শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৬:৪১ am
সহকর্মী রোজিনা ইসলামকে শাহবাগ থানায় আনা হয়েছে শুনে ১৭ মে ২০২১ সোমবার রাতে ওই থানায় দ্রুত চলে গেলাম। বাইরে সাংবাদিকেরা তাঁর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করছিলেন। রোজিনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। তবে তাঁর জরুরি ওষুধ এবং কাপড়চোপড় সেই রুদ্ধ দরজা খুলে ভেতরে দেওয়া হলো অনেকক্ষণ ধরনার পর। পরের দিন, ১৮ মে মঙ্গলবার বেশ সকাল সকাল তাঁকে নেওয়া হলো সিএমএম আদালতে। প্রথমে রাখা হলো গারদে। তারপর তাঁকে শত শত পুলিশের বিশাল বহর নিয়ে গেল আদালতকক্ষে।
আদালতকক্ষের ভেতরে ঢুকে রোজিনা ইসলামের দেখা পেলাম। তাঁকে বললাম, বঙ্গবন্ধু একটা অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে। ‘সত্য ও মিথ্যার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে প্রথমে মিথ্যা জয়ী হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় সত্য’। ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি বঙ্গবন্ধুর ওপরে নজর রাখছিলেন, সেই রাজা আনার খানকে বঙ্গবন্ধু এই অটোগ্রাফ দেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশের জয় হয়েছে, পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে, বঙ্গবন্ধুকেও কারাগার থেকে বের করে আনা হয়েছে একটা গেস্টহাউসে। সেখানে রাজা আনার খান বাংলাদেশের জাতির পিতার কাছে অটোগ্রাফ চাইলেন। বঙ্গবন্ধু তখন ফিওদর দস্তয়েভস্কির লেখা উপন্যাস ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট পড়ছিলেন। সেটা আনার খানকে দিলেন। তাতে তিনি লিখে দিলেন, ‘ইন দ্য লং ওয়ার বিটুইন ফলসহুড অ্যান্ড ট্রুথ, ফলসহুড উইনস দ্য ফার্স্ট ব্যাটল অ্যান্ড দ্য ট্রুথ দ্য লাস্ট।’
আমাদের আশা ছিল, ১৮ মে তারিখেই রোজিনা জামিন পাবেন। সেদিন রিমান্ডের আবেদনের শুনানি হলো। রিমান্ড নামঞ্জুর হলো। জামিনের শুনানির দিন ধার্য করা হলো ২০ মে বৃহস্পতিবার। আবারও রোজিনাকে নেওয়া হলো সিএমএম আদালতের লাগোয়া গারদে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিত আবেদন করে গারদের ভেতরে গিয়ে রোজিনার সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। নিজের একমাত্র শিশুকন্যা আলভিনাকে নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। মতি ভাইকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করবেন।’
১৮ মে রোজিনার সঙ্গে দেখা করে গারদ থেকে বের হলাম। প্রিজন ভ্যান রেডি করা হচ্ছে। এই প্রিজন ভ্যানে রোজিনাকে এখন তোলা হবে। কারাগারে নেওয়া হবে। ১৭ মে রোজিনা ইসলাম সকাল সকাল বেরিয়েছিলেন করোনা টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার জন্য। এরপর তিনি তথ্যের সন্ধানে যান সচিবালয়ে। এরপর তিনি আর বাড়ি ফিরে যেতে পারলেন না। সারা রাত কাটল শাহবাগ থানায়। এখন তাঁকে ঢুকতে হবে কারাগারে।
অভিযুক্ত মানেই অপরাধী নয়। রোজিনা ইসলাম আইনের চোখে অপরাধী কি না, তা আদালতের বিবেচনা। তবে রোজিনা ৫ টাকার মাস্কের বিল ৫ হাজার টাকা করেননি, ২ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে বিদেশ চলে যাননি, হাতে পিস্তল-রিভলবার-ছুরি হাতে সচিবালয়ে ঢোকেননি। তবে তাঁর ছিল এক মারাত্মক অস্ত্র। বিবেক। তাঁর আছে এক মারাত্মক অস্ত্র—কলম। কলম তো তরবারির চেয়েও শক্তিশালী। তবে রোজিনার ‘অপরাধ’ ছিল। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে একটার পর একটা রিপোর্ট করে চলেছেন। শুধু স্বাস্থ্য খাত নিয়েই তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো দেশে-বিদেশে সাড়া জাগিয়েছে। দুর্নীতির হোতারা তাঁকে দেখামাত্রই আতঙ্কে ভুগতে থাকে। এমন অবস্থায় তথ্য আছে শুনেই তাঁর সচিবালয়ে ছুটে যাওয়া, এখন বোঝা যাচ্ছে, উচিত হয়নি।
রোজিনা হয়তো ভেবেছিলেন: বাংলাদেশে আছে তথ্য অধিকার আইন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। তথ্য অধিকার আইনের ভূমিকায় বলা হয়েছে: যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক্স্বাধীনতা নাগরিকগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত এবং তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক্স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ; এবং যেহেতু জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক; এবং যেহেতু জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হইলে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পাইবে, দুর্নীতি হ্রাস পাইবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে; এবং যেহেতু সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল…।
