শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:৫৮ pm
ডেস্ক রির্পোট :
মাদক, অবৈধ অস্ত্রসহ নিষিদ্ধ পণ্য চোরাচালানের ঢাল হয়ে উঠছে দেশের একশ্রেণির মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই নেই বৈধ লাইসেন্স। নীতিমালা অনুসরণ না করে পণ্য বুকিং নিয়ে সরবরাহ করায় বৈধ কুরিয়ার সার্ভিসও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের চোরাচালানের মাধ্যম হয়ে উঠছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচারের ঘটনা নজরে আসার পর থেকে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস সুন্দরবন, এসএ পরিবহন, করতোয়া, ডিএইচএলসহ অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাদক, অস্ত্র ও অবৈধ পণ্য বুকিং দিয়ে পাচারের চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে কেবল মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরই এ-সংক্রান্ত ৬৫টি মামলা করেছে। ডিবি, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের অভিযানেও মাদক ও অস্ত্রসহ নিষিদ্ধ পণ্য উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। তবুও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চোরাচালান বন্ধ হয়নি।
গত ২৬ মার্চ করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসে পাচারের সময় পাবনায় অভিযান চালিয়ে ১২ কেজি গাঁজাসহ মাদক কারবারি কালু মোল্লাকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ২০২৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ফরিদপুর জেলা কার্যালয়। ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের বিভিন্ন সময় এবং তারও আগে ২০১৩-১৪ সালের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক ও অস্ত্র পাচারের সময় সেগুলো উদ্ধার হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা পরিচালনা-সংক্রান্ত আইন নেই অন্তত এক যুগ। পোস্ট অফিস অ্যাক্টের অধীনে ২০১১ সালে একটি বিধি তৈরি করে মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যক্রম মনিটরিং ও জবাবদিহির মধ্যে রাখতে ‘মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলা হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটিও পর্যাপ্ত জনবল সংকটের কারণে মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে মনিটরিং করতে পারছে না। ফলে পণ্য বুকিং এবং ডেলিভারির ক্ষেত্রে বিধিমালায় উল্লেখিত শর্তসমূহ মানছেন না কুরিয়ার সার্ভিসের মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বর্তমানে দুই শতাধিক অভ্যন্তরীণ, আন্তর্জাতিক এবং অন বোর্ড মেইলিং অপারেটর এবং কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রয়েছে ৫ শতাধিক নামে-বেনামে গড়ে ওঠা অবৈধ কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান। যার অধিকাংশই কার্যালয়বিহীন অথবা ভুয়া ঠিকানার।
জানতে চাইলে মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (যুগ্ম সেক্রেটারি) ড. মো. মহিউদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, পোস্ট অফিস অ্যাক্টের অধীনে একটি বিধি তৈরি করে এর আলোকে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসার কার্যক্রম চলছে। কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা তদারকি, লাইসেন্স দেওয়া এবং অবৈধভাবে পরিচালিত সার্ভিসের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কোনো আইন নেই।
তিনি জানান, কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যক্রম একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার জন্য মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের নিজস্ব একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটি বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায়। আইন পাস হলে অবৈধ কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যক্রম বন্ধ করার পাশাপাশি তালিকাভুক্ত সার্ভিসগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসার তদারকি প্রতিষ্ঠান ‘মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ’ নির্ধারিত ফি নিয়ে সরকারিভাবে লাইসেন্স দিয়ে থাকে। এ বিধির বাইরে কারও লাইসেন্স পাওয়া এবং ব্যবসা পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। তবে মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অনেকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বেশ প্রভাবশালী। তবুও সমন্বয় করে সকল ধরনের কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা নিয়মের মধ্যে পরিচালনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স ও গোয়েন্দা) ডিআইজি তানভীর মমতাজ জানান, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচার ঠেকাতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো নিয়ে সম্প্রতি এক মিটিংয়ে আলোচনাও হয়েছে। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচার প্রতিরোধের বিষয়টি মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মনিটরিং করে। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সকল কুরিয়ার সার্ভিসের প্রধান ও শাখা অফিসগুলোতে স্কানার এবং সিসি ক্যামেরা বসানো প্রয়োজন।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানিয়েছে. ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের গত ১৪ মে পর্যন্ত সময়ে ৬৫টি অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কুরিয়ার সার্ভিস থেকে মাদক উদ্ধার হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪৫ জনের মতো আসামি হয়েছে।
মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, ২০১১ সালে পোস্ট অফিস অ্যাক্ট অনুযায়ী যখন কুরিয়ার সার্ভিস কার্যক্রম এবং ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়, তখন কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএসএবি) উচ্চ আদালতে রিট করে। আদালত সেই রিটের আলোকে কিছু নির্দেশনা দেন। আদালতের নির্দেশনা মেনেই ২০১৩ সালে বিধি তৈরি করা হয়।
বিধি অনুযায়ী, সিএসএবির সদস্য হওয়া পর লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবে যে কেউ। কিন্তু অনেকেই ৪০ হাজার টাকা খরচ করে সিএসএবির সদস্য হতে চায় না। সদস্য হওয়ার পর সদস্যপদ নবায়নের জন্য ফি দিতে চায় না। এভাবে অনেক সার্ভিসই অবৈধ হয়ে পড়ে। তবে সিএসএবি নেতারা বলছেন, কুরিয়ারের লাইসেন্স নেওয়ার সময় জামানত, অতিরিক্ত লাইসেন্স ফি এবং এজেন্ট নিয়োগের জন্য পৃথক লাইসেন্সসহ বেশকিছু জটিল প্রক্রিয়ার কারণে অনেকেই অবৈধভাবে কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর ফলে অবৈধ পণ্যের বুকিং ও ডেলিভারির ঘটনা ঘটছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি মো. আনোয়ার হোসেন জানান, কুরিয়ার সার্ভিস মনিটরিং করার জন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এর মাধ্যমে অবৈধ পণ্য বুকিং ও ডেলিভারির অভিযোগ পেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে এবং গ্রেপ্তার ও মামলা দেয়। অবৈধ কুরিয়ার বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পুলিশের সহযোগিতা চাইলে পুলিশ বিধি অনুযায়ী সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক কোনোটিই আমাদের দেশে তৈরি হয় না। এসব আসে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে। এসব নিষিদ্ধ পণ্য চোরাচালানের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ব্যবহার হয় কুরিয়ার সার্ভিস। এক্ষেত্রে পণ্য ধরা পড়লেও জড়িতরা ধরা পড়ছে না। তাই কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব সংস্থার সমন্বয় থাকতে হবে।
কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি হাফিজুর রহমান পুলক বলেন, ‘অবৈধ কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে আমরা বেশকিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। আমরা চাই কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা জবাবদিহির মধ্যে চলুক। সেই সঙ্গে লাইসেন্স ও নবায়ন ফি কমানো হোক। কারণ কুরিয়ারের লাইসেন্স ফি, জামানত ফি ও নবায়ন ফির টাকা মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় অনেক ছোটখাটো কুরিয়ার টিকতে না পেরে অবৈধ ব্যবসার পথে পা বাড়াচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক লাইসেন্স সারেন্ডার করে গোপনে ব্যবসা করছে। সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠান কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা আমাদেরও বোধগম্য নয়। আমরা মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কাছে লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা করছেÑ এমন কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর একটি আপডেট তালিকা দিয়েছি।’
