রবিবর, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:২২ am
ডেস্ক রির্পোট :
সম্প্রতি সর্বজনীন পেনশন ও সরকারি চাকরির কোটা নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী শিক্ষক নেতারা সম্মিলিতভাবে যোগদান করছেন। শিক্ষক-কর্মচারীদের টানা কর্মবিরতির মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাভাবিক সব কার্যক্রম বন্ধ। শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের অভিভাবকদের অসন্তোষও দানা বেঁধেছে। এতে সার্বিক শিক্ষা খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। আবার শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন করছে। তারা যেসব দাবিতে আন্দোলন করছে, তা সরকারের পলিসির বিষয়।
তাদের পক্ষ থেকে যদি বলা হয়, তাহলে আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে উদ্যোগী হতে পারি। তাই যাদের হাতে এই সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা কোনোভাবেই চাই না বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা চলুক, শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হোক।’ সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্তির পরই শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করেন।
প্রথম দিকে এই আন্দোলন স্বাক্ষর সংগ্রহ, মানববন্ধন, অর্ধদিবস কর্মবিরতির মতো নমনীয় কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে শিক্ষকরা কোনো সাড়া না পাওয়ায় গত ১ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে নেমেছেন। যদিও পেনশন কর্তৃপক্ষ কিছু দাবি মেনে নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেও এতে আন্দোলন থেকে সরছেন না শিক্ষকরা।
‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রত্যাহার ছাড়াও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন এবং সুপারগ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির আরো দুটি দাবি রয়েছে শিক্ষকদের। তাঁদের কর্মবিরতির ফলে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষকরা বলছেন, ‘প্রত্যয়’ স্কিম বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কর্তনের মাধ্যমে শিক্ষকসমাজের মর্যাদা হনন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরাসরি উচ্চতর পদে নিয়োগ হয়, এমনকি অভ্যন্তরীণ প্রার্থীও নতুনভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। এতে যদি কোনো শিক্ষক উচ্চতর পদে সরাসরি বা নতুন নিয়োগ পান, তাহলে তাঁকে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা ত্যাগ করে সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হতে হবে। এতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহী হবেন না।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রত্যয় স্কিম বৈষম্যমূলক ও অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এই স্কিম যাঁরা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ব্যাপারে সরকারকে ভুল বুঝিয়েছেন। নয়তো আজ আমাদের সর্বাত্মকভাবে কর্মবিরতিতে যেতে হতো না। যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগে থেকে উদ্যোগী হতো, তাহলে আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করা যেত। কারণ আমরা তিন মাস ধরে মৌন কর্মসূচি পালন করেছি। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। কিন্তু কোনো ফল না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
গত ৫ জুন এক রিট মামলার নিষ্পত্তি করে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্য কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছিল, তা বাতিল করে দেন হাইকোর্ট। এই আদেশের ফলে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে (জাতীয় বেতন গ্রেড নবম থেকে ১৩তম) কোটা পুনর্বহাল হয়েছে। এতে টানা পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা ফিরে এলো।
ফলে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শুরুতে এই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অবস্থান কর্মসূচি ও মানববন্ধনে সীমাবদ্ধ ছিল। কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচির দিকে যাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এরপর তারা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন।
গতকাল থেকে শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের অধীনে ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন। কিন্তু মূল্যায়ন এখনো চূড়ান্ত না হলেও জানা গেছে, থাকবে না আগের মতো জিপিএ বা গ্রেডিং পদ্ধতি। সাতটি পর্যায়ে মূল্যায়ন করা হবে, যা ইংরেজি বর্ণ দিয়ে বোঝানো হবে। কিন্তু নতুন শিক্ষক্রম চালুর দেড় বছর পার হওয়ার পরও মূল্যায়নপদ্ধতি সহজবোধ্য না হওয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম নিয়েই অভিভাবকদের অসন্তুষ্টি আছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো বড় পরিবর্তনের আগে যে প্রস্তুতিটা নেওয়া দরকার, তা নিতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে বড় ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছে উপস্থাপন ও প্রচারে যে উদ্যোগ দরকার, তা নেওয়া হয়নি।
দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। তাঁরা সরকার থেকে শুধু মূল বেতন পান। এর বাইরে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বাবদ মাত্র এক হাজার ৫০০ টাকা পান। এমনকি শিক্ষকরা ঈদ বোনাস পান মূল বেতনের মাত্র ২৫ শতাংশ। ফলে তাঁরা বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। এরপর আবার নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ায় শিক্ষকদের দায়িত্ব বেড়েছে। তাঁদের বেশি সময় দেওয়া লাগছে। এই শিক্ষকরাই যখন অবসরে যান তখন আবার তাঁদের অবসর ও কল্যাণের এককালীন টাকা পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। এখনো প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষকের অবসর ও কল্যাণের আবেদন ঝুলে আছে।
বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল বাশার হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেসরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শক্তি কম। ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ম্যানেজিং কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়। অন্যদিকে সরকারের বিভিন্ন অফিস নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সব জায়গা থেকে ভয় দেখানো হয়। আমাদের শিক্ষকরা খুবই কম বেতন পেয়ে চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আমরা গত বছরও আমাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেছি। কিন্তু আমাদের যেহেতু শক্তি, মর্যাদা, আর্থিক সংগতি কম, তাই আমরা কঠোর হতে পারি না। এর পরও আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না।’ সূত্র : কালেককণ্ঠ