মঙ্গবার, ০৩ িসেম্র ২০২৪, সময় : ১১:২৯ pm
পরিবেশের সুরক্ষা তো বটেই, এমনকি বজ্রপাত রোধ করে জীবনরক্ষার ক্ষেত্রেও তালগাছ বড় সহায়ক শক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তালগাছের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে তালবীজ রোপণে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপটেই বিশেষ কর্মসূচিও গৃহীত হয়। কিন্তু জীবনরক্ষার প্রয়োজনে সরকারের এই কর্মসূচি নিয়েও দুর্নীতিবাজদের আখের গোছানোর অপতৎপরতা থেমে থাকেনি। এরই ফের খণ্ডিত আরও একটি কদর্য চিত্র উঠে এসেছে ১৬ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ। ‘কই গেল ২৬ হাজার তালগাছ’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে প্রশ্নের গর্ভে অনেক প্রশ্ন জন্মেছে। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় বন বিভাগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর প্রায় ২৬ হাজার তালবীজ রোপণের কথা বললেও বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ কি তালবীজ রোপণ করা হয়েছিল? কারণ, গত পাঁচ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি তালবীজগুলো!
আমরা জানি, দেশে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বজ্রপাতে প্রাণহানির হার। পরিবেশের সুরক্ষা ও বজ্রপাত থেকে প্রাণহানির পথ রুদ্ধ করতে ২০১৭ সালে সারা দেশে রাস্তার দুই পাশে তালগাছের বীজ ও চারা রোপণের যে নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন কার্যত এক্ষেত্রে কাজের কাজ যে তেমন কিছুই হয়নি, বরং অসাধু দায়িত্বশীলদের প্রকল্পের অর্থে উদর ভরেছে বিদ্যমান বাস্তবতা এই সাক্ষ্য দিচ্ছে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর যৌথভাবে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় তালবীজ রোপণের ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে এর দায়ভার তারা এড়াতে পারেন না। প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা। প্রকল্প ঘিরে কদাচারের ছড়াছড়ি দেশে নতুন কিছু নয়। প্রকল্প মানেই যেন অসাধুদের উদর পূর্তির মচ্ছব। তালবীজ প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে কি না প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর তরফে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চারঘাট জোনের সহকারী প্রকৌশলীর প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে যে উত্তর মিলেছে তাও প্রশ্নবোধক। তার বক্তব্য, ‘তালবীজ অঙ্কুরোদগম হতে অনেক সময় লাগে। এজন্য হয়তো সেগুলো এখনও দৃশ্যমান হয়নি।’ উদ্ভিদবিদ্যার কোনো সংজ্ঞাসূত্র মতেই যেকোনো বীজের অঙ্কুরোদগম হতে পাঁচ বছর সময় লাগে এমনটি আমাদের জানা নেই। আমরা জানি, তালগাছ কম বর্ধিষ্ণু প্রজাতির গাছ বটে, কিন্তু বীজের অঙ্কুরোদগমে পাঁচ বছর লাগার যুক্তি হাস্যকর যুগপৎ প্রশ্নবোধকও।
শুধু তালগাছই নয়, আমরা দেখছি; সরকারের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ঘিরে সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই অনিয়ম-দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উঠে আসছে। একই সঙ্গে বলবানদের ছত্রছায়ায় গাছের ওপর অভিঘাত লাগছে নির্বিচারে এবং এর ভয়াবহ বিরূপ মূল্য দিতে হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। দেশে দীর্ঘ উচ্চতার গাছ নানা কারণে কমছে। এমনকি তাল, সুপারি, নারকেলের মতো দীর্ঘ উচ্চতার প্রজাতির গাছগুলোও রয়েছে ঝুঁকিতে। তা ছাড়া এখন এই গাছগুলোও নানাভাবে ব্যবসায়িক উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামবাংলায় উন্নয়নের নামে প্রকৃতির ওপর কঠিন অভিঘাতের নিদারুণ কোপ পড়েছে তালগাছের ওপরও। প্রধানমন্ত্রী কিছু দিন আগেও বলেছেন, যেকোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রকৃতির সুরক্ষা এবং পরিবেশের বিষয়টি আমলে রাখতে হবে। কিন্তু প্রকল্প প্রণয়নকারীদের অনেক ক্ষেত্রেই যে তা আমলে থাকে না এর নজির কম নেই। তালনির্ভর জীবন থেকে আমরা ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় প্রাকৃতিক বিশৃঙ্খলা নিশানা নির্দেশ করছে। আমরা জানি, তালগাছের ডগা থেকে গোড়া পর্যন্ত প্রায় সবকিছু আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গেও জড়িত। যেমন তালের হাতপাখা, ঘরের ছাউনি, মাদুর কিংবা কৃষকের মাথাল হিসেবেও তালগাছের অঙ্গ ব্যবহৃত হয়। তালের গাছ ডোঙা নৌকা, গোড়াঢেঁকি ও গাইল তৈরিতে ব্যবহৃত হওয়ার পাশাপাশি ঘরের খুঁটি থেকে শুরু করে সিলিং পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়। গ্রামের উঁচু তালগাছ পরিচিতির সহজ স্মারকও বটে। এমনকি তালের স্মৃতিতে দেশের বহু স্থানের নামও আছে। এসব কিছু ছাপিয়ে তালগাছ আমাদের জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বজ্রনিরোধ এই গাছের গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলো নিয়ে নয়-ছয়ের প্রতিবিধান নিশ্চিত করা জরুরি।
আমাদের স্মরণে আছে, গত বছর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ সচিত্র প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে একটি সড়কের দুই পাশে আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় এক যুগ আগে রোপণ করা তালগাছ ন্যাড়া করে দেয় নিরাপত্তার অজুহাতে পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ। অথচ তা রেখেও পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের সামনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথ উন্মুক্ত ছিল। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ গত সেপ্টেম্বরে ঠাকুরগাঁওয়ের ইমাম খোরশেদ আলী ৫৪ হাজার তালগাছ লাগিয়ে জনপ্রশংসার প্লাবনে প্লাবিত হওয়ার সংবাদ উঠে এসেছিল। খোদ সরকারি বিভাগ বা সংস্থাগুলো যেখানে এমন অদূরদর্শিতা ও অসাধু দায়িত্বশীলদের দুর্নীতির উপাখ্যানের চিত্র সংবাদমাধ্যমে খবরের উপকরণ হয় সেখানে পল্লী চিকিৎসক একজন ইমান খোরশেদ আলীর কর্মকাণ্ড আমাদের শুধু অনুপ্রাণিতই করে না দায়িত্বশীলদের শিক্ষার পাঠ নির্দেশক হিসেবেও ভূমিকা রাখে। গাছ নিধন কিংবা প্রতিপালনের দৈন্য চিত্র যখন শুভবোধসম্পন্নদের উদ্বিগ্ন কিংবা ব্যথিত করার পাশাপাশি বিরূপ প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি করে তখন একজন খোরশেদ আলীর এমন মহতী উদ্যোগ পরিবেশ ও জীবন রক্ষায় দৃষ্টান্ত হয়ে আমাদের সামনে জ্বলজ্বল করে। গাছপ্রেমী এমন আরও অনেকেই আছেন, যারা নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জনস্বার্থে নিজেদের নিবেদিত করেছেন বা করছেন। নিজেকে নিঃশেষ করে পারিপার্শ্বিকতা অশেষ করার এমন মহতী কর্মকাণ্ডের বিনাশে তৎপরও অনেকেই।
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় বন বিভাগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে কথিত ২৬ হাজার রোপণ করা তালবীজের হদিস খুঁজে বের করতেই হবে। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে পরিবেশ ও জীবনরক্ষার মতো অতি জরুরি বিষয়। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ভয়াবহভাবে আমরা প্রকৃতির বিরাগভাজনের শিকার। তালগাছ রোপণ ও প্রতিপালনে সরকার যখন অধিক গুরুত্বারোপ করেছে সেখানে প্রকল্পের এই লুটপাট অনুসন্ধানক্রমে প্রতিকার নিশ্চিত করতেই হবে। ঐতিহ্যবাহী পরিবেশবান্ধব তালগাছের সংখ্যা বাড়ানোর প্রচেষ্টা হোঁচট তো খেয়েছেই, যেগুলো আছে সেগুলোও এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। চলতি মাসেই সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, শত কোটি টাকার তালগাছ কৌশল ব্যর্থ, আসছে হাজার কোটির বজ্রনিরোধক দণ্ড। যে গাছ দিয়ে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা পুষ্ট করা যায় সেখানে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা দেশের অর্থনীতির ওপরও অভিঘাত বলে আমরা মনে করি। সর্বাগ্রে দরকার সুশাসন। সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে ‘কই গেল ২৬ হাজার তালগাছ’Ñ এ রকম সংবাদ শিরোনামের পথ সংকুচিত হবে। সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