মেইলিং অপারেটিং কর্তৃপক্ষ এবং সিএসএবির তালিকায় যেসব প্রতিষ্ঠান মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, তাদের তালিকা অনুযায়ী দেশে ২৩০টি কুরিয়ার সার্ভিস রয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সার্ভিস ১১০টি এবং আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস ৬৫টি। অনবোর্ড (ভারত-বাংলাদেশ) কুরিয়ার রয়েছে ৩০টি। তবে অন্য একটি সূত্র বলছে, অভ্যন্তরীণ কুরিয়ার সার্ভিসের সংখ্যা ১৫০-এর বেশি। আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের সংখ্যা ৯০টি। তবে অন বোর্ড কুরিয়ার সার্ভিসের সঠিক কোনো সংখ্যা নেই।
ওই কর্মকর্তা বলেন, তালিকার বাইরেও অবৈধ কুরিয়ার সার্ভিসের সংখ্যা অনেক। অধিকাংশই ঠিকানাবিহীন। কাগজেকলমে এক ঠিকানা দিলেও অধিকাংশেরই কোনো নিজস্ব অফিস বা কার্যালয় নেই। আবার অনেক কুরিয়ার এক নামে লাইসেন্স নিয়ে একাধিক কুরিয়ার সার্ভিসের নামে ব্যবসা চালাচ্ছে।
অন্যদিকে সিএসএবি বলছে, অভ্যন্তরীণ কুরিয়ার সার্ভিসের ৫৩টি লাইসেন্সবিহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তবে গত বছরের ১৩ জুন মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কাছে সিএসএবি নতুন একটি তালিকা জমা দিয়েছে। এতে অভ্যন্তরীণ ২৪টি কুরিয়ার সার্ভিসের নাম দিয়ে সিএসএবি জানিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ব্যবসার জন্য দেওয়া জামানতের টাকা তুলে নিয়েছে। সিএসএবির সদস্যপদ নবায়ন করেনি। তাদের প্রত্যেকের সদস্যপদ স্থগিত রয়েছে। অনেকেই আছে যাদের সঙ্গে সাত-আট বছর ধরে সিএসএবির যোগাযোগ নেই।
এ ২৪টি কুরিয়ার সার্ভিস হচ্ছে- গ্রেট ওয়েল কুরিয়ার সার্ভিস, জেএস কুরিয়ার সার্ভিস, ভিশন এক্সপ্রেস, ইউনিয়ন কুরিয়ার সার্ভিস, কনকর্ড কুরিয়ার সার্ভিস, অগ্রদূত কুরিয়ার সার্ভিস, এক্সপ্রেস টাইমস, মদিনা কুরিয়ার সার্ভিস, প্রগতি এক্সপ্রেস কুরিয়ার সার্ভিস, সেন্ট্রাল কুরিয়ার সার্ভিস, টপ এক্সপ্রেস, অলরেডি কুরিয়ার সার্ভিস, কন্টিনেন্ট এক্সপ্রেস, ক্যাপিটাল মার্কেট কুরিয়ার, সেবা কুরিয়ার সার্ভিস, কারেন্ট কুরিয়ার সার্ভিস, স্বদেশ কুরিয়ার সার্ভিস, শ্রাবণ কুরিয়ার সার্ভিস, ডেল্টা কুরিয়ার সার্ভিস, একচ্যুয়াল কুরিয়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ লিমিটেড, এনএসএম এক্সপ্রেস এবং জে এইচ টান্সপোর্ট।
তবে মেইলিং অপারেটর কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া তালিকায় লাইসেন্সের মেয়াদোত্তীর্ণ সার্ভিসের নামের মধ্যে রয়েছে- কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড, সোনার তরী কুরিয়ার সার্ভিস, বিডি এক্স ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড, গ্রেট ওয়েল কুরিয়ার সার্ভিস, কম্প্রোমাইজ কুরিয়ার সার্ভিস, জেএস কুরিয়ার সার্ভিস, বসুমতি কুরিয়ার সার্ভিস, ভিশন এক্সপ্রেস, বাংলা কুরিয়ার সার্ভিস, স্পিড এক্সপ্রেস, ইউনিয়ন কুরিয়ার সার্ভিস, কনকর্ড কুরিয়ার সার্ভিস, অগ্রদূত কুরিয়ার সার্ভিস, অলরেডি কুরিয়ার সার্ভিস, কন্টিনেন্ট এক্সপ্রেস, ক্যাপিটাল মার্কেট কুরিয়ার সার্ভিস, এসবি কুরিয়ার সার্ভিস, সেবা কুরিয়ার সার্ভিস, কারেন্ট কুরিয়ার সার্ভিস, স্বদেশ কুরিয়ার সার্ভিস, ডেল্টা কুরিয়ার সার্ভিস, একচ্যুয়াল কুরিয়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ লিমিটেড, প্রভাতী কুরিয়ার সার্ভিস, এনএসএম এক্সপ্রেস, জেএইচ ট্রান্সপোর্ট, বৈশাখী এক্সপ্রেস লি., এভারেস্ট ল্যান্সর সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক্স, এসআর পার্সেল, রেডেক্স লজিস্টিকস লি., পেপার ফ্লাই প্রাইভেট লি. ইত্যাদি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা বন্ধও করে দিয়েছে।
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, সিএসএবি এবং মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের তালিকার বাইরেও বহু অবৈধ কুরিয়ার রয়েছে।
লাইসেন্স ছাড়াই রমরমা ব্যবসা পোস্ট অফিস অ্যাক্ট অনুযায়ী প্রণীত বিধিমালার তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া কোনো মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না। ব্যবসা পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকতে হবে। কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য গ্রহণ বা পরিবহন করা যাবে না। প্রতিষ্ঠানটিকে সরকার কর্তৃক স্বীকৃত মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতে হবে।
তবে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের বিধি অনুসরণ না করেই ব্যবসা করছে। অবৈধ কুরিয়ার সার্ভিস এবং লাইসেন্স নবায়নবিহীন সার্ভিসের সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ এবং সিএসএবির মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা রয়েছে। হালনাগাদ তথ্য নেই কোনোখানে।
লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান জানান, তারা বিভিন্ন সময় অবৈধ কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে ছদ্মবেশেও অভিযান চালিয়েছেন। এতে দেখা গেছে, অনেক অবৈধ কুরিয়ার সার্ভিসই কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিস আইন না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
নিয়ম মানছে না কুরিয়ার সার্ভিস কুরিয়ার সার্ভিসের বিধি ও নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি কুরিয়ার সার্ভিসের প্রধান ও শাখা অফিস বা এজেন্ট অফিসগুলোতে সিসি ক্যামেরা থাকতে হবে। তাতে কেউ কোনো অবৈধ পণ্য বুকিং করে থাকলে শনাক্ত করা সহজ হবে। দ্বিতীয়ত প্রতিটি বুকিং নেওয়ার সময় বুকিংদাতার সামনে প্যাকেট খুলে চেক করে প্যাকেট করে বুকিং নিতে হবে। তৃতীয়ত প্রতিটি কুরিয়ার সার্ভিসে স্ক্যানার থাকতে হবে। কিন্তু কেউ এসব নিয়ম মানছে না। এ কারণে অবৈধ পণ্য পাচারের ঘটনা বাড়ছে।
কুরিয়ার সার্ভিস বিধিতে বলা আছে, কোনো পার্সেল বুকিং নেওয়ার সময় প্রাপকের সামনে পাার্সেল খুলে সেটির বৈধতা নিশ্চিত হওয়ার পর প্যাকেট করতে হবে। অবৈধ পণ্য আছে কি না তা নিশ্চিত হতে স্ক্যানিং করা হবে সব ধরনের পার্সেল। প্রতিটি কুরিয়ার সার্ভিসের প্রধান অফিস ও শাখা অফিসগুলোতে সিসি ক্যামেরা থাকতে হবে। কিন্তু এসবের কোনোটিই মানছে না কুরিয়ার সার্ভিসের মালিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অন্যদিকে শাখা অফিস বা এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। সারা দেশে ৫ হাজারের বেশি বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এজেন্ট কুরিয়ারের মাধ্যমে অবৈধ পণ্য বুকিং এবং পাচার হয়। যার সঙ্গে সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নানাভাবে জড়িত রয়েছে।
কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাচারের কয়েকটি ঘটনা ২০২০ সালের আগস্টে গুলশান লিংক রোডে আন্তজার্তিক কুরিয়ার ডিএইচএল থেকে সাড়ে তিন হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ট্রাভেল ব্যাগের মধ্যে এই ইয়াবা পাচার করা হচ্ছিল বিদেশে। একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর দারুসসালাম থানাধীন কল্যাণপুরের সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক এবং অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় আটক হয় নারায়ণগঞ্জের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল জলিল মাতবর।
২০২০ সালের ৩১ আগস্ট সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আসবাবপত্রের নামে কুমিল্লা থেকে ৫১ কেজি ৯০০ গ্রাম গাঁজা রাজশাহী পৌঁছে। র্যাব সেগুলো জব্দ করে। ২০১৮ সালের ২৬ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিলে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আসা ৪০ হাজার পিস ইয়াবা তুলে নেওয়ার সময় র্যাব-১০-এর অভিযানে চার মাদক কারবারি আটক হয়। ২০২০ সালের ১৫ জুন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় আনা হেরোইন উদ্ধার করা হয়।
২০১৯ সালে ৯ এপ্রিল ইয়াবার বড় একটি চালান এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসে করে রাজশাহী এলে আটক করে র্যাব। ওই বছরের ১৯ মে রাজধানীর উত্তরায় এসএ পরিবহনের অফিস থেকে ১ লাখ পিস ইয়াবা জব্দসহ দুই মাদক কারবারিকে আটক করে র্যাব। একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর কাকরাইল এসএ পরিবহন থেকে ৯ হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ আন্তঃজেলা মাদক ব্যবসায়ী চক্রের দুই সদস্যকে আটক করে র্যাব। সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