শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:৩৭ am
ডেস্ক রির্পোট :
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত ৫৮০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এসব মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হচ্ছে। এছাড়া হত্যাচেষ্টা, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধে মামলা করছেন সংক্ষুব্ধরা। এরইমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অর্ধশত হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে ৭টি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গণহত্যার অভিযোগগুলোর ওপর তদন্ত শুরু করেছে। আর অন্য মামলার তদন্ত করছে থানা পুলিশ। এসব হত্যা ও গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এমনকি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকেও আসামি করা হয়েছে।
একই মামলায় ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুসহ অনেকেই আসামি করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক, ব্যারপ্রধান, ডিবিপ্রধান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। এর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকার সাবেক এমপি এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অন্তত ১৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গণ আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট (সোমবার) পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর মুদি দোকানদার আবু সায়েদকে (৪৫) হত্যার অভিযোগে গত ১৩ আগস্ট ৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। এটাই ছিলো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া প্রথম হত্যা মামলা।
১৪ আগস্ট ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের নিহত শিক্ষার্থী ফয়জুল ইসলাম রাজন হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের নামে মামলা দায়ের করা হয়। এদিন শেখ হাসিনাসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে গুম করে নির্যাতনের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা। ১৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরো দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মাদ্রাসাছাত্র জোবাইদ হোসেন ইমনকে (১২) গুলি করে হত্যা এবং শেরেবাংলা নগরে অটোরিকশাচালক সাহাবুদ্দিন পুলিশের গুলিতে খুন হওয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে মামলা দুইটি করা হয়।
১৬ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে মো. সিফাত হোসেন (২৬) নামে এক তরুণের মৃত্যুর ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। বগুড়ায় সেলিম হোসেন (৪০) নামে এক শিক্ষক নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরসহ ১০১ জনের নামে মামলা করা হয়।
এরপর ১৭ আগস্ট চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে দুইটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আবুল হাসান স্বজন (২৫) নামে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা হয়। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এমপি শামীম ওসমানসহ ৪৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া কলেজছাত্র তানভীর ছিদ্দিকী (১৯) নিহতের ঘটনায় চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা করা হয়। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ ৩৪ জনকে আসামি করা হয়।
গত ১৮ আগস্ট ঢাকা, রংপুর, নাটোর ও জয়পুরহাটে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরো পাঁচটি হত্যা মামলা হয়। ১৯ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আরো ছয়টি হত্যা মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকার মিরপুরে বিএনপি নেতা আব্দুল্লাহ কবির খানসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় দুটি এবং শেরেবাংলা নগরে কাঠমিস্ত্রি হত্যায় আরেকটি মামলা হয়।
২০ আগস্ট আন্দোলনের সময় ১০ জনকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকা, বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর, ময়মনসিংহের ফুলপুর ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ১০টি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৫টি মামলা করা হয়। এরমধ্যে যাত্রাবাড়ীতে একটি, আদাবরে একটি, মিরপুরে একটি, সূত্রাপুরে একটি এবং রামপুরায় একটি হত্যার ঘটনায় এসব মামলা হয়। এরমধ্যে যাত্রবাড়ীতে করা মামলায় শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামও রয়েছে।
২১ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের সময় ১০ জনকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরো ১০টি হত্যা মামলা করা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় চারটি এবং গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও ফতুল্লা, ঢাকার আশুলিয়া, উত্তরা ও চট্টগ্রামে একটি করে মামলা হয়েছে। ঢাকার পাঁচ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১১৬ জনকে আসামি করা হয়। এছাড়া বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে শেখ হাসিনা, নজরুল ইসলাম বাবু, শামীম ওসমানসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে একটি এবং সিদ্ধিরগঞ্জে শেখ হাসিনাসহ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে আরো দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব হত্যা মামলায় শেখ হাসিনাকে নির্দশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
গণহত্যার ৭ অভিযোগ :
ঢাকার সাভারে নবম শ্রেণির ছাত্র আরিফ আহমেদ সিয়াম আন্দোলনকারী ছাত্র হওয়ায় আসামিদের নির্দেশে পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনায় গত ১৪ আগস্ট সিয়ামের বাবা বুলবুল কবির শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ দাখিল করেন।
এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে নিহত মেহেদীর বাবা মো. সানাউল্লাহর পক্ষে গত ১৫ আগস্ট আরো একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়। এ দুইটি অভিযোগে শেখ হাসিনা ছাড়া গণহত্যায় অভিযুক্ত করা হয়েছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ, সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন আর রশিদকে।
৪ আগস্ট মিরপুরের দেশ পলিটেকনিক কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার হাসান আলভীর (১৫) নিহতের ঘটনায় গত ১৯ আগস্ট গণহত্যার তৃতীয় অভিযোগটি দায়ের করা হয়। আবেদনে শেখ হাসিনা, ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জেপির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক,সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান নিখিলসহ ২৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার চতুর্থ অভিযোগটি দাখিল করেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি হারুন ইজাহার চৌধুরী। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গুলি চালানোর ঘটনায় ২০ আগস্ট গণহত্যার অভিযোগ দাখিল করা হয়।
এরপর ২১ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে তিনটি অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় দাখিল করা হয়। এরমধ্যে ঢাকার ঘটনা নিয়ে দুটি ও চট্টগ্রামের ঘটনা নিয়ে অপর অভিযোগটি করা হয়।
গত ১৩ আগস্টের পর থেকে ঢাকার পাশাপাশি সারাদেশেই মামলা হচ্ছে। এক সপ্তাহে সারাদেশে পাঁচ শতাধিক মামলা হয়েছে। এর বেশিরভাগ হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও নির্যাতনের অভিযোগ। এসব মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মী আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৯ আগস্ট একদিনে অন্তত সাড়ে ৬ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া ২১ আগস্ট আরও ১৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় সাবেক এমপি, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, মেয়র, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় আড়াই হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। রা/অ