সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:০৫ am
এম এম মামুন :
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার আত্রাই অগ্রণী ডিগ্রি কলেজের জমি নিজের দুই ছেলের নামে লিখে দিয়েছেন অধ্যক্ষ আরসুজ্জামান মালেক। এ ছাড়া অধ্যক্ষ আরসুজ্জামান মালেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে সরকারি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অধ্যক্ষ আরসুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে কলেজের সহকারী অধ্যাপক নাজমুল হক দেওয়ান রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগের পর তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। এদিকে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে সম্প্রতি অধ্যক্ষ আরসুজ্জামান মালেক একটি মামলার আসামি হয়েছেন। গত ২ সেপ্টেম্বর মোহনপুর গ্রামে র নাহিদ পারভেজ নামের এক ব্যক্তি এই মামলা করেন। মামলার আসামি হওয়ার পর থেকে অধ্যক্ষ গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি।
কলেজের সহকারী অধ্যাপক নাজমুল হক দেওয়ান গত ২০ আগস্ট জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। গত ২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার বিষয়টি তদন্তের জন্য জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার শাহীন মিয়াকে দায়িত্ব দেন। প্রায় ২৭ বছর ধরে কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে আরসুজ্জামান মালেক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কলেজের জমি দুই ছেলের নামে লিখে দেওয়া ছাড়াও আরও বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তসলিম উদ্দিন ও শামিমা আকতার নামের কেউ কলেজে কখনো চাকরি করেননি। অথচ এ দুজনকে প্রভাষক নিয়োগ দেখিয়ে তাঁদের নামে আসা বেতন-ভাতা তুলে আত্মসাৎ করেছেন অধ্যক্ষ। তিনি একই ইনডেক্সে অবৈধভাবে একাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন তুলেছেন। অভিযোগপত্রে প্রমাণ হিসেবে এমপিও কপি সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, এমপিও কপিতে অধ্যক্ষ অবৈধভাবে শিক্ষক-কর্মচারীদের বিষয় পরিবর্তন করে প্যাটার্নবহির্ভুত নিয়োগ দিয়ে অনেক টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অধ্যক্ষ তার ছেলে মাহমুদুজ্জামানকে নিয়োগ দিয়েছেন এ কলেজের শিক্ষক হিসেবে। অভিযোগে বলা হয়, মাহমুদুজ্জামান সমাজ বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু তাঁকে কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর তিনি বেতন-ভাতা তুলছেন ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ের শিক্ষক হিসেবে। অধ্যক্ষের ছেলের নিয়োগের পুরোটিই ঘাপলা।
অভিযোগে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ আরসুজ্জামানের জন্ম তারিখ দুটি। প্রথম জন্ম তারিখ অনুযায়ী ২০২০ সালেই তার অবসরে যাওয়ার কথা। কিন্তু বেশি দিন চাকরিতে থাকতে তিনি দুটি জন্ম তারিখ করেন। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক পরপর দুই মেয়াদের বেশি গভর্নিং বডিতে শিক্ষক প্রতিনিধি থাকতে পারবেন না। কিন্তু অধ্যক্ষ তার অনুগত সহকারী অধ্যাপক রহিমা খাতুনকে ২০১২ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে রাখেন। শিক্ষক-কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য অধ্যক্ষ অর্থ বাণিজ্য করেছেন বলেও অভিযোগে বলা হয়েছে।
অভিযোগপত্রের সঙ্গে জমি বিক্রির দলিল এবং নিরীক্ষা আপত্তির কাগজপত্রও সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ২০০০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ছেলে এম মাহমদুজ্জামান সুমন ও এম মাহবুবুজ্জামান জয়ের নামে কলেজের শূন্য দশমিক ৭৪ শতক জমি দলিল করে দিয়েছেন অধ্যক্ষ আরসুজ্জামান। বিক্রয় কবলা দলিলে জমির মূল্য ধরা হয়েছে দেড় লাখ টাকা। শিক্ষকদের অভিযোগ, নামমাত্র মূল্য দেখিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকার এ জমি ছেলেদের নামে লিখে দেন অধ্যক্ষ। দলিল করার সময় অধ্যক্ষের এক ছেলে নাবালক ছিল বলেও শিক্ষকদের অভিযোগ।
কলেজটিতে ২০১৪ সালের ২ মার্চ নিরীক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। পরে উপপরিচালক দেবদুলাল ভট্টাচার্যের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৭টি দলিলে কলেজের মোট জমির পরিমাণ দাবি করা হয় ২ দশমিক ৭৮ একর। কিন্তু নিরীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্র তিনটি দলিলে জমির পরিমাণ ১ দশমিক ২৫ একর। প্রতিষ্ঠানের জমি বিক্রি করতে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু কোনো অনুমোদন নেননি অধ্যক্ষ। তিনি গভর্নিং বডির ওপর দায় চাপিয়ে বিষয়টি এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। সরকারি বিধিবিধান প্রতিপালন না করার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় ওই প্রতিবেদনে। তারপরও এত দিন বহাল ছিলেন অধ্যক্ষ।
অভিযোগকারী শিক্ষক নাজমুল হক দেওয়ান বলেন, ‘স্থানীয় বিদ্যানুরাগী মানুষ কলেজকে জমি দান করেছিলেন। সে জমি ছেলেদের নামে লিখে দিয়েছেন অধ্যক্ষ। চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে ছেলেকে চাকরিও দেন। তার অনিয়মের শেষ নেই। আমরা অধ্যক্ষের সব অপকর্মের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।’ অধ্যক্ষ আরসাজ্জুমানের আত্মগোপনে থাকায় অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্যে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অধ্যক্ষের অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার শাহিন মিয়া বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন। অভিযোগকারী এবং অধ্যক্ষকে আগামী বুধবার ডাকা হয়েছে। তিনি না এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আয়শা সিদ্দিকা বলেন, গত ২৫ আগস্ট কয়েকজন শিক্ষক এসে অধ্যক্ষের পদত্যাগের পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন। তবে অধ্যক্ষ নিজে এসে পদত্যাগ পত্র জমা দেননি। এখন পর্যন্ত কাউকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আগামি ২৫ সেপ্টেম্বরের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রা/অ