সমবার, ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, সময় : ১০:৪২ pm
আজকাল পিতামাতার কাছে খুব কম সন্তান বইয়ের জন্য আবদার করে। প্রিয় লেখক, কবি কিংবা সাহিত্যিক আছে খুব কম সংখ্যকের! বাঙালির সবচেয়ে কম খরচ সাহিত্যে। অথচ বই কেনা তো খরচ নয় বরং বিনিয়োগ- এটা অনেকে মানেই না। ছেলেমেয়েদের চাহিদায় দামি স্মার্টফোন, ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটার থাকে। খেলার মাঠে যাওয়ার বদলে গোপন আসরে বসে। মাঠের গোলবারে গোল দেওয়ার বদলে গোল হয়ে বসে ইন্টারনেট গেইমে মত্ত প্রজন্ম। বদ্ধ রুমে শুয়ে-বসে গেম খেলতে খেলতে কেটে যায় প্রহর। এ যুগের ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের তেজ কম ছিল না। এসএসসি-এইচএইসসিতে রেজাল্ট ভালো, পুথিগত বিদ্যাতেও অপ্রতিরোধ্য। কেননা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বাবা-মা চোখে চোখে শাসনে রাখে। যখন বড় হয়, স্বাধীনতা পায় এবং মন্দের সঙ্গ পায় তখন পথ হারায়।
বিশাল সম্ভাবনা মুকুলেই বিনাশ হয়। মানবিকতা বোধের চরম ঘাটতি ঘটে। ভদ্রতা-সৌজন্যতা অনুপস্থিত থাকে। সামাজিকতা নাই বললেই চলে। বাবা-মায়ের আশার পিদিম নিভিয়ে অনেক সন্তান প্রবেশ করে অন্ধকারে। সমাজকে সহ্য করতে হয় ক্ষত। রাষ্ট্র বহন করে বোঝা! আধুনিকতার নামে বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে অনেকগুলো বদগুণ ধারণ করছি। পরীক্ষায় পাশের হার বৃদ্ধি করা এবং মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তোলা- দু’টো বিষয় এক ব্যাপার নয়। পাঠের অভ্যাস নাই বললেই চলে। ছেলেমেয়েরা যদি বিখ্যাত সাহিত্যকদের নামে মেসি কিংবা রোনালদোর নাম বলে তবে অবাক হওয়ার সুযোগ নাই! অনেককেই শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমকে চেনে না। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে তুখোড় ফলাফল অর্জন করে ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে আটকে যাচ্ছে। কেননা পাঠ্যবইও যে ঠিকঠাক পাঠ করা হয়নি। সাজেশনের ওপর সাজেশন করে পড়ে পরীক্ষা দিয়েও বানের জলের মত এ প্লাস পাওয়া যায়। শহর-নগরের পাঠাগারগুলো নিস্তব্ধতায় জাদুঘরের মত।
চিড়িয়াখানা ভেবেও কেউ দর্শনে আসে না। সেখানে বই আছে কিন্তু প্রাণ নাই। পাঠকের উপস্থিতি না থাকাতে ধুলোবালিতে ধূসর হয়েছে বইয়ের আবরণ। ফ্রি ফায়ারের আসর বসলেও এখন আর পাঠচক্র দেখা যায় না স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। বইয়ের বিকল্প এখন ফেসবুক। বুঝতে শিখেছে অথচ স্মার্টফোন নাই, ফেসবুক ব্যবহার করছে না এমন কাউকে খুঁজে পেতে টিম গঠন করে তালাশি দিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের মধ্যে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশের প্রথম সারির একটি বাংলাদেশে। ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহার মস্তিষ্কের সক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং ধৈর্যহারা করে। মস্তিষ্কের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা তথা জটিল সমস্যার সমাধান সক্ষমতা হ্রাস করে। মস্তিষ্কের ক্ষতির পাশাপাশি চোখের ক্ষতি তো আছেই। বই পড়ার অভ্যাসের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে ফেসবুক। ফেসবুক নেশার মত। যারে পেয়েছে তারে শেষ করেছে। শিক্ষার্থীদের দিয়ে এখন সব কাজ করানো যায় কেবল লেখাপড়া করানো ছাড়া। তারা রাজনৈতিক বড় ভাইদের উদ্দেশ্য সার্ভ করে, নেশার আসরে বসে, ইন্টারনেটে জুয়া খেলে, যাকে তাকে অসম্মান করে কিংবা একরোখা-একচোখা আচরণ করে। পড়তে বললেই বেঁধে যায় শত্রুতা।
বই যেন চোখের বিষ। মিছিল-মিটিংয়ে আছে কিন্তু লাইব্রেরিতে যাবে না। গ্রামগঞ্জেও সন্ধ্যার সাথে সাথে গড়ে ফেরে এমন ছেলের সংখ্যা হাতে গোনা। সন্তান ভালো রেজাল্ট করছে কাজেই ভালো মানুষ হবে, বড় চাকুরি পাবে- এমন আশা নিয়ে যদি অভিভাবক নজরদারি ছাড়া, ছেলেমেয়েদের খোঁজ-খবর রাখা ছাড়া বসে থাকে তবে সর্বনাশ। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় এবং বিভিন্ন সাইটের এক্সেস সুবিধায় চরিত্রের অধঃপতন ও শরীরের অবদমন ঘটছে। বই না পড়ার কুফল সমাজ বেশ ভালোভাবে টের পাচ্ছে। খেসারত ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মাত্রা সময়ের সাথে বাড়ছে। কিশোর গ্যাঙের কাছে সমাজ-সংসার, সংগঠন কিংবা গ্রাম-শহর জিম্মি। ওদের সামনে মানুষ কথা বলতে ভয় পায়। যাকে-তাকে অসম্মান করতে প্রজন্ম দ্বিতীয়বার ভাবে না। ধ্বংসের কিনারা থেকে সন্তানদের রক্ষার উপায় কী? বই পড়ার পরিবেশ উপহার দিতে হবে। সন্তান কী পড়বে সে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে পাঠাভ্যাস চাপিয়ে দিতে হবে। সন্তানের মূল্যবোধ গঠনের জন্য, সামাজিক অবক্ষয় ও অপরাধ থেকে বিরত রাখার জন্য সন্তানের হাতে মোবাইলের বদলে বই তুলে দিতে হবে।
ছেলেমেয়েরা যাতে পড়ার মাঝে আনন্দের পরিবেশ পায় সেটার নিশ্চয়তা অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রকে সম্মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে। আউটডোর-ইনডোর গেম খেলতে উৎসাহিত করতে হবে। এতে একদিকে শারীরিক কসরতে মাধ্যমে শরীর সুস্থ থাকবে, আরেকদিকে মনের বিকাশ ঘটবে।বই হোক নিত্যসঙ্গী। চলার পথে হাতে একখানা বই থাকা উচিত। বইয়ের ওজন তো আর অনেক না। পাঠের পরিবেশ পেলে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে নিলে নিজের গঠন হবে। নিজেকে আলোকিত করতে চাইলে বইয়ের কাছ থেকে আলো ধার নিতে হবে। চরিত্র গঠনে, সুখে থাকতে কিংবা শত্রুতা থেকে বাঁচতে বইয়ের বিকল্প নাই। ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে, ভালো ফলাফলে কিংবা ভালো কাজের উৎসাহে বই উপহার দিন। তবে মনে রাখতে হবে, বাবা-মা, শিক্ষক বই হাতে পড়তে না বসলে ছেলেমেয়ে, শিক্ষার্থীরা বই পাঠের প্রতি আগ্রহ পাবে না। পড়ার অভ্যাস পরিবেশ থেকে তৈরি হয়। বই পড়ুন, রুচিশীল জীবন গড়ুন। লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট