাজনৈতিক চিন্তায় সময় পার করেছেন। তার চরিত্রের যে বিষয়টি সবারই নজর কাড়ে তা হচ্ছে তার গভীর প্রত্যয়। দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ জননেত্রী গভীর সঙ্কটেও জনগণের কল্যাণ চিন্তা করেন। সেই চিন্তার প্রতিফলন এরইমধ্যে ঘটেছে। এক স্মৃতিচারণে জননেত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার যে পরিকল্পনা, তা সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাগারে নিঃসঙ্গ দিনগুলোতেই তৈরি করেছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক চরাই-উৎড়াই পেরিয়ে আসতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতিতে অভিষেক যেমন তার জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না, তেমনি মসৃণ নয় তার রাজনৈতিক চলার পথটিও। পায়ে পায়ে পাথর ঠেলে, শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। কিন্তু জনগণকে আস্থায় নিয়ে রাজনৈতিক কল্যাণের যে পথযাত্রা শুরু হয়েছিল তার, তা থেকে তাকে বিচ্যুত করা যায়নি। ১৯৮১ থেকে এই দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রাটি একেবারেই কুসুমাস্তীর্ণ বলা যাবে না। বরং কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বাবার মতই অনেক চরাই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছেন। দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছে নিঃসঙ্গ পরবাস। স্বামী-সন্তান নিয়েও গভীর বেদনার দিন পার করতে হয়েছে তাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়েও স্বদেশে ফিরতে পারেননি তিনি। দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পরও ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করেছে ঘাতক। একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে তিনি সংসদে প্রথমবারের মত নির্বাচিত হন। বসেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে। জনস্বার্থে ১৯৮৮ সালে পদত্যাগ করলেন। তারপর যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রাম। তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে কয়েক বার চট্টগ্রামে, কোটালিপাড়ায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। বাংলার মানুষের ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়েছে শত্রু। তারপরও ষড়যন্ত্র কম হয়নি তাকে নিয়ে। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করাটাও ছিল গভীর এক ষড়যন্ত্র। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে দেশে ফিরে আসার পর থেকে ১৯৮৩, ১৯৮৫, ১৯৯০ ও ২০০৭ সালেও গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।
শত বাধা-বিপত্তি-প্রতিকূলতা ও হত্যার হুমকি উপেক্ষা করেও শেখ হাসিনা ভাত-ভোট ও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারই ফল হিসেবে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর ফের আওয়ামী লীগকে এনে দিয়েছেন জয়, গঠন করেছেন সরকার। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ অর্জন করেছে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা। বাংলাদেশ পেয়েছে নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। শেখ হাসিনার অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
আজকের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে অনেক কালো অধ্যায় পার হয়ে আসতে হয়েছে। এখনও বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে চলতে হচ্ছে। শেখ হাসিনা গত এক যুগে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে এক সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র এখনও থেমে নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গভীর এক ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশ।
বঙ্গবন্ধু কন্যাই পারেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরে উন্নয়নের নতুন পথে শনৈ শনৈ এগিয়ে নিয়ে যেতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর এখন অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় লাভ করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করা হয়। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের ভোটের অধিকার সুনিশ্চিত করতে সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বন্ধুর বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। এসব সত্ত্বেও বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন দৃঢ় ও অবিচল।
মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শেখ হাসিনা সবসময়ই আপসহীন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক লৌহমানবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়ে তার সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় স্থাপিত ট্রাইবুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে এবং রায় কার্যকর করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালনের পর এখন পার করছেন চতুর্থ মেয়াদ। আশির দশকে যেমন তিনি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন দলকে, তেমনি একটি অনুন্নত দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যে কারণে জাতীয়-আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার আর স্বীকৃতি রয়েছে তার ঝুলিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম ও বিশ্বব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন উপাধি দিয়েছেন। এ ছাড়া তার কর্মদক্ষতা ও মহানুভবতার জন্য তিনি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে অসংখ্য পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্ন আজ জননেত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের যে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, তার কারিগর এই শেখ হাসিনা। তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া একটি দেশকে যে মানুষটি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তিনি এই শেখ হাসিনাই।
কেবল স্বপ্ন দেখানোই নয়, স্বপ্নকে কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়, তার পথও দেখিয়েই চলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি। এরইমধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান গোটা বিশ্বের মধ্যেই ঈর্ষণীয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্থনীতিতে বিশ্বের শীর্ষ ২৬টি দেশের মধ্যে উঠে আসবে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরাও বলছেন, বাংলাদেশ যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত হতে এই দেশকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে হবে না। যার কল্যাণে এই উন্নয়ন আর উত্তরণের পথে বাংলাদেশের পথচলা, তিনি শেখ হাসিনা।
‘২০০৭ সালের ১৬ জুলাই রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে মূলত গণতন্ত্রকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিলো, বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা-স্বপ্নকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিলো। ‘তৎকালীন সেনা সমর্থিত অনির্বাচিত সরকার মাইনাস ওয়ান ফর্মূলা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে মূলত শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিলো।
ছাত্র-যুব-জনতার নিরন্তর আন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালের ১১ জুন তৎকালীন সরকার রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আর শেখ হাসিনার মুক্তির মাধ্যমেই সেদিন গণতন্ত্র মুক্তি পায়। তাই ১১ জুন শুধু মাত্র শেখ হাসিনার মুক্তি দিবসই নয় এটা গণতন্ত্রের মুক্তি দিবস।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ( ডিইউজে); বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ বুলেটিন।