প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ৫ ঘণ্টারও বেশি সচিবালয়ে আটকে রেখে যখন তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের গোপন নথি চুরি বা ছবি তোলার অভিযোগ আনা হচ্ছিল, আমার ধারণা ছিল যেভাবেই হোক বিষয়টি সচিবালয়েই মিটে যাবে। মিটমাট করার জন্য ৫-৬ ঘণ্টা অনেক লম্বা সময়। কিন্তু মিটমাট না করে যখন তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমার আশঙ্কা ছিল তার বিরুদ্ধে হয়তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় মামলা দেওয়া হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি প্রণয়নের সময়ই সাংবাদিকরা আরও অনেক ধারার সঙ্গে ৩২ ধারা নিয়ে তীব্র শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এই ধারা প্রয়োগ করা হলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কবর রচনা হবে, এমন শঙ্কার কথা বলছিলেন অনেকেই।
কিন্তু গত কয়েক বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এত সমালোচনা হয়েছে, এত নিন্দা হয়েছে, আইনটির এত অপব্যবহার হয়েছে; আমার ধারণা সে কারণেই রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে এ আইনের প্রয়োগ হয়নি। কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে রোজিনা ইসলামকে আটকানোর জন্য সিন্দুকের গভীর থেকে শতবর্ষী আইন অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ বের করে এনেছে। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘বাবা’। কথাটা মজা করে বলা, কিন্তু মিথ্যা নয়। কারণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতার অপরাধসমূহ ডিজিটাল ফরম্যাটে করলে তা শাস্তিযোগ্য। তার মানে হয়রানির অস্ত্র অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল হয়েছে শুধু। তবু ডিজিটাল সরকার রোজিনাকে আটকাতে শতবর্ষী অ্যানালগ আইনটিই কেন বেছে নিলো জানি না। ব্রিটিশরা সরকারের গোপনীয়তা রক্ষায় এই আইনটি করেছিল মূলত আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। আজ সুযোগ পেয়ে আমলারা সে আইন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে দিলেন। আসলে ‘খলের কখনও ছলের অভাব হয় না’।
সচিবালয়ে রোজিনার সঙ্গে যা হয়েছে, তা কতটা অপরাধ; তা আদালত বিবেচনা করবে। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আমার বিবেচনায় তাকে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক তার চোখের সামনে কোনও তথ্য পেলে তার নথি সংগ্রহের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেই। তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে চুরি হিসেবে বিবেচনা করলে পৃথিবীতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলে আর কিছু থাকবে না। গত সপ্তাহেই এই কলামে লিখেছিলাম, ‘অস্তিত্বের সংকটে গণমাধ্যম’। আসলে গণমাধ্যমের সংকটগুলো বহুমাত্রিক। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট আস্থা এবং বিশ্বাসের। বাংলাদেশে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাবদ্ধতার কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সে অর্থে হয়ই না। এই না হওয়া কালে রোজিনা ইসলাম ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। গত কয়েক বছরে তিনি ধারাবাহিকভাবে নানান দুর্নীতির স্বরূপ উদঘাটন করে আসছিলেন। বিশেষ করে গত এক বছরের করোনাকালে তার নজর ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে। আর এই সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির সংক্রমণ ছিল করোনার চেয়েও বেশি। তাই রোজিনা ছিলেন সবার টার্গেট। হতে পারে ইচ্ছা করে গুরুত্বপূর্ণ কোনও ফাইল ফেলে রাখা হয়েছিল। আর রোজিনার মতো একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক তেমন একটি খবর সামনে দেখলে তার লোভ হতেই পারে। হতে পারে রোজিনাকে আটকানোর জন্যই ফাঁদটি পাতা হয়েছিল। তবে তার আসল অপরাধ ছিল আগের কয়েক বছর ধরে নিরলসভাবে দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধান।
