রবিবর, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৯:৩৯ am
জনশ্রুতি আছে রাষ্ট্রপরিচালনায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকার গুরুত্বহীনতার বিষয়ে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ নাকি একবার বলেছিলেন, “মিলাদ ও কবর জিয়ারত ছাড়া তাঁর কোনও কাজ নেই।” বস্তুত, ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তনের পর সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ে এবং সরকার পরিচালনার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার ওপর ন্যস্ত হয়। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোয় রাষ্ট্রপতি পদটি মূলত আলংকারিক বা প্রতীকী গুরুত্ব বহনে করে। তবে লক্ষণীয়, সংসদীয় পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তনের পর অন্তত দুবার রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি ও ভূমিকা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক প্রমাণিত হয়েছে।
প্রথমত, ২০০৬-২০০৮ সময়কালীন রাজনৈতিক সংকটে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এবং সম্প্রতি, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন একই ধরনের ভূমিকা পালন করছেন, যা রাষ্ট্রপরিচালনায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে। এ প্রবন্ধে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বলতে আমি বুঝিয়েছি, কোনও রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বহাল থাকাবস্থায় সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে স্থগিত বা বাতিল না হওয়া এবং বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
সংসদীয় পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি পদের বিশেষ গুরুত্ব ২০০৬ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ কেন্দ্র করে উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকটে প্রথমবার পরিলক্ষিত হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত বিধানাবলি ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উক্ত সংশোধনীতে প্রাথমিকভাবে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের বিধান রাখা হয়, তবে তাকে পাওয়া না গেলে আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে ক্রমানুসারে কাউকে এবং তাও সম্ভব না হলে রাষ্ট্রপতি নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করবেন মর্মে বিধান করা হয়।
২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের তীব্র বিরোধিতার কারণে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে. এম. হাসান প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের কার্যভার গ্রহণ করেন। তবে দেশজুড়ে অস্থিরতা এবং সঠিক ভোটার তালিকা প্রণয়ন নিয়ে বিতর্কের ফলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন জরুরি অবস্থা জারি করেন ও প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা, তথাপি ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার প্রায় দুই বছর পর, অর্থাৎ ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন আয়োজন করে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ৩২ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।
সম্প্রতি ৫ আগস্ট ২০২৪-এ গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর উদ্ভূত শাসনতান্ত্রিক সংকটে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা পুনরায় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্যান্য উপদেষ্টাকে শপথবাক্য পাঠ করান, যার মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। অধিকন্তু, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং অ্যাটর্নি জেনারেল এ. এম. আমিন উদ্দিন পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি নতুন প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগের মাধ্যমে বিচার বিভাগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকসহ সব সাংবিধানিক পদ, স্বায়ত্তশাসিত বা আইনগত সংস্থা, কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠান, এবং সরকারের উচ্চপদসমূহে নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান ক্রান্তিকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেহেতু রাষ্ট্রের সব নির্বাহী কার্যক্রম, চুক্তি ও দলিল প্রণয়ন রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়, তাই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে রাষ্ট্রপতিকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা করা কার্যত অসম্ভব। লক্ষণীয়, ২০০৬-২০০৮ সালের রাজনৈতিক সংকটকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের ভূমিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর ভূমিকা আশানুরূপ ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী ক্রান্তিকালেও রাষ্ট্রপতির ভূমিকায় জনমতের প্রতিফলন অলক্ষণীয় নয়।
পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশের অতীত সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সংবিধান একবার স্থগিত বা বাতিল হলে সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করা একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। তবে ১৯৯০-১৯৯১ এবং ২০০৬-২০০৮ সময়কালীন রাজনৈতিক সংকটের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, উক্ত সময়ে সংবিধান পুরোদস্তুর স্থগিত বা বাতিল না করেও নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল। আর এসব প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখার জন্য রাষ্ট্রপতি পদটি ক্রমশ ক্রান্তিকালীন সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকে পরিণত হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, যখন কোনও অন্তর্র্বতীকালীন সরকার জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের অবর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়োজিত হয়েছে, তখন একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির নামে গৃহীত সরকারি কার্যক্রম সবার কাছে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
এ বিষয়টিকে গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের আস্থা ও অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এ কথা বলা অসমীচীন হবে না যে দেশের সাংবিধানিক কাঠামোতে রাষ্ট্রপতির পদকে আরও শক্তিশালী করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। বর্তমানে অনেকেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা একটি সুদূরপ্রসারী প্রস্তাব, যার জন্য দেশব্যাপী সর্বস্তরে আলোচনা ও মতবিনিময় প্রয়োজন। এখানে আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই, দলীয় মনোনয়নমুক্ত ও সর্বজনীন ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়টি সর্বপ্রথমে বিবেচনা করা যুক্তিসঙ্গত হবে। এর ফলে একজন রাষ্ট্রপতি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠতে পারবেন। আশা করি ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।