বৃহস্পতিবর, ১২ িসেম্র ২০২৪, সময় : ১১:১০ am
ডেস্ক রির্পোট :
ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় সারা দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ২৮ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলা দায়েরের চার মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত কোনোটিরই তদন্ত শেষ করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তারা। শুধু এই মামলাগুলোই নয়, দীর্ঘ সময় ধরে কয়েক হাজার মামলার তদন্ত ঝুলে থাকলেও তা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এতে তদন্ত কর্মকর্তাদের ওপর তদন্তাধীন মামলার চাপ বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য মিলেছে।
আরও জানা গেছে, শুধু গত নভেম্বর মাসেই বিশেষায়িত দুটি তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) অন্তত ২৮ হাজার মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশসহ বিভিন্ন মেট্রোপলিটন ও রেঞ্জে আরও কয়েক হাজার মামলা তদন্তাধীন। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুরোনো এসব মামলার তদন্তের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় দায়ের গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোও একই তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে হচ্ছে। এজন্য দীর্ঘ সময় পার হলেও এসব মামলার তদন্ত কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর কালবেলাকে জানিয়েছেন, অকারণে যাতে মামলার তদন্ত থেমে না থাকে, সে বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে। তা ছাড়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে দায়ের প্রায় ২ হাজার ৩৫০টি মামলা গুরুত্বসহকারে তদন্ত চলছে।
তদন্ত সংস্থাগুলোর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একজন তদন্ত কর্মকর্তার ঘাড়ে মাসে গড়ে ২১টি মামলার তদন্ত দায়িত্ব থাকছে। এতে তদন্ত নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্মকর্তাকে। সাধারণত পুলিশের উপপরিদর্শকরা (এসআই) মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলা বা আদালতের নির্দেশে কোনো কোনো মামলা পরিদর্শক, এএসপি, অ্যাডিশনাল এসপি বা এসপি মর্যাদার কর্মকর্তারা তদন্ত করে থাকেন।
দীর্ঘদিন ধরে যেসব মামলার তদন্ত আটকে রয়েছে, সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অকারণে যাতে তদন্ত মুলতবি বা আটকে না থাকে, সে নির্দেশনাও এসেছে তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর প্রতিটি থানাসহ পুলিশের সব ইউনিটে বড় পরিবর্তন আসে। তদন্ত কর্মকর্তাদের বদলিজনিত কারণে প্রায় সব মামলাতেই নতুন তদন্ত কর্মকর্তা এসেছেন। নানা কারণে কর্মকর্তাদের সংখ্যা কম হওয়ায় একেকজনের কাছে অতিরিক্ত মামলার তদন্ত দায়িত্ব পড়ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, পুরোনো মামলায় আগে তদন্ত হলেও নতুন তদন্ত কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও ঠিকঠাক বুঝে পাননি। নতুন এলাকায় দায়িত্ব নিয়ে এলেও তদন্ত কর্মকর্তারা পুরোনো অনেক তথ্যও খুঁজে পাচ্ছেন না। এসব কারণে পুরোনো মামলার তদন্ত নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এতে মামলার তদন্ত জটের সৃষ্টি হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে পুলিশের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল। শুরুর দিকে রীতিমতো হযবরল অবস্থায় ছিল পুরো বাহিনী। থানাগুলোতেও ঠিকঠাক বসা যায়নি। আতঙ্কে পুলিশও সক্রিয় ছিল না। এর একটা বড় ধাক্কা পড়েছে তদন্ত কার্যক্রমে। এরপর পুলিশ সক্রিয় হওয়া শুরু হলেও নানা ধরনের আন্দোলনে জননিরাপত্তা কার্যক্রমে বেশি সময় দেওয়াতেও তদন্ত কার্যক্রমে মনোযোগী হওয়া যায়নি। এখন পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এতে তদন্তেও সময় দিতে পারছেন কর্মকর্তারা।
পিবিআইতে তদন্তাধীন সাড়ে ১৪ হাজার মামলা: পিবিআই সূত্র জানায়, গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত সংস্থাটির মোট ১৪ হাজার ৬৮৪টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এর মধ্যে থানায় করা (জিআর) মামলার মধ্যে ৩ হাজার ৪২২টি এবং আদালতে দায়ের (সিআর) মামলাগুলোর মধ্যে ১১ হাজার ২৬২টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। পিবিআই ওই মাসে ৩৩২টি জিআর এবং প্রায় সাড়ে তিন হাজার সিআর মামলার তদন্ত শেষ করেছে।