রোজিনা হয়তো এসবই ভাবছিলেন। ভাবছিলেন, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণের অধিকার আছে তথ্য জানার। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক, তাঁরা মালিক নন। হয়তো তাই তিনি চলে গেছেন কর্তব্যের টানে। কোভিডের ভয় তাঁকে দমাতে পারেনি। টিকা নেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। সচিবালয় থেকে তিনি হয়তো তাঁর কর্মস্থলে ফিরতেন। তারপর যেতেন তাঁর মেয়ের কাছে। কিন্তু এখন তাঁকে তোলা হবে প্রিজন ভ্যানে। প্রিজন ভ্যানের লোহার বেড়ার ফাঁক দিয়ে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখবেন। দেখবেন, খণ্ডিত আকাশ। সেই আকাশের গায়ে লোহার চারকোনা জাল।
এটা হতে পারে? এইটা বাস্তবতা? এটা এখন আমাকে দেখতে হবে। চোখ ভিজে আসে, চোখ ভেসে যায়, মানুষের চোখ আছে, তা শুধু দেখবার জন্য নয়, তা কাঁদবারও জন্য। বৃহস্পতিবার ২০ মে সকাল ১০টায় আদালত বসার কথা। ভার্চ্যুয়াল আদালত। ১০টায় বসল না। ১১টায় বসল না। ১২টায় বসবে। তাও বসল না। শেষে বসল। রোজিনার পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীরা বক্তব্য দিলেন। বললেন, যে আরজি করা হয়েছে, যে ধারায় মামলা করা হয়েছে, একজন নারী হিসেবে, একজন রোগী হিসেবে রোজিনা অবশ্যই জামিন পাওয়ার যোগ্য।
আমার মনে পড়ছে, আগের রাতে ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম একাত্তর টেলিভিশনের আলোচনায় একই কথা বলেছিলেন। বরং তিনি বলছিলেন যে এই জামিন ১৭ মে রাতেই পুলিশ মুচলেকা নিয়ে দিয়ে দিতে পারত। বলছিলেন, তথ্য অধিকার আইন হয়ে যাওয়ার পর অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন আর কার্যকর থাকে না। শুনতে পেলাম, গত ৫০ বছরে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনে একটা মামলাও এ দেশে হয়নি। নিজের মনে নিজেকে বললাম, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই পেলাম আমরা, উপহার হিসেবে!
২০ মে মাননীয় আদালত রায় দেননি। ২৩ মে রোববার আবার আদালত বসবে। আমেরিকার সংবিধানে আছে ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট। প্রথম সংশোধনী। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণকারী কোনো আইন কংগ্রেস পাস করতে পারবে না। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মানুষের একটা মৌলিক অধিকার, যা কেড়ে নেওয়া যায় না। আমেরিকায় আইন আছে, সান শাইন ল। এর মানে হলো সরকারি অফিস-
আদালত চলবে সূর্যের আলোর নিচে। সাংবাদিকেরা অফিসের সভায় বসে থাকতে পারবেন, যেকোনো কাগজ চাইলে কর্মকর্তারা সে কাগজ তাঁকে দিতে বাধ্য। আর আমাদের দেশে তথ্য তুমি কেন পেলে, এটা নিয়ে সাংবাদিকদের লাঞ্ছনা করা হচ্ছে। এমনকি কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাও একজন নারী সাংবাদিক কাশিমপুর জেলে বিচার হওয়ার আগেই রুদ্ধ হয়ে রইলেন।
এই সূর্যগ্রহণের কালে আশা আছে। আশা হলো, সাংবাদিকদের ঐক্য, দেশের মানুষের একাত্মতা। রোজিনার নিঃশর্ত মুক্তি চাই, এই দাবি আজ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় উচ্চারিত হচ্ছে। দেশের বাইরেও প্রবাসীজন এবং সাংবাদিকেরা সমাবেশ করে দাবি উচ্চারণ করছেন। জাতিসংঘ পর্যন্ত রোজিনার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। মন্ত্রীরা পর্যন্ত বলছেন, এই ঘটনা দুঃখজনক, অনাকাঙ্ক্ষিত, এটা এড়াতে না পারা একটা ব্যর্থতা। দেশের ভাবমূর্তির কথা বলে মামলা করা হলো, প্রিজন ভ্যানে রোজিনার মুখখানি সারা পৃথিবীতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে চলেছে। আমার মায়ের মুখখানি আজ মলিন। মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি…
সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায় বলি, চোখ ভিজে আসে। চোখ ভেসে যায়। মানুষের চোখ আছে। তা শুধু দেখবার জন্য নয়, কাঁদবারও জন্য। তা শুধু কাঁদবার জন্য নয়, ক্ষোভের আগুন প্রকাশ করবারও জন্য।
জাতির পিতার এই অটোগ্রাফটার বাণী এখন নিজেকেই শোনাতে হচ্ছে, ‘সত্য ও মিথ্যার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে প্রথমে মিথ্যা জয়ী হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় সত্য’। ● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক।