বুধবা, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৪:৩৪ am
ডেস্ক রির্পোট :
কর্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না দেশের প্রচলিত শিক্ষা। এজন্য দিন দিন শিক্ষিত ও তরুণ বেকারের চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার আশঙ্কাজনক। ফলে সম্ভাবনাময় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে হতাশা এবং দেশ বঞ্চিত হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনমিতির সুবিধা থেকে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) বিভিন্ন সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিত তরুণরা বেকার থাকায় রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি সম্পদের অপচয় হচ্ছে। ফলে দক্ষতা বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার মান বাড়িয়ে বাস্তব কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করার এখনই সময়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষিত ও তরুণ বেকার বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক। কেননা যারা শিক্ষিত তারা যে কোনো কাজ করতে পারেন না। তারা চান প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা সোভন কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থানই অপ্রাতিষ্ঠানিক। এখানে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা কম। ফলে তারা বেকার থাকছেন।
দেশের শিক্ষাকর্মের বাজারের চাহিদা উপযোগী নয়। ফলে এখানে একটা মিস ম্যাচ আছে। কিন্তু শিক্ষার হার বাড়ছে, ফলে শিক্ষিত বেকার বাড়তেই থাকবে। এজন্য শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করা দরকার। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যারা শিক্ষা গ্রহণ করছে তারা তো ব্যক্তিগতভাবে অনেক খরচ করছে। আবার তাদের পেছনে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ আছে। যখন এসব শিক্ষার্থী বেকার থাকছে তখন উভয় বিনিয়োগই অপচয় হচ্ছে।
চলতি বছরের ২৪ মার্চ প্রকাশিত বিআইডিএস’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা এ দেশে যে শিক্ষা দেওয়া হয় সেগুলো বাস্তবতা কিংবা কর্মের সঙ্গে সংযোগ নেই। শিক্ষিত বেকার সংখ্যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার তিন বছর পরও শিক্ষার্থীদের ২৮ শতাংশ বেকার থাকছেন।
বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং বাংলার মতো বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। এদিকে যুবকদের মধ্যে ৮ শতাংশ বেকার, যা জাতীয় বেকারত্ব হারের দ্বিগুণ। এদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। তাই বলা যায় উচ্চশিক্ষা চাকরির মানদণ্ড নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বেকার বেশি থাকার কারণ হলো, কারিকুলামে দক্ষতার অভাব, ইংরেজির ঘাটতি ইত্যাদি।
জানতে চাইলে বিআইডিএস’র গবেষণা ফেলো ড. বদরুন নেসা আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিবিএস বলছে দেশের বেকার রয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। এই মোট বেকারের মধ্যে আবার শিক্ষিত বেকার ১২ শতাংশ। এই সংখ্যাটি কম নয়। আমরা গবেষণা করেছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর। সেখানেও শিক্ষিত বেকার থাকার চিত্র উঠে এসেছে। এটা অবশ্যই দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। কেননা যারা শিক্ষা শেষ করেও ৫, ৬, ৭ বছর চাকরি বা কোনো কাজ পাবেন না, তারা কী করবেন?
চুরি, ডাকাতি ছিনতাইসহ নানা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। নারী হলে বিয়ে দিয়ে অন্যের আয়ের ওপর চলতে পারেন। কিন্তু পুরুষের জন্য এটা খারাপ অবস্থা। পাশাপাশি হতাশায় ডুবে অনেক সময় নেশায় আসক্তিসহ আত্মহত্যার প্রবণতার সৃষ্টি হতে পারে। যেটি এখন লক্ষ করা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এসএম আমানুল্লাহ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের কারিকুলাম কারিগরি শিক্ষা বা কর্মমুখী শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ফলে এখান থেকে লেখাপড়া শেষ করে অনেকেই বেকার থাকেন। তবে আমরা এখন কারিকুলাম পরিবর্তনের কাজ করছি। অর্থাৎ অনার্স মাস্টার্সের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক কারিগরি শিক্ষার ওপর একটি সাবজেক্ট পড়তে হবে। এছাড়া ইংরেজিতে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিসহ শিক্ষার্থীদের দক্ষতা এবং শিক্ষার মান বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর প্রভাব বা ফলাফল শিগগিরই পড়তে শুরু করবে।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে এর হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, সেটি বেড়ে ২০২২ সালে হয়েছে ১২ শতাংশ। এই ৫ বছরে স্নাতক পাশ করা বেকারের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৭ সালের হিসাবে এ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ, ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ লাখে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে (তরুণ জনগোষ্ঠীর আধিক্য) আছে। এটি সাময়িকভাবে এখনো চলছে। আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে এটি শেষ হয়ে যাবে। তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে এ সময়ের মধ্যে ব্যবহার করা না গেলে পরে এই সুযোগ আর আসবে না। শিক্ষিত তরুণরা বেকার থাকার ফলে নিজের জন্য কিছু আয় করতে পারছে না। পাশাপাশি রাষ্ট্রের জন্যও কিছু দিতে পারছে না। দুই ক্ষেত্রেই কোনো ফল আসছে না। ফলে এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সুযোগের অপচয় ঘটছে। এছাড়া শিক্ষিত ও তরুণ বেকাররা সামাজিকভাবে ঝুঁকি তৈরি করছে। কেননা তারা যে স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে বাস্তব জীবনে কর্মের বাজারে তার কোনো চাহিদা নেই। ফলে হতাশা সৃষ্টিসহ নানা অসামাজিক কাজে তাদের ব্যবহার করা সহজ হয়। আবার তারা নিজেরাও সময় ও হতাশা কাটানোর জন্য নেশাসহ বিভিন্ন রকম অন্যায় কাজে যুক্ত হতে পারেন।