পিবিআইর একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, তদন্তাধীন মামলাগুলোর মধ্যে দুই মাস থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে তদন্ত চলছে—এমন মামলাও রয়েছে। এর মধ্যে দুই মাসের কম সময় ধরে তদন্ত চলছে—এমন মামলা রয়েছে ১ হাজার ৮০৪টি; তিন মাসের বেশি সময় ধরে তদন্ত চলছে—এমন মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৮৩৬টি; ৬ মাসের বেশি সময় ধরে তদন্ত চলছে ৭৫৮টি এবং এক বছরের বেশি সময় ধরে ১ হাজার ১৮১টি মামলার তদন্ত চলছে।
পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) মো. মোস্তফা কামাল কালবেলাকে বলেন, পিবিআইতে তদন্ত কর্মকর্তার ঘাটতি রয়েছে। মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকায় তদন্তের দায়িত্বও বেড়ে চলেছে। আস্থার কারণে বাদীর আবেদন বা আদালত থেকেও মামলা তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ কারণে একজন তদন্ত কর্মকর্তার কাঁধে অনেক মামলার দায়িত্ব থাকে। সেক্ষেত্রে মানসম্পন্ন তদন্তের জন্য সময় লাগছে বেশি।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর পিবিআই থেকে অনেক কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন। নতুন যারা আসছেন, তাদের তদন্ত কার্যক্রম বুঝে উঠতে সময় লাগছে। তা ছাড়া মানসম্পন্ন তদন্তের কারণে চাইলেও দ্রুততম সময়ে তদন্ত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।
সিআইডিতে তদন্তাধীন সাড়ে ১২ হাজার মামলা: গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিআইডিতে তদন্তাধীন মামলার পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ওই মাসে সংস্থাটিতে ১২ হাজার ৫১৫টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এর মধ্যে জিআর মামলা রয়েছে ৩ হাজার ৬৪৪টি এবং সিআর মামলা ৮ হাজার ৮৭১টি। ওই মাসে তদন্তাধীন জিআর মামলাগুলোর মধ্যে ১৮৪টিতে আদালতে অভিযোগপত্র ও ৫৪ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তারা। পাশাপাশি ৫৬২টি সিআর মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও ওই মাসে ৩১৩টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. মতিউর রহমান শেখ কালবেলাকে বলেন, জুলাই-আগস্ট ঘটনার পর কর্মকর্তাদের বদলিজনিত কারণে মামলার তদন্ত কার্যক্রম ঢিলে হয়ে গিয়েছিল। সে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি নিজেই তদন্তাধীন মামলাগুলো নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, সব সময়েই চেষ্টা থাকে মামলার তদন্ত নিষ্পত্তি যাতে যথাসময়ে হয়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর যেন অযথা কোনো মামলার তদন্ত থেমে না থাকে, সে দিকে নজর দিয়েছেন।
এক বছর ধরে ৬ হাজার মামলার তদন্ত ‘ফাইলবন্দি’: পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, ৫ বছরের বেশি সময় ধরে ৪০৪টি মামলার তদন্ত মুলতবি অবস্থায় রয়েছে। সিআইডি বিশেষজ্ঞ মতামত, আদালতের আদেশ, নির্বাহী আদেশ, মেডিকেল প্রতিবেদন না পাওয়া এর অন্যতম কারণ। তিন বছর ধরে তদন্ত মুলতবি রয়েছে—এমন মামলার সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। পাশাপাশি এক বছর ধরে মামলার তদন্ত মুলতবি রয়েছে ৬ হাজার ৪৬টি। মূলত এসব মামলার তদন্ত ফাইলবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তদন্ত ‘ফাইলবন্দি’ ৬ হাজারের বেশি মামলার মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়ার কারণে ৫৪টি, ভিসেরা রিপোর্টের অপেক্ষায় ১৭টি এবং ডিএনএ রিপোর্টের অপেক্ষায় ৯০০টি মামলার তদন্ত থেমে আছে। এর মধ্যে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে ১০৯টি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৭৯১ মামলার ডিএনএ রিপোর্ট না পাওয়ায় তদন্ত আটকে গেছে। এ ছাড়া রাসায়নিক পরীক্ষার মতামতের অপেক্ষায় ৩১টি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ব্যালাস্টিকস ও ডিজিটাল ফরেনসিক প্রতিবেদন না পাওয়ায় আটকে রয়েছে ১১৭টি মামলার তদন্ত এবং আদালতের আদেশে স্থগিত ১৯৪টি মামলার তদন্ত আটকে আছে। রা/অ