বৃহস্পতিবর, ২৬ িসেম্র ২০২৪, সময় : ০৭:১২ am
ডেস্ক রির্পোট :
ডলার সংকটে গত জুন থেকে অন্তত তিন মাস সার আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা স্থগিত ছিল। এর ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত গড়ে তুলতে না পারায় সারাদেশে সার সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। আমদানির জন্য মূল্য যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বেশ কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান সার সরবরাহ করেনি বলে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ফলে শিগগিরই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে প্রথমবারের মতো ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গ্রুপের সদস্য ইসলামিক ট্রেড ফিন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) থেকে সার আমদানির জন্য চড়া সুদে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। সম্প্রতি আইটিএফসি থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে মতামত জানতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়।
চিঠিতে বলা হয়, দেশে প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের সারের মোট চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকায় সার কারখানাগুলোর মাধ্যমে চাহিদার মাত্র ১৫ শতাংশ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। অবশিষ্ট সার সরকারি পর্যায়ে বিসিআইসি ও বিএডিসি এবং বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। সার আমদানিতে সরকারকে ভর্তুকি হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থও ব্যয় করতে হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে তারল্য ও ডলার সংকটের কারণে বিএডিসি এবং বিসিআইসির সার আমদানির জন্য এলসি খোলা বিঘ্নিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এলসি মূল্য যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ বা বিলম্বিত হওয়ায় কয়েকটি এলসির বিপরীতে বিদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সার সরবরাহ করেনি। কিছু ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ লটও বাতিল করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় এলসি খোলা হলেও মরক্কো, সৌদি আরব ও তিউনিসিয়া টিএসপি ও ডিএপি সারের পাঁচটি লটের জাহাজীকরণ বাতিল করে। পরবর্তী লটগুলোর শিপমেন্ট শিডিউল দিতে বিলম্ব করে। একইভাবে চীন ও রাশিয়াও নির্ধারিত সময়ে সার সরবরাহ করেনি। এমন অবস্থা চলমান থাকলে ভবিষ্যতে যথাসময়ে সার সরবরাহ কার্যক্রম ঝুঁকিতে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ঝুঁকি এড়াতে সার রপ্তানিকারকদের যথাসময়ে মূল্য পরিশোধের বিকল্প নেই।
কৃষি মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ১৯৯৭ সাল থেকে এবং পেট্রোবাংলা ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে আইটিএফসি থেকে ঋণ নিয়ে ডলার সংকটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বিএডিসি এবং বিসিআইসি একইভাবে সমস্যা সমাধান করতে পারে। আইটিএফসির ঋণের ডলারে তাৎক্ষণিক সার আমদানির এলসির অর্থ পরিশোধ করা হবে। এভাবে যথাসময়ে রপ্তানিকারকদের বিল পরিশোধিত হলে সার আমদানির ক্ষেত্রে শিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কা দূর হবে।
আইটিএফসির ঋণ বিষয়ে ইতোমধ্যে মতামত দিয়েছে বিএডিসি এবং বিসিআইসি। বিএডিসি জানিয়েছে, আইটিএফসিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বার্ষিক সুদহার আপাতদৃষ্টিতে ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ হলেও প্রকৃতপক্ষে ঋণের শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হলে আগাম নগদ অর্থ সংরক্ষণজনিত সুদ ও ডলারের ক্রয়মূল্য ওঠানামার কারণে ব্যয় বাড়তে পারে।
বিসিআইসি তাদের মতামতে জানিয়েছে, আইটিএফসির ঋণের সম্ভাব্য সুদহার হবে ১৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা স্থানীয় ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি। এ ঋণের সম্ভাব্য সুদহার হিসাবের মধ্যে রয়েছে সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট) ৪ দশশিক ৪৩ এবং এর সঙ্গে যোগ হবে ২ শতাংশ। এ ছাড়া ফান্ড হোল্ডিং কস্ট ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ডলারের ক্রয়মূল্য ওঠানামাজনিত ব্যয় ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সুদহার কমানোর বিষয়ে নেগোসিয়েশনের সুযোগ রয়েছে। এ ঋণ নেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে অর্থ বিভাগও।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দরকষাকষির পর সুদহারও কিছুটা কমিয়ে সোফর রেটের সঙ্গে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আইটিএফসি প্রস্তাবিত ঋণের চেয়ে কমিয়ে মাত্র শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। সারের আমদানির জন্য দেওয়া ঋণের মেয়াদ হবে ১২ মাস পর্যন্ত।
গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসেই ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের উৎপাদন, আমদানি, বিতরণ ও মজুত পরিস্থিতি নাজুক উল্লেখ করে পিক সিজনে অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে সারের চাহিদা মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করেছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। ডিসেম্বরের শুরু থেকে দেশব্যাপী দেখা দেয় সার সংকট। এতে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় এ উপকরণ। প্রায় সব জেলাতেই ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার বেশি দামে বিক্রির তথ্য মিলছে।
কৃষি সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, বাফার মজুত আগের চেয়ে কিছুটা কম থাকলেও বর্তমানে সারের কোনো সংকট নেই। সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু সমস্যা হওয়ায় কৃষক পর্যায়ে পৌঁছতে সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। তবে সার নিয়ে যাতে কেউ ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সে জন্য মাঠ পর্যায়ে কঠোর নজরদারি চলছে।
আইটিএফসি থেকে ঋণ নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামীতে সার আমদানিতে ডলারের সংকট কাটাতেই এ ঋণ নেওয়া হচ্ছে। ঋণের বিষয়টি এখনও নেগোসিয়েশন পর্যায়ে। বাংলাদেশের চাওয়ার ভিত্তিতে আইটিএফসি ঋণের মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর করেছে। এখন সুদহারসহ অন্যান্য বিষয় অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সমন্বিত সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত করা হবে।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, সংগত কারণেই বর্তমানে সার সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে। তাই বেশি সুদে ঋণ নিয়ে হোক আর অন্য যে কোনো উপায়ই হোক; চলতি মৌসুমে সরকারকে সার সরবরাহ স্বাভাবিক করতে হবে। কারণ জানুয়ারি থেকে ব্যাপক পরিমাণে ইউরিয়া সারের চাহিদা থাকবে। সময়মতো যদি বিদেশ থেকে সার না আসে, তবে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সংকট আরও তীব্র হবে। সারের সংকট হলে কৃষি উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। রা/অ