শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:১৯ pm
নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজশাহীতে ছাত্র পরিচয়ে এসে দুই নারীকে প্রকাশ্যে রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে শুক্রবার দিবাগত রাতে নগরের চন্দ্রিমা থানায় একটি মামলা হয়েছে। এর আগে গত বুধবার (২৮ আগস্ট) সকালে নগরের আসামকলোনী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী পরিবার বলছে, স্থানীয় একটি পরিবারের সদস্য হয়ে ছাত্র আন্দোলনকারীদের পরিচয়ে আসা একদল ছাত্র তাদের মারধর করে। ছাত্র পরিচয়ে যারা এসেছিল তারা গায়ে সবুজ রঙের কোটি পরেছিল। পরে মারধরের বিষয়টি মীমাংসা করার অজুহাতে দুই দিন থানায় মামলা করতে দেওয়া হয়নি। মীমাংসা না হলে শুক্রবার রাতে থানায় মামলা করা হয়।
মামলার বাদীর নাম রফিকুল ইসলাম। এজাহারে তার স্ত্রী আকলিমা খাতুন ওরফে শাপলা (৩২) ও তার ছোট ভাই মিজানুর রহমানের স্ত্রী শারমিন আক্তারকে (৩১) বিদ্যুতের খুটির সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করার অভিযোগ করা হয়েছে। মামলায় আসামি হিসেবে আসামকলোনীর বাসিন্দা শাহিন, তার স্ত্রী সাহিদা বেগম (৪২), মেয়ে স্নেহা (১৬) ও মনিরের মেয়ে মুক্তার (৩৫) নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর ছাত্র পরিচয়ে যারা এসেছিলেন তাদের নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাতনামা লেখা হয়েছে।
রফিকুল ইসলামের পরিবার মূলত ফরিদপুরের বাসিন্দা। গত ৪০ বছর ধরে ব্যবসায়িক সূত্রে তাদের পরিবার রাজশাহীতে রয়েছেন। নগরের আসামকলোনীতে তারা একটি বাসার একাংশ কিনে নিয়ে ও একাংশ ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। এই বাসার মূল মালিক স্বপন হাসান (৩২)। এই বাড়িতে হামলা করে দরজা-জানালা ভাঙচুর ওই দুই নারীকে বাইরে নিয়ে গিয়ে খুুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। আকলিমা ও শারমিনকে বাঁচাতে গেলে বাড়ির মূল মালিক স্বপন হাসানের ভাবী সোনিয়া খাতুনকেও (২৮) মারধর করা হয়। মামলার এজাহারে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটের অভিযোগও করা হয়।
ঘটনার পর বাড়ির মালিক স্বপন হাসান জানিয়েছিলেন, তারা মামলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু দুই ছাত্র ফোন করে ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত মীমাংসা করে দেওয়ার সময় নিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় তারা এসে সব শুনে বলেছিলেন, হামলাকারীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকারীদের কেউ নন। তারা এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন।
এরপর রাতে তারা থানায় মামলা করতে যান। থানায় ভুক্তভোগী শারমিন, তার জা আকলিমা ও স্বপন হাসানের ভাবি তাদের নির্যাতনের বর্ণনা দেন। শারমিন বলেন, প্রতিবেশী শাহিনের অটোরিকশার গ্যারেজের শব্দদূষণ নিয়ে তার সঙ্গে ঘটনার দিন সকালে একটা ঝামেলা হয়। তারপর তারা ওই ছাত্রদের নিয়ে এসে তাদের বাড়িতে হামলা চালায়।
শারমিন বলেন, ‘এই ছাত্ররা এসে আমাদের বাইরে যেতে বলে। বলে, “ক্ষমতায় এখন আমরা।” ভয়ে আমি আমার জাকে মানুষ ডাকতে বলেছি। শুনে ওরা বলল, “মানুষ ডাইকি কী করবে, শেখ হাসিনাকেই আমরা গদি থেকে নামাইছি। তোর জা মানুষ ডাইকে কী করবে। ছাত্রদের কিছু করতে পারবে? তোর কোন বাপ আছে নিয়ে আয়।” আমি বললাম তোমরা না ছাত্র। আমি তোমাদের মায়ের মতো। তখন ধমক দিয়ে বলল, “এই চুপ!” সানিয়া ভাবী (বাড়িওয়ালার ভাইয়ের স্ত্রী) ওদের অনুরোধ করে বললেন, “তোমরা একটু থামো বাবা, ওরা বাচ্চাদের একটু খাওয়াচ্ছে।” ওরা বলল, “খাওয়াচ্ছে? এক মিনিট সময় দিলাম। এক মিনিটের মধ্যে বের না হলে আমরা ভাঙচুর করব। ওদের মারধর করব।” তখন আমরা ভাবিকে বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। ওরা ভাবিকে মাটিতে ফেলে নির্যাতন করে। এক মিনিট পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা ভেঙে আমাদের দুই জাকে টেনে হেঁচড়ে বাইরে বের করে বিদ্যুতের খাম্বার সঙ্গে বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগল।
তিনি বলেন, স্নেহা এসে দুই গালে দুইটা থাপ্পড় দিল। স্নেহার মা হাতে তালি দিতে লাগল। মারের দৃশ্য ভিডিও করতে করতে বলল, নেটে ছেড়ে দিব। ছাত্রদের দলে একজন মেয়ে ছিল। মেয়েটি দূর থেকে এসে আমার পেটের ওপরে জোরে লাথি মারল। আমার তিনটা বাচ্চা অপারেশন করে হয়েছে। সেই পেটে লাথি মারল, বলেই শারমনি কাঁদতে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, এরপর খবর পেয়ে সেনাবাহিনী এলে ওরা পালিয়ে যায়।’
স্বপন হাসান জানান, সেই দিনও থানায় মামলা করার সময় ওলিউল্লাহ নামের এক ছাত্র পরিচয় দিয়ে আবার মীমাংসা করে দেওয়ার কথা বলে মামলা না করার জন্য অনুরোধ করেন। তার কথা মতো সেই রাতে রফিকুল ইসলাম বাদী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে তারা চলে আসেন।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর ওলিউজ্জামান হামলাকারীদের দুইজনকে নিয়ে আসামকলোনীর ওই বাসায় আসেন। এ সময় হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া এক ছাত্রের সঙ্গে বাসার ভেতরে প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, তাদের ভুল বুঝিয়ে ডেকে আনা হয়েছিল। তিনি স্বীকার করেন যে, তাদের ভুল হয়েছে। সেই সময় মহল্লার উত্তেজিত লোকজন বাসা ঘেরাও করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে রাত নয়টার দিকে ছাত্রদের কৌশলে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ সময় ওয়ালিউল্লাহ একটি সাদা কাগজে লিখে যান, ‘কেউ যদি বাড়ির ক্ষতিপূরণ না দেয়, আমি ওয়ালিউল্লাহ নিজেই দিব।’ তারা চলে যাওয়ার পরে রাতে ছাত্র পরিচয়ে আরও দুইজন সেখানে যান। তারা সব শুনে মামলা করার অনুমতি দেন। রাতেই মামলা রেকর্ড করা হয়। তবে শনিবার (৩১ আগস্ট) সকালে ওয়ালিউল্লার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইসমাইল হোসেন মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ছাত্র পরিচয়ে আসা হামলাকারীদের এজাহারে নাম না থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছাত্রদের ওরা তো পরিচয় পায়নি। তাই অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে রাখা হয়েছে। পরে খোঁজখবর নিয়ে তাদের শনাক্ত করা হবে। যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। রা/অ