শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৮:০৬ pm
প্রশংসনীয় শাসক পেতে হলে যে গুণটি তাঁর মধ্যে থাকা লাগবে তা হলো আল্লাহর ভয় ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের শাসক হবেন না, তারা হবেন জনগণের সেবক। জনপ্রতিনিধিরা এ কথাটুকু বেমালুম ভুলে গেছেন। হজরত উমর রা: একদিন গভীর রজনীতে তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করলেন। স্ত্রীকে বললেন, ‘আমার শাণিত তরবারীটি দাও। স্ত্রী বিস্ময়ে বললেন, এত গভীর রাতে তরবারী, কী করবেন? তিনি বললেন, স্ত্রী তোমার হক আদায় করেছি। আল্লাহর হক আদায় করেছি। এখন বাকি আছে জনগণের হক। জনগণের হক আদায় করার জন্য বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছি।
শাণিত তরবারী নিয়ে গভীর অন্ধকার রাতে একা একা বের হয়ে গেলেন। মরুদ্যান মরুভূমি একা একা চলছেন। এমন সময় একজন মহিলার সুরেলা কণ্ঠে একটি প্রেমের গান ভেসে এলো। তিনি চিন্তা করলেন আমার রাষ্ট্রের প্রেমের আবেদনমূলক গান কে গায়। এই দুঃসাহস কার? কেননা কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমার রাষ্ট্র চলে। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন সূরা লোকমানের ৬ নম্বর আয়াত নাজিল করে সব গানবাজনা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি মরুভূমির মধ্যে একটি জীর্ণশীর্ণ গৃহ দেখতে পেলেন। সেই ঘর থেকে গানটি ভেসে আসছিল। গানটি অর্থ হলো, প্রাণবধূয়া তুমি কোথায় তোমায় বিনে ফুলের মধু শুকিয়ে যায়। এ রকম আপত্তিকর গান শুনে খলিফা অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। মরুভূমির মধ্যে ঘরটি ছিল খেজুরের পাতার বেড়া। তিনি পেছন থেকে ভেঙে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। মহিলা হজরত উমরের ভাবমর্যাদা দেখে থরো থরো করে কেঁপে উঠলেন। খলিফা বললেন, ‘হে জনৈক যুবতি মহিলা, বাতি নিভাও।
হজরত উমার প্রশ্ন করলেন, এত রাতে তুমি এ রাষ্ট্রের মধ্যে কেন প্রেমের গান গাইছ। মহিলা বলল, ‘আমি গান গেয়ে যদি অপরাধ করে থাকি তাহলে আমি অপরাধ করেছি একটা আর আপনি অপরাধ করেছেন তিনটা। হজরত উমর রা: বললেন ‘মহিলা বলো আমি কী অপরাধ করেছি।’ মহিলাটি ছিল একজন হাফেজা। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ১৮৯ নম্বর আয়াতটি শুনিয়ে দিলেন যার অর্থ হলো পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। নেকি হলো আল্লাহকে ভয় করার মধ্যে’। মহিলা বলল, ‘হে পথিক তুমি আমার ঘরের পেছন দিক থেকে প্রবেশ করে সূরা বাকারার ১৮৯ নম্বর আয়াতটি লঙ্ঘন করেছো। হজরত উমর রা: এখন ভয়ে থরো থরো করে কাঁপছেন, এরপর খলিফা বললেন, দ্বিতীয় অপরাধ কী? মহিলা এবার সূরা নুরের ২৭ নম্বর আয়াতটি শুনিয়ে দিলেন। যার অর্থ হলো ‘হে মমিনগণ তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য গৃহে প্রবেশ করো না যে পর্যন্ত না আলাপ-পরিচয় হয় এবং গৃহবাসী সালাম না করে’ মহিলা বললেন, ‘হে পথিক আপনি সূরা নুরের ২৭ আয়াত লঙ্ঘন করেছেন। কারণ আপনি আমার গৃহে প্রবেশ করার সময় আমাকে কোনো সালাম দেননি। হজরত উমর রা: আল্লাহর ভয়ে আরো শঙ্কিত হয়ে পড়লেন।
তিনি বললেন, ‘বলো’, মহিলা আমি তৃতীয় অপরাধ কী করেছি? মহিলা এবার সূরা হুজরাতের ১২ নম্বর আয়াত শুনায়ে দিলেন। যার অর্থ এ রকম ‘হে মুমিনগণ তোমরা ধারণা থেকে দূরে থাক, কেন না কিছু ধারণা গোনাহ এবং কারো গোপন বিষয় অনুসন্ধ্যান করো না’। মহিলা বলল, ‘হে পথিক আপনি আমার সম্পর্কে না জেনে খারাপ ধারণা পোষণ করে আমার ঘরে ঢুকেছেন। আপনি সূরা হুজরাতের ১২ নম্বর আয়াতটি লঙ্ঘন করেছেন’। খলিফা বললেন, ‘হে মহিলা তাহলে এবার বলো এত গভীর রাতে কেন প্রেমের গান গাইলে’? মহিলা বলল, ‘হে পথিক শুনুন তাহলে। আমার স্বামীর নাম আবদুল্লাহ ইবনে সাদ। শুনেছি তিনি এই আরবের সুন্দর পুরুষ। তার সাথে বিয়ে হওয়ার পর মিষ্টি বিতরণ চলছিল, এমন সময় এ দেশের খলিফা আমিরুল মুমিনিন খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত উমর রা: জিহাদের ময়দানে যাওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। তারপর আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে জিহাদের ময়দানে চলে গেছেন। শুনলাম চার মাস পরে আবার ফিরে আসবেন। চার মাস পর মদিনায় ফিরে এলে হজরত উমর রা: আবার তাকে জিহাদের ময়দানে পাঠিয়ে দিলেন।
