সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:৪৫ am
ডেস্ক রির্পোট : সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করতে তারেক রহমানের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ব্যাংকক গিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের অর্থ সম্পাদক মনির হোসেন কাশেমী। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি ও হেফাজতের একজন শীর্ষ নেতার নির্দেশে কাশেমী ব্যাংকক যান। সেখানে একজন ব্যক্তির সঙ্গে তার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সরকার পতনের আন্দোলনের বিষয়ে আলোচনা হয়। এজন্য কাশেমী ব্যাংকক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থও নিয়ে আসেন। গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন তিনি। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে কাশেমী এখন কারাগারে রয়েছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মনির হোসেন কাশেমীর কাছ থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পরবর্তীতে তাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে আনা হবে।’
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতাদের রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন মনির হোসেন কাশেমী। হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে যে কয়জন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়েছিলেন মনির হোসেন কাশেমী তাদের মধ্যে অন্যতম। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষে সৌদি আরবে চলে যান তিনি। সৌদি আরবের রাজ পরিবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। সেই পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাঠাতেন তিনি।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ২০১২ সালে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে প্রথমে গাজীপুরের একটি মাদ্রাসায় চাকরি করেন। সেখান থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে তিনি বারিধারার জামিয়া মাদানীয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস নূর হুসাইন কাশেমীর সংস্পর্শে থাকায় হেফাজতে ইসলামে মনির প্রভাব বিস্তার করেন। এই কাজ আরও বেশি সহজ করার জন্য হেফাজতের আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর খাদেম হিসেবে ইনামুল হাসান ফারুকীকে তিনি নিযুক্ত করেন। তারা দুজনে মিলে হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মনির হোসেন কাশেমী তার রাজনৈতিক অভিলিপ্সার কথা স্বীকার করেছেন। নূর হুসাইন কাশেমী ও বিএনপির এক নেতার পক্ষ থেকে তিনি তারেক রহমানের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাত করতে ব্যাংকক যাওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন। মনির হোসেন কাশেমী জানিয়েছেন, অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির সঙ্গে তার সরকার পতনের আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হয়। এজন্য তারেক রহমানের ওই প্রতিনিধি তাকে বিপুল অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই গত বছরের মার্চেই বিএনপি হঠাৎ করে রাজধানীতে ঝটিকা মিছিল-মিটিং করে। পরবর্তীতে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবসে শাপলা চত্বরের মতো আরেকটি জমায়েতের পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই পরিকল্পনা তারা বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
জিজ্ঞাসাবাদে মনির হোসেন কাশেমী জানিয়েছেন, বিএনপির এক নেতার মোবাইল থেকে শায়খুল হাদীস নূর হুসাইন কাশেমীর মোবাইলে একটি ‘প্রোগ্রাম ক্যান্সেলড’ লেখা একটি বার্তা আসে। এই বার্তা পেয়ে তারা শাপলা চত্বরের মতো জমায়েতের পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, মনির হোসেন কাশেমী অনেক চতুর। চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দিলেও জিজ্ঞাসাবাদে অনেক বিষয় তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। এমনকি গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি আগেই টের পাওয়ায় তিনি নিজের পাসপোর্ট ও ব্যবহৃত মোবাইলটি লুকিয়ে রাখেন। গ্রেফতারের পর নানা চেষ্টা করেও তার ব্যবহৃত মোবাইল ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা যায়নি।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মনির হোসেন কাশেমী হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন চাঙা করতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন। এছাড়া গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকার ধনাঢ্য ও দানশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে মাদ্রাসার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামেও মুসলিম দেশগুলো থেকে অর্থ সহায়তা নেন। কিন্তু এসব অর্থ যথাযথভাবে খরচ না করে নিজে আত্মসাৎ করেছেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, আত্মসাৎ করা টাকার একটি অংশ মনির হোসেন কাশেমী বিগত জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে সংসদ সদস্য পদে ভোট করতে গিয়ে খরচ করেছেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সদর থানাধীন কালীর বাজার এলাকায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে ৮০ শতাংশ জমি কিনেছেন। এছাড়া তার ব্যাংকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, হেফাজতের অর্থ সম্পাদক মনির হোসেন কাশেমী মধ্যপ্রাচ্য থেকে অর্থ আনার বিষয়টি সমন্বয় করতেন। আমরা তদন্তে লক্ষ্য করেছি হেফাজতের যে অর্থায়ন করা হয় তা অনেকটাই বিদেশ থেকে আসে। মূলত, রোহিঙ্গা ইস্যু, মাদ্রাসা, এতিমদের জন্য আসে। তাছাড়া কিছু টাকা আসে যা শুধু হেফাজতের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। কিন্তু এই টাকাগুলো তাদের হিসেবে সঠিকভাবে রাখা হয়না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা হেফাজতের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশে ওই টাকা ব্যবহার করা হয়েছে। তদন্তে বিপুল পরিমাণ টাকা তসরুফের তথ্যও মিলেছে। আমরা আরও গভীরভাবে তদন্ত করছি।সূত্র : বাংলাট্রিবিউন