রবিবর, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:১৩ am
।।কামরুদ্দীন হীরা।।
পঞ্চম বারের মতো আবারো বাড়লো লক ডাউনের সময়সীমা। ২৩ মে থেকে আগামী ৩০ সে পর্যন্ত এ লকডাউন বাড়ানো হয়েছে। করোনা সংক্রমন না কমা পর্যন্ড বিধিনিষেধ কড়াকড়ি ভাবে মানার পরামর্শ দেয়া হলেও বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে। আগের বিধি নিষেধে একই জেলার মধ্যে গণপরিবহন চালু থাকলেও আন্তজেলা বাস চলাচল বন্ধ ছিল। একই সাথে বন্ধ ছিল যাত্রীবাহী নৌযান ও ট্রেন চলাচল। তবে এখন ট্রেনের টিকিট কাটতে হবে অনলাইনে বা মোবাইল অ্যাপে। অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে যাত্রী পরিবহন করতে হবে সব পরিবহনকে। কিন্তু গত এক মাসের লক ডাউনে মানুষকে ঘরে বন্দি রাখা সম্ভব হয়নি।
সড়কে গাড়ির জট দেখা গেছে। গণমানুষ মার্কেটে ও শপিং মলে গাদাগাদি করে কেনাকাটা করেছে। তারপর নাড়ির টানে ঈদ উৎসব পালন করতে রাজধানী থেকে ছুটে গেছে গ্রামের বাড়িতে। দূর পাল্লার গাড়ি বন্ধ থাকলেও যে যার সামর্থানুসারে ট্রাকে, লরিতে, মাইক্রাবাসে, মটর সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া আর মানিকগঞ্জের পাটুয়ারিয়া ফেরিঘাটে বর্ডার গার্ড রেজিমেন্ট মোতায়েন করেও জনশ্রোত নিয়ন্ত্রণ করা যায় নি। করোনা সংক্রমন ঠেকাতে যে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখার কথা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেদিকে কারো নজর নেই। যানবাহন পারাপারের ফেরিতে মানুষের এমনই চাপ যে মৌচাকের মতো মানুষ ভর্তি। সেখানে একটি মোটর সাইকেলেরও স্থান সংকলান হয় না।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তজেলা গণপরিবহন বন্ধ রেখে জনগণের ভোগান্তি বেড়েছে আর পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে অতিরিক্ত টাকা। গণপরিবহনে যেখানে ভাড়া লাগতো পাঁচ শত টাকা সেখানে যাত্রীদের মূল ভাড়ার সাথে অতিরিক্ত ৬০% ভাড়া অতিরিক্ত দেয়ার কথা সরাকর বলে দিলেও গণপরিবহনে না থাকায় সে ভাড়ায় কেউ যেতে পারে নি। অর্থ্যাৎ উৎসবে আনন্দে ঘরে ফিরতে যেমন স্বাস্থবিধি মানা সম্ভব হয় নি, তেমনি অর্থের অপচয়ও হয়েছে অধিক। এদিকে প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকা বাড়ছে। সাথে আতংকিত সবাই ভারতীয় ভেরিয়েন্ট নিয়ে। ভারতেও উৎসব আনন্দ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাবেশের কারণে করোনা জনজীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশে^ বিভিন্ন দেশ সাহায্যের হাত বাড়ালেও জনজীবনে স্বস্থি সৃষ্টি করতে পারে নি।
শাসান কিংবা কবরস্থান সবখানেই ঠাই নাই ঠাই নাই অবস্থা। দ্রুত সংক্রমনের ভারতীয় ভেরিয়েন্ট বাংলাদেশ ঢুকে গেছে। ভারত থেকে বেনাপোলস্থ বন্দর দিয়ে আসা ব্যক্তিদের মাঝেই ভেরিয়েন্ট পাওয়া গেছে। কাজেই তা কখন কোথায় কিভাবে ছড়িয়ে পড়ে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেনা। তাই সবার আগে নিজের সচেতনতা বাড়াতে হবে সবাইকে। তা না হলে সরকার ঘোষিত লক ডাউন কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবে না। করোনা সংক্রমন সীমান্তবর্তী জেলা গুলোয় বেড়ে গেছে। চাপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাজ্ঞা, ঝিনাইদহ, রাজশাহী ও সিলেটে এ সংক্রমন বেশি। তবে চাপাই নবাবগঞ্জের অবস্থা খুবই খারাপ। জেলা সিভিল সার্জন অফিস জানাচ্ছে, গত এক সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার গড় হিসেবে দেখা যাচ্ছে, দু’জনের মধ্যে একজনের (৫৯ শতাংশ) করোনা শনাক্ত হচ্ছে। অথচ গত সপ্তাহে শনাক্তের জাতীয় হার ছিল ৯ শতাংশের নিচে। তাই সেখানে এক সপ্তাহের সর্বাত্বক লক ডাউন ঘোষনা করা হয়েছে। সেখানে অভ্যান্তরিন ও আন্তজেলা পরিবহন চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
গত এক মাসে প্রতিবেশী দেশ ভারতে সংক্রমন বৃদ্ধি ও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বৈশি^ক চুশ্চিন্তার কারন হয়ে দাড়িয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমন বৃদ্ধির সঙ্গে দুই দেশের নাগরিকদের চলাফেরা সম্পর্ক থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ নেপালের ঘটনা দেখে সতর্ক হতে হবে। ভারত-নেপাল সীমান্তবর্তী এলাকায় নেপালী ভুখন্ডে সম্প্রতি সংক্রমন অনেক বেশি হয়েছে এমন খবর গনমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
গত বছরের ১৭ মার্চের পর থেকে লকডাউন জারি হলে থমকে যায় দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের জীবন। সরকার ও সামর্থবান অনেক ব্যক্তি তাদের খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। কিন্তু তারপরও মানুষের জীবনের তাগিদেই ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে। তবে গত এক মাসের লক ডাউনে অফিস আদালত খোলা থাকায় মানুষকে বের হতে হয়েছে। গণপরিবহন না থাকায় অনেক ঝাক্কি ঝামেলা সয়ে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে অফিসে যাতায়াত করতে হয়েছে। মহামারি করোনার মধ্যে আমরা অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছি বলে যতই তৃপ্তির ঢেকুর তুলি না কেন দেশে কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্থ হবার পরিবর্তে সংকুচিত হয়েছে। গত দু’বছর কোথাও নিয়োগ না হলেও অনেকে চাকুরি হারিয়েছেন। বেকারত্বের থাবায় দিশেহারা আমাদের যুব সমাজ। শিক্ষিত বেকাররা কোনো পথ খুজে পাচ্ছেন না।
ঈদের আগে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভের মুখে মার্কেট ও শপিং মলগুলো খুলে দেয়া হলেও আন্তজেলা বাস চলাচল করতে দেয়া হয় নি। স্বাস্থ্য বিধি মেনে দুরপাল্লার বাস চলাচলের দাবীতে পরিবহন মালিক শ্রমিকরা বাস চলাচলের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেও সরকার সেদিকে নজর দেয়া নি। ফলে ঈদের দিনে বাস টারমিনালগুলোয় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। পরিবহন শ্রমিকদের কোনো আয় না থাকায় তাদের মানবেতন জীবন পাড়ি দিতে হচ্ছে।
তাই ঈদ যাত্রায় ঘরমুখী মানুষকে ঘরে পৌছে দিতে কোথাও কোথাও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দু’চারটি বাস চলতে দেখা গেছে। একজন পরিবহন শ্রমিক জানান, পুলিশ ধরলে তাকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু সাংবাদিকদের কারনে পুলিশ ম্যানেজ হতে ভয় পায়। এখন অনেক সাংবাদিক। একজন ম্যানেজ হলে অন্যরা নিউজ করে বসেন। ফলে পুলিশ বিপাকে পড়ে। তাই তারা বাস চলতে দেন নি। কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসার মানুষেরও অভিজ্ঞতা একই। গনপরিবহন বাস না চললেও পথে গাড়ির চাপ ছিল অনেক বেশি। ফলে পুলিশ নিরব দর্শকের ভূমিকায় না থেকে কোনো গত্যান্তর ছিল না।
লক ডাউনে সব কিছুই খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো পুরো স্থবির হয়ে আছে। উচ্চতর শিক্ষা থেতে শুরু করে প্রাথমিক সব স্থরেই স্থবিরতা। বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম বর্ষ সম্মান বা পাশ শ্রেণিতে কোন ছাত্র নেই। এটা বাংলাদেশের স্বাধীন হবার পর থেকে এ পর্যন্ত নয়, বৃটিশ আমলেও এমন দেখা যায় নি। এইচএসসি পরীক্ষা না নিয়ে এসএসসি ও জেএসসির নিরীখে ফল প্রকাশ করা হলেও তাদের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা সম্ভব হয় নি। ভর্তি পরীক্ষা করে নেয়া সম্ভব হবে তাও অনিশ্চিত।
অন্যদিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অন লাইনে অথবা টেলিভিশনে বেতারে ক্লাস নেয়া শুরু করলেও দেশের সব শিক্ষার্থীকে সে সুযোগ দেয়া সম্ভব হয় নি। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন মন কষ্টে ভুগছে। তবে সরকার বলছে আগামী ১২ই জুলাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হবে। ইতি পূর্বে এমন তারিখ দেয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো খোলা হয়নি।
নিজেদের সচেতনতার মাধ্যমে করোনাকে পরাজিত করে সব ক্ষেত্রে গতিময়তা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবো বলে বিশ^াস করতে চাই। বিদায় হোক করোনা নেমে আসুক জনজীবনে শান্তি। ছাত্র-ছাত্রীদের কলকাকলিতে ভরে উঠুক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সূত্র : এফএনএস