সাংবাদিকতায় অনেক ধরন আছে। অনেকে মাছরাঙা পাখির মতো ওপর থেকে একটি মাছ পেলেই সন্তুষ্ট হয়ে উড়ে যায়। আবার রোজিনার মতো অনেকে গভীরে অনুসন্ধান করে। যে তথ্য হেঁটে হেঁটে আপনার অফিসে চলে আসবে, আপনার ফ্যাক্স বা ই-মেইলে চলে আসবে; যে নিউজ ছাপানোর জন্য আপনাকে ফোন করবে; সেটা আসলে কোনও নিউজই নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও নিশ্চয়ই চায় সাংবাদিকরা শুধু তাদের প্রেস রিলিজ প্রকাশ করুক। কিন্তু সাংবাদিকদের কাজ তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের চাওয়া পূরণ করা নয়। সাংবাদিকদের কাজ সত্য তুলে ধরা। আর প্রকৃত সত্য বের করতে সাংবাদিকদের অনেক কষ্ট করতে হয়। দুর্নীতিবাজরা চাইবে সত্য গোপন করতে, সৎ সাংবাদিক চাইবে সেটা প্রকাশ করতে।
তবে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের জন্য ডকুমেন্ট থাকতে হবে। সেটা জোগাড় করাই সাংবাদিকদের লড়াই। এই লড়াইয়েই আটকে গেছেন রোজিনা ইসলাম। এটা ঠিক রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে, কিন্তু পুরো ঘটনায় আমি সাংবাদিকতারই জয় দেখছি। যখন সরকারসহ সবাই সাংবাদিকদের ওপর সন্তুষ্ট থাকেন, তখন বুঝতে হবে সাংবাদিকতাটা হচ্ছে না। যখন অনেকেই সাংবাদিকদের ওপর ক্ষিপ্ত থাকবেন, তখন বুঝতে হবে সাংবাদিকরা ঠিক কাজটিই করছেন। রোজিনা নিজে কারাগারে গিয়ে প্রমাণ করলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ঠিক পথেই আছে। অনেকে কথায় কথায় সাংবাদিকদের গালি দেন, বলেন, সাংবাদিকরা খালি দালালি করছেন; তাদের বলি, ভাই একটু স্মরণ করে দেখেন এই যে পি কে হালদার, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, শেয়ার বাজার, বালিশকাণ্ড , সাহেদ-সাবরিনা নিয়ে আপনারা ফেসবুকে বিপ্লব করেন; এই তথ্যগুলো আপনাদের কে দিয়েছে? রোজিনার মতো কোনও না কোনও সাংবাদিকই কিন্তু বের করেছে। রোজিনা যদি একদম সরল সহজ পথে হাঁটতেন তাহলে নিশ্চয়ই ক্রেস্টের স্বর্ণে ভেজালের খবরটি তার কাছে চলে আসতো না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির খবরগুলো কিন্তু রোজিনাকে মন্ত্রণালয়েরই কেউ না কেউ দিয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা লোকটিও কোনও কাজ করার আগে লাভ-ক্ষতি, ভালো-মন্দ বিবেচনা করে। এখন রোজিনা ইসলামকে গ্রেফতার করে কার লাভ হলো? সরকারের লাভ-ক্ষতির বিবেচনাটা আমি জানি না। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে এই ঘটনায় সরকারের কোনোই লাভ হয়নি। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে গ্রেফতারে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তি যতটা ক্ষুণ্ন হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আর কোনও ঘটনায় তা হয়নি। এবং সরকারের এই ক্ষতি সহজে পূরণ হওয়ারও নয়। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে রোজিনার গ্রেফতার একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে থাকবে। ব্যাপারটি এমনও নয় যে রোজিনার ঘটনাটি হুট করে ঘটে গেছে, সরকার বুঝতে পারেনি। সচিবালয়ে ছয় ঘণ্টা তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। এই সময়ে নিশ্চয়ই সরকারের সব মহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সুযোগ ছিল সচিবালয়েই বিষয়টি মিটমাট করে ফেলার। তার মানে সরকার জেনে বুঝেই লাভক্ষতি বিবেচনা করেই রোজিনাকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি জানি না, আমলাদের গোঁয়ার্তুমি বিপরীতে ঠান্ডামাথায় পরিস্থিতির লাভক্ষতি বিবেচনা করার মতো রাজনৈতিক কোনও নেতৃত্ব কি নেই? তবে এই ঘটনায় লাভ হয়েছে সাংবাদিকতার। অনেক দিন পর একটা ইস্যুতে দলমত নির্বিশেষে সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজ ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ করতে পেরেছে।
আরেকটা বিষয় হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুযোগ পেলেই মানুষ সাংবাদিকদের গালাগাল করে। এটা ঠিক, যখন সবাই সাংবাদিকদের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে, তখন বুঝতে হবে সাংবাদিকতা হচ্ছে না। সরকার যখন সাংবাদিকদের ওপর খড়গহস্ত থাকবে, তখন বোঝা যাবে সাংবাদিকরা ঠিক পথেই আছেন। রোজিনার এই ঘটনা বড় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সাংবাদিকদের জাগিয়ে দিলো, বুঝিয়ে দিলো তাদের দায়িত্বটা এবং এটাও স্মরণ করিয়ে দিলো গণমাধ্যম জনগণের পক্ষে থাকলে জনগণও তাদের পক্ষে থাকে। আর গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় সুরক্ষা হলো জনগণই। এই ঘটনায় আবার প্রমাণ হলো, সাংবাদিকতা ফুলশয্যা নয়, পথে পথে কাঁটা বিছানো। সেই সব বাধা টপকেই, কাঁটার আঘাতে রক্তাক্ত হয়েই ভালো সাংবাদিকতার লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। তবে এই ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে লাভ হয়েছে রোজিনা ইসলামেরই। ব্যক্তিগত হয়রানি, ভোগান্তি, থানা-পুলিশ-আদালত-কারাগার সব বাধা পেরিয়ে রোজিনা সমুন্নত রাখলেন সাংবাদিকতার জয়পতাকা। তার ঘরে অনেক পুরস্কার আছে। তবে এই মামলা হলো তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এই ঘটনা তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেবে।
আমার আরেকটা বিষয় মাথায় ঢোকে না, রোজিনা ইসলাম বা তার মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের শত্রু জ্ঞান করে কেন? আমার বিবেচনায় সৎ সাংবাদিকরা তো সরকারের সবচেয়ে বড় বন্ধু। সরকার নানা গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে যে খবর সংগ্রহ করতে চান, সাংবাদিকরা তো সেটাই তুলে ধরেন। সরকারের বরং উচিত সাংবাদিকদের শত্রু জ্ঞান না করে তাদের রিপোর্ট আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। রোজিনা রিপোর্ট না করলে কি সরকার কোনোদিন জানতে পারতো মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননার ক্রেস্টের স্বর্ণে ভেজাল আছে, বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়োগে দুর্নীতি আছে। বাংলাদেশে সর্বস্তরে দুর্নীতি আছে, সেটা সবাই জানে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে।
রোজিনা ইসলামকে গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ফেসবুকে ছোট্ট একটা স্ট্যাটাসে সরকারের লাভ-ক্ষতির হিসাবটা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নয়, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে দেশ-জাতি উপকৃত হবে।’ এই সহজ সমীকরণটা সরকার বোঝে না কেন। দুর্নীতির রিপোর্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় না, ক্ষুণ্ন হয় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে। সরকারের শুভ অংশের তো রোজিনাকে পুরস্কৃত করার কথা। তিনি সরকারের অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছেন, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে দিয়েছেন। দুর্নীতিবাজ আমলারা রোজিনার ওপর ক্ষিপ্ত হতে পারেন। সেই দুর্নীতিবাজ আমলাদের চাপের মুখে রোজিনাকে কারাগারে পাঠিয়ে সরকার যে গ্যাড়াকলে পড়লো, তা থেকে উদ্ধারের রাস্তা জানা আছে তো?
সাংবাদিকরা অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না, গ্রেফতার করা যাবে না; তেমনটা আমি মনে করি না। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমনভাবে বাধা পেলে কাজ চালানো কঠিন। সরকার যদি সত্যিই দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়; তাহলে সৎ সাংবাদিকতাই তার সবচেয়ে বড় সহায়। সরকার যত তাড়াতাড়ি সেটা বুঝবে ততই মঙ্গল। লেখক: প্রভাষ আমিন , সূত্র : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ, বাংলাট্রিবিউন। আজকের তানোর