এভাবে আমি আট মাস অপেক্ষা করলাম। আট মাস পরে আমার স্বামী আবার জিহাদ থেকে ফিরে আসছিলেন। পথিমধ্যে আমিরুল মুমিনিন খলিফাতুল মুসলিমিন আবার আরেক যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এভাবে ১২ মাস অতিবাহিত হয়েছে। আমার যৌবন আমি নষ্ট করিনি। গভীর রাতে স্বামীর বিরহ-বেদনায় আমি প্রেমের গান মনের অজান্তে গেয়ে ফেলেছি। এটা যদি অন্যায় হয়ে থাকে আমাকে ক্ষমা করুন। আর আপনি তো তিনটা অন্যায় করেছেন, হজরত উমরের দরবারে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করব।
খলিফা নিজের পরিচয় দিলেন না। বাড়িতে গিয়ে নিজের মেয়ে হাফছাকে ডাকলেন, বললেন স্বামীবিহীন একজন মহিলা কত দিন থাকতে পারে। হাফছা বললেন, ‘আব্বা এ রকম প্রশ্ন কেন করলেন’? তিনি বললেন, ‘এটা আমার জানার প্রয়োজন আছে’। হজরত হাফছা বললেন, ‘চার মাস একজন মহিলা স্বামীবিহীন থাকতে পারে’। এরপর তিনি প্রশাসনের লোকদের ডাকলেন। আবদুল্লাহ বিন সাদকে ছুটি দিয়ে দিলেন। সেই দিন থেকে প্রশাসন লোকদের জন্য মাসিক তিন দিন করে ছুটি দেয়ার নিয়ম চালু হয়। অদ্যাবধি তা কার্যকর আছে।
মহানবীর পর হজরত আবু বকর রা: প্রথম খলিফা নিযুক্ত হন। খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর হজরত আবু বকর রা: তাঁর প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নই। আপনাদের সাহায্য ও পরামর্শ আমার কাম্য। আমি ন্যায় ও সত্যের পথে থাকলে আপনারা আমাকে সমর্থন করবেন। বিপথগামী হলে আমাকে উপদেশ দেবেন। আমি বরণ করব সত্য, বর্জন করব মিথ্যা। আমার চোখে ধনী-নির্ধন সবল-দুর্বল সবাই সমান। আপনারা আমাকে ততক্ষণ মেনে চলবেন, যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-কে মেনে চলি। অন্যথায় আপনাদের নেতা হওয়ার অধিকার থাকবে না। হজরত আবু বকর রা: মুসলিম ও সেনাবাহিনীকে ১০টি উপদেশ দিয়েছিলেন।
তা হলো কাউকে প্রতারিত করো না, ব্যভিচার করো না, বিশ্বাসঘাতকতা করো না, কারো অঙ্গচ্ছেদ করো না, কারো সাথে হিংসা করো না, কারো সাথে অহংকার করো না, স্ত্রীলোক ও বৃদ্ধকে হত্যা করো না, খেজুর গাছ নষ্ট করো না, ফলবান বৃক্ষ নষ্ট করো না, শস্য ক্ষেত নষ্ট করো না, প্রয়োজন ব্যতীত গবাদিপশু হত্যা করো না।
সত্যবাদিতা হজরত আবু বকরের প্রথম পরিচয়। সত্যবাদিতার জন্য তিনি সিদ্দিক উপাধি পেয়েছিলেন। খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর যথারীতি কাপড়ের ব্যবসায় করতেন। এক দিন তিনি বাজারে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় উমর রা:-এর সাথে দেখা হলে তিনি বললেন, কোথায় যাচ্ছেন? জবাবে হজরত আবু বকর রা: বললেন, ‘ব্যবসার কাজে বাজারে যাচ্ছি’ তখন উমর রা: বললেন, এভাবে বাজারে গেলে রাষ্ট্রের কাজ কিভাবে চলবে! হজরত আবু বকর রা: বললেন, ‘আমার পরিবার পরিজনের ভরণপোষণের কী হবে?’ জবাবে হজরত উমর রা: বললেন, ‘আপনার কাছে মুসলমানদের যে কোষাগার বা বায়তুল মাল আছে, তা হতে আপনার ভরণপোষণের খরচ বাবদ ভাতা নির্দিষ্ট করা হবে, কারণ আপনি সব মুসলমানের তরফে খেলাফত কাজে নিয়োজিত আছেন।
অতঃপর তারা দু’জনে মিলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শে একজন সাধারণ মোহাজিরের ভাতার সমপরিমাণ ভাতা খলিফার জন্য নির্ধারণ করলেন। এই সব গুণ গুলো জনপ্রতিনিধির মাঝে থাকতে হবে।
প্রতারিত করো না, ব্যভিচার করো না, মিত্তা কথা বলিও না, গিবিত করিও না, জুলুম করিও না, কারোও কতি করিও না, বিশ্বাসঘাতকতা করো না, কারো অঙ্গচ্ছেদ করো না, কারো সাথে হিংসা করো না, কারো সাথে অহংকার করো না, স্ত্রীলোক ও বৃদ্ধকে হত্যা করো না, খেজুর গাছ নষ্ট করো না, ফলবান বৃক্ষ নষ্ট করো না, শস্য ক্ষেত নষ্ট করো না, প্রয়োজন ব্যতীত গবাদিপশু হত্যা করো না। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এই গুলোর উপর আমল করার তাওফিক দান করুন আমিন।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।