কুড়িগ্রাম জেলা সদরের বেলগছা ইউনিয়নের মো. করিমুল্লাহ (ছদ্মনাম) ৪ বছর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করেছেন। রেজাল্ট ভালোই ছিল। কিন্তু প্রথমদিকে এনজিও এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ পেলেও যোগ দেননি। তার প্রত্যাশা ছিল একটি সরকারি চাকরি। অনেক চেষ্টা করেও লিখিত পরীক্ষা পর্যন্ত উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এখন সরকারি চাকরির বয়স শেষ। এনজিওসহ যে কোনো একটি বেসরকারি চাকরিও খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে বেকার অবস্থায় হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে নিজেদের জমিতে বাবাকে সহায়তা করছি। ছোট কোনো চাকরি পেলেও করতাম। কিন্তু অনেক চেষ্টা করছি, পাচ্ছি না। এদিকে বিয়ের বয়সও পেরিয়ে যাচ্ছে। বেকার বলে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মির্জ্জা মো. নাসির উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেশি। এজন্য বেকারের সংখ্যাও বেশি মনে হয়। তবে এখন আগের পরিস্থিতি পালটে যাচ্ছে। কেননা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় লেখা পড়া করেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক শিক্ষার্থী বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করছেন। সেই সঙ্গে নতুন নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হচ্ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কর্মে নিয়োজিত জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ অর্থাৎ ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ বেসরকারি বা যৌথ উদ্যোগের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এরপর ২০ দশমিক ৭ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ খানাভিত্তিক (পরিবার) প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত। শুধু ৫ দশমিক ৫ শতাংশ কর্মচারী সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এদিকে খানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অর্থাৎ ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ মহিলা। এরপর যৌথ উদ্যোগ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ২৯ দশমিক ২ শতাংশ মহিলা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ মহিলা। তবে সবচেয়ে বেশি পুরুষ কাজ করেন বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছেন ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং খানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মহিলা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ৫৭টি (২০২১ সাল পর্যন্ত ৫০টি) সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ২০২১ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ছিল ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৬।
করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থী কমে গেছে। তবে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন করছেন প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন প্রায় ৩ লাখ ৪২ হাজার জন। এর মধ্যে ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যয়ন করছেন ১ লাখ ২৯ হাজার শিক্ষার্থী। এসব সরকারি-বেসরকারি, অধিভুক্ত, অঙ্গীভূত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে বের হয়। কিন্তু তাদের সেই শিক্ষা কতটা বাস্তব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ্দ আবদুল ফায়েজ যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে সেই তুলনায় তো কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সেখানে যারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে তারাই চাকরিতে প্রবেশ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যারা শিক্ষিত তারা কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু করেই থাকে। একেবারেই বেকার বসে থাকে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এত কলেজ যে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা করাটাও কঠিন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা প্রশাসনে আছেন তাদের জন্য সমস্যাই হয়ে যায়। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক মানহীন কলেজেও অনার্স খোলা হয়েছে। এর প্রভাবও হতে পারে। পাশাপাশি বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের বেতন এত কম দেওয়া হয় যে এতে মানসম্মত শিক্ষকদের আকৃষ্ট করা যায় না। আবার যারা আছেন তাদেরও মান বৃদ্ধির উদ্যোগ কম। একাধিক শিল্প উদ্যোক্তা যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের দুর্বলতা থাকে। সেক্ষেত্রে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ করি। এছাড়া শুধু শিক্ষা দিয়ে তো হবে না। আমাদের দরকার টেকনিক্যালভাবে শিক্ষিত জনশক্তি। এখনো আমরা কাজর যোগ্য লোক খুঁজে পাই না। সূত্র : যুগান্